Advertisement
০৭ মে ২০২৪

বিরোধী পরিসরে বিজেপি, পরিবর্তন কেবল এইটুকুই

বিজেপিকে অবশ্য ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

রাজীব চট্টোপাধ্যায়
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

জলপাইগুড়ি যাওয়ার বাস তখন সবে বেলাকোবা অতিক্রম করেছে। শহর পৌঁছতে আরও অন্তত ৪৫ মিনিট। কিন্তু তখনই রাস্তার দু’ধারে জমে উঠেছে তৃণমূল-বিজেপির দেওয়াল যুদ্ধ। দু’ধারে পাল্লা দিয়ে উড়ছে দুই দলের পতাকা। আরও কিছুটা দৌড়ে বাস ডেঙ্গুয়াঝাড় রেলক্রসিংয়ে দাঁড়ানোয় চোখে পড়ল জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের বামপ্রার্থীর সমর্থনে লেখা ব্যানার। তবে জোড়াফুল আর পদ্ম ফুলের ব্যানারের ভিড়ে তাকে খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। ভোটের প্রাক্কালে দেওয়াল আর পতাকা যুদ্ধই বলে দিচ্ছে জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে লড়াই মূলত তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির।

চায়ের দোকান হোক বা সেলুন, ভোটের আলোচনায় ঢুকলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, জলপাইগুড়ির রাজনীতি গত দু’বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে ভিন্ন খাতে। বামেদের একটু-একটু করে সরিয়ে বিরোধী পরিসরের দখল নিচ্ছে বিজেপি। অথচ পাঁচ বছর আগেও ছবিটা এমন ছিল না। ২০১৪-র ভোটে তৃণমূলের কাছে পর্যুদস্ত হলেও ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে বিজেপির থেকে অনেক এগিয়েছিল বামেরা। সে বার লোকসভা ভোটে বিজেপির ঝুলিতে পড়েছিল ১৭ শতাংশ ভোট। বামেরা পেয়েছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হওয়ায় জলপাইগুড়িতে বামেরাই ছিল তৃণমূলের প্রধান বিরোধী। বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হারও কমে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশের সামান্য বেশি। বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ ভোট। এর পর বাম-কংগ্রেস ‘ঐক্যে’ ফাটল ধরার পরই পরিস্থিতি দ্রুত বদলায়। জেলায় ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ে বামেরা। তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে উঠে আসে বিজেপি।

বিজেপিকে অবশ্য ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল। জলপাইগুড়ি কেন্দ্রে বিজয়চন্দ্র বর্মনকে এ বারেও প্রার্থী করেছে তৃণমূল। মূল প্রতিপক্ষ কে? বিজয়ের জবাব, ‘‘সেই উত্তরই তো খুঁজছি। এখনও জানতেই পারলাম না কে আমার মূল প্রতিপক্ষ। সিপিএম? নাকি বিজেপি? কাউকেই তো ময়দানে দেখা যাচ্ছে না।’’ আর এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এমন অন্তত ৩০০ বুথ আছে, যেখানে বিজেপিকে কেউ চেনেই না। ওই বুথগুলি থেকে ৩০০ ভোটের ‘লিড’ নিলেই আমরা ৯০ হাজার ভোটে এগিয়ে থাকব।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অন্য দিকে বিজেপি প্রার্থী চিকিৎসক জয়ন্ত রায়ের দাবি, ‘‘সিপিএম বলে এখানে আর কিছু নেই। মানুষ দেখেছেন, কী ভাবে উন্নয়নের টাকা লুট করেছে তৃণমূল। কী ভাবে পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাস চালিয়েছে শাসকদলের গুন্ডারা। সিপিএম অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়ায় বিজেপিকে ভোট দিয়েই মানুষ তার ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটাবে।’’

কেন্দ্র এক নজরে- জলপাইগুড়ি
• ভোট: ১৮ এপ্রিল
• ভোটার: ১৭ লক্ষ ৩১ হাজার ৮৩৪
• ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে জয়ী তৃণমূল
• ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের ফলে এগিয়ে তৃণমূল

বিজেপি প্রার্থীর এমন দাবি শুনে তৃণমূল নেতারা মুচকি হাসলেও স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, এ বার শাসকদলকে বেগ দিতে পারে বিজেপি। বামেদের কথা তুললেই, ‘এখানে সিপিএম বলে কিছু নেই’ গোছের মন্তব্য করেছেন অনেকে। প্রচারে বামেরা যে পিছিয়ে তা স্বীকার করেছেন সিপিএম প্রার্থী ভগীরথ রায়ও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্রচারে কিছুটা খামতি রয়েছে। সে কথা নেতৃত্বও জানেন।’’ তবে তিনি দাবি করেছেন, ‘‘এমন অনেক জায়গাও রয়েছে যেখানে ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে মানুষ আমাদের মিছিলে হাঁটছেন। দেখবেন, এ বার আমরাই জিতব।’’ কিন্তু জয় আসবে কোন রসায়নে? ভগীরথের ব্যাখ্যা, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এ বার পারবেন কি না, তা মানুষ আমাদের থেকে জানতে চাইছেন। অনেক তৃণমূলকর্মী আমাদের শিবিরে এসেছেন।’’

ব্যক্তিগত আলাপে অনেক বাম নেতাকর্মীই জানিয়েছেন, ‘মেরুকরণের’ রাজনীতিকে কাজে লাগিয়েই জলপাইগুড়িতে জমি শক্ত করেছে বিজেপি। প্রান্তিক হয়েছে বামেরা। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা এবং ‘পিটিয়ে মারা’ নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন ধুপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ক্রান্তি-সহ জলপাইগুড়ির অনেক জায়গায় জাতীয়তাবাদ প্রচারের নামে জেলায় বিজেপির মাটি শক্ত করেছে কয়েকটি সংগঠন। ২০১৭ সালের অগস্টে এই ধুপগুড়িতেই গোরু পাচারের অভিযোগে পিটিয়ে মারা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই যুবককে। তার পর ছেলেধরা সন্দেহে মারধরের একাধিক ঘটনাও ঘটেছে ওই এলাকায়। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা এবং বালাকোটে প্রত্যাঘাত পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদ প্রচারের নামে কার্যত বিজেপির হয়ে ভোটপ্রচারে নেমেছে একাধিক সংগঠন। এর ফলে মেরুকরণ আরও বেড়েছে। যার প্রতিফলন পড়েছে সম্প্রতি ময়নাগুড়িতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভায়। প্রধানমন্ত্রীর সভা সম্পর্কে জলপাইগুড়ি শহরের এক টোটোচালকের প্রতিক্রিয়া, ‘‘অনেক সভা দেখেছি। এ রকম ভিড় আগে কখনও দেখিনি।’’

তবে, জলপাইগুড়িতে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থাকলেও তা চোখে পড়েছে সামান্যই। এমনকি, দীর্ঘ দিন ধরে চা বাগান বন্ধ থাকলেও রাজ্য সরকার বিরোধী মন্তব্য তেমন একটা শোনা যায়নি। উল্টে অনেকেই বলেছেন, খাদ্যসাথী প্রকল্পের কারণে তাঁদের দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া নিয়ে ভাবতে হয় না। স্কুলে খাবার পায় ছেলেমেয়েরা। চিকিৎসা পরিষেবা নিয়েও ক্ষোভ নেই। কর্মহীন চা শ্রমিকদের পরিবারের কেউ না কেউ ১০০ দিনের কাজ পান। রাস্তাঘাট বা পানীয় জল নিয়েও তেমন কোনও ক্ষোভ নেই শ্রমিক মহল্লায়। বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলনের জন্য যৌথ মঞ্চ গঠন করেছিল বামেরা। কিন্তু ভোটের বাক্সে তার ছায়া আদৌ পড়বে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। জলপাইগুড়িতে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে শ্রমিক নেতা মণিকুমার ডার্নালকে। দীর্ঘদিন তিনি চা শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বন্ধ চা-শ্রমিকদের ভোটে তিনি কিছুটা ভাগ বসাতে পারেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরদের একাংশ।

চা বাগান নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা না থাকলেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘ভোট লুট’ এবং ‘দলের অন্দরে চোরাস্রোত’ অবশ্য কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে তৃণমূলকে। পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের কর্মীরা অনেক জায়গাতেই বিরোধীদের ভোট দিতে দেয়নি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করেছেন অনেক তৃণমূল নেতাই। তাঁদের এক জনের কথায়, ‘‘ভোট হলেও সব জায়গায় আমরা জিততাম। এতটা বাড়াবাড়ির প্রয়োজন ছিল না।’’ অন্য এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘পাহাড়পুর, বরাপেটিয়া, পাতকাটা, বেলাকোবা, অরবিন্দ, বাহাদুর— এমন অনেক পঞ্চায়েতের বহু জায়গায় কার্যত ভোটই হয়নি।’’ যদিও প্রার্থী বিজয়বাবুর বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতাই ছিল না। আমরা যা উন্নয়ন করেছি, তাতে পঞ্চায়েত ভোটের অনেক আগেই ওদের ঘটি উল্টে গিয়েছিল। তা সোজা হওয়ার আর কোনও পথ নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE