Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

‘প্রতারণা’, ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ ছাপিয়ে, দার্জিলিংয়ে স্বাভিমান বনাম উন্নয়নের গণিত

পরিচয় দিতেই ডোরাকাটা টি-শার্ট আর সস্তার রংচটা জিনস পরা রাজু মাহালির ঠোঁটে খেলে গেল চিলতে ম্লান হাসি।

নিজের বাড়ির বারান্দায় রাজু মাহালি। এই বাড়িতেই ২০১৭ সালে খেয়ে গিয়েছেন অমিত শাহ। সেই গল্পই শোনাচ্ছেন রাজু।

নিজের বাড়ির বারান্দায় রাজু মাহালি। এই বাড়িতেই ২০১৭ সালে খেয়ে গিয়েছেন অমিত শাহ। সেই গল্পই শোনাচ্ছেন রাজু।

সিজার মণ্ডল
দার্জিলিং শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:২৪
Share: Save:

বস্তাটা মাথা থেকে নামিয়ে রাখলেন রোগাটে চেহারার যুবকটি। আনমনে বিড়বিড় করতে করতে বস্তা থেকে কয়েকশো ঘুঁটে নামিয়ে, চটের বস্তাটা ঝাড়তে ঝাড়তে বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বুঝলাম, বস্তা নিয়ে ঢোকার সময় দেখতে পাননি বারান্দায় বসে থাকা এই অপরিচিতকে।

পরিচয় দিতেই ডোরাকাটা টি-শার্ট আর সস্তার রংচটা জিনস পরা রাজু মাহালির ঠোঁটে খেলে গেল চিলতে ম্লান হাসি।

হ্যাঁ... এই যুবকই সেই রাজু মাহালি, যিনি প্রায় দু’বছর আগে আচমকাই জায়গা পেয়েছিলেন সংবাদ শিরোনামে। ভারত-নেপালের সীমান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া মেচি নদীর কোল ঘেঁষে নকশালবাড়ির অখ্যাত গ্রাম দক্ষিণ কাটিয়াজোটের ততোধিক অখ্যাত বাসিন্দা রাজু। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল বাংলা সফরে এসে রাজুর বাড়ির বারান্দাতে বসেই, তাঁর স্ত্রী গীতার রান্না দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, সঙ্গে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। অমিত শাহ-র সৌজন্যে, সংবাদমাধ্যমের দৌলতে, রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান ‘দলিত বিজেপি কর্মী’ রাজু মাহালি।

আরও পড়ুন: জাতীয়তাবাদ আর সুশাসনের মন্ত্র শোনালেন মোদী, বিজেপির ইস্তাহারে ফের রামমন্দির

সেই প্রসঙ্গ তুলতেই এক গাল হেসে ফেললেন রাজু। বলে উঠলেন, ‘‘আমি কিছুই জানতাম না। পাশেই থাকেন পঞ্চায়েত সদস্য সাধনা মণ্ডল। আগের দিন হঠাৎ সাধনাদি বললেন, অমিত শাহ আমার বাড়িতে খাবেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব হয়ে গেল।”

অমিত শাহ পর্বের রেশ কাটার আগেই রাজুর জন্য অপেক্ষা করছিল অন্য চমক। এ বার বাড়িতে হাজির রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব। রাতারাতি ‘বিজেপির রাজু’ সপরিবারে যোগ দিলেন তৃণমূলে। যদিও বাড়ির বারান্দায় বসে রাজু বলেন, ‘‘আমি কোনও দিন বিজেপি বা তৃণমূল কোনও পার্টিই করিনি।”

২০১৭ সালের এপ্রিল মাস। এ রাজ্যে সফরে এসে অখ্যাত দলিত রাজু মাহালির বাড়িতে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারছেন অমিত শাহ, সঙ্গে দিলীপ ঘোষ। —ফাইল চিত্র।

অমিত শাহ থেকে গৌতম দেব, ভিভিআইপিরা তাঁর দোরগোড়ায় হাজির হয়েছেন। তার পর কেটে গিয়েছে দু’বছর। কতটা বদলেছে রাজুর জীবন?

রাজুর কথায়, ‘‘অমিত শাহ আসার আগেও আমি রংমিস্ত্রির কাজ করতাম। এখনও তাই করি। মাস গেলে মেরেকেটে হাজার সাতেক রোজগার। বউ গীতা চা বাগানে পাতা তুলত, এখনও তাই করে।” তবে রাজু স্বীকার করেন, ‘‘অমিত শাহ আসার পরে একটা লাভ হয়েছে।” টিনের চাল, ইটে ঘেরা দেড় কামরার বাড়ি দেখিয়ে রাজু বলেন, ‘‘আগে আমার টিনে ঘেরা ঘর ছিল। আর একটা জিনিস পেয়েছি। রান্নার গ্যাস।’’ তবে রাজুর আক্ষেপ, গৌতমবাবু কথা দিয়েছিলেন গীতার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। চাকরিটা এখনও পায়নি গীতা।

রাজু এখনও বিশ্বাস করেন, অমিত শাহ বাড়িতে আসার জন্যই তৃণমূল তাঁকে গীতাঞ্জলি প্রকল্পের টাকায় ইটের ঘর দিয়েছে। সরকারি প্রকল্প যে অধিকার, কারও বদান্যতা নয়, তা এখনও অজানা এখানকার অনেক রাজুরই।

নকশালবাড়ি থেকে ফেরার পথে এশিয়ান হাইওয়ের পাশেই হাতিঘিষা গ্রাম পঞ্চায়েতের সাইন বোর্ড। নামটা দেখেই মনে পড়ে গেল, ২০১৪ সালে সাংসদ হওয়ার পর ওই গ্রাম পঞ্চায়েতকেই দত্তক নিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের বিদায়ী বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। জাতীয় সড়ক থেকে নেমে যাওয়া রাস্তার পাশেই গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস। পাশেই চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল শঙ্কর বড়োই, উমেশ ছেত্রীদের সঙ্গে। শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘এমপি বলেছিলেন গ্রামে ব্যাঙ্ক হবে, এটিএম বসবে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় হবে।” পাশ থেকে উমেশ বলেন, ‘‘এমপি একটা ৫০ বেডের হাসপাতাল করার কথাও দিয়েছিলেন।” না, এটিএম বসেনি এখনও। তবে এ বছরই গোড়ার দিকে বসানো হয়েছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র একটা বোর্ড। স্থানীয় বিজেপি নেতা সন্তোষ ভাণ্ডারির দাবি, হাসপাতালের জন্য জমি দেখা হয়ে গিয়েছে। আর স্কুল? গ্রামের মানুষের ভরসা স্থানীয় মিশনারি স্কুল সেন্ট ভিনসেন্ট, যেখানে শিক্ষকদের বেতনের টাকা গুনতে হয় পড়ুয়াদেরই। যদিও সন্তোষবাবুর দাবি, রাজ্য সরকারের অসহযোগিতার জন্যই, দত্তক নিয়েও কোনও কাজ করতে পারেননি সাংসদ।

নকশালবাড়ির হাতিঘিষা গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস। এই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাই ভোটে জিতে এসে দত্তক নিয়েছিলেন বিদায়ী বিজেপি সাংসদ এসএস অহলুওয়ালিয়া। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন উন্নয়নের।

এই সুরেন্দ্র সিংহকেই ২০১৪ সালে ঝুলি উপুড় করে ভোট দিয়েছিলেন পাহাড়ের তিন বিধানসভা, দার্জিলিং-কার্শিয়ং-কালিম্পং-এর মানুষ। বিজেপি সাংসদ কথা দিয়েছিলেন, পাহাড়ের মানুষের বুকে থাকা গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে নিয়ে যাবেন সংসদে। পরিসংখ্যান বলে, অহলুওয়ালিয়ার পাওয়া ৪ লাখ ৮৮ হাজার ভোটের মধ্যে প্রায় ৩ লাখই এসেছিল পাহাড়ের তিন বিধানসভা থেকে। পাহাড়ে সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকা বিমল গুরুঙ্গের নেতৃত্বধীন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (গোজমুমো) সমর্থন করেছিল বিজেপিকে। গুরুঙ্গের সমর্থন আর গোর্খাল্যান্ডের দাবি— আলুহওয়ালিয়াকে ভোট দিয়েছিলেন শিলিগুড়ি, নকশালবাড়ির বাসিন্দা গোর্খা জনগনও।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু তার পর? তিন বছরের মধ্যেই স্বপ্নভঙ্গ। কার্শিয়ঙের সোনু শেরপা বলেন, ‘‘১০৫ দিনের বন্‌ধের সময়কার অগ্নিগর্ভ পাহাড়ের ধারেকাছেও দেখা যায়নি সাংসদকে। অহলুওয়ালিয়ার নামেই এখন পাহাড়ের মানুষের অ্যালার্জি।” সেই বিদ্বেষ যে কতটা ভয়াবহ তা আঁচ পেয়েছিলেন রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিজেপি নেতারা। শিলিগুড়ির ভেনাস মোড়ে ক্যাম্প করে থাকা বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতার স্বীকারোক্তি, ‘‘এসএস অহলুওয়ালিয়াকে প্রার্থী করলে ভোটের আগেই হেরে যেতাম।” প্রশ্নটা না করে পারলাম না ওই নেতাকে। অহলুওয়ালিয়া কে? সিদ্ধান্ত তো দলের! তা হলে এর পরও দার্জিলিংয়ে জেতার স্বপ্ন দেখছেন কিসের ভিত্তিতে? মুচকি হেসে ওই নেতার জবাব, “ওটাই ভোটের অঙ্ক”।

দক্ষিণ কাটিয়াজোট গ্রামে রাজু মাহালির বাড়ি। অমিত শাহ আসার পরই রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেবে রাজুকে গীতাঞ্জলি প্রকল্পে ইটের ঘরের ব্যবস্থা করে দেন।

সমীকরণটা যে বড়ই জটিল তা টের পাওয়া যায় পাহাড়ে উঠলেই। রোহিনীর পেমা তামাং ছোটখাট দোকান চালান। ২০১৭ সালে তাঁর মুখেই শুনেছিলাম বন্‌ধে তাঁদের হাঁসফাস অবস্থার কথা। পেমার মত অনেকেই তখন চেয়েছিলেন শান্তি ফিরে আসুক পাহাড়ে। সেই পেমার কাছেই শুনলাম— ‘‘নতুন ঘর তোলার পারমিশন নিতে গিয়েছিলাম জিটিএ সভাসদ অনীত থাপার কাছে। ঘরে অনেকে বসেছিলেন। আমি অনীতকে চিনতাম না। কে অনীত, জিজ্ঞাসা করায় অনীত আমাকে বলেন, আমি কোন সাহসে পাহাড়ে থাকি!’’ লেবংয়ের বিক্রম ইয়াঞ্জনের বক্তব্য, ‘‘যে তৃণমূল সরকার আন্দোলনের সময়ে গোর্খাদের উপর গুলি চালালো, সেই তৃণমূলের ঝান্ডা ধরলেন বিনয় তামাং। এটা পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।” কথাটা যে নেহাত ফ্যালনা নয় তা স্বীকার করেন মোর্চার বিনয় গোষ্ঠীরই এক নেতা, যিনি গত কয়েক দিন ধরে তৃণমূলের প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিনয় পন্থী মোর্চা প্রার্থী অমর সিংহ রাইয়ের সঙ্গে প্রচারে থাকছেন। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের প্রতীকে দাঁড়ানোটা পাহাড়ের মানুষ পছন্দ করছেন না।” আর সেই সঙ্গেই যোগ হয়েছে, পাহাড় ছাড়া হয়ে গা ঢাকা দেওয়া বিমলের প্রায় এক বছর পর ফের আত্মপ্রকাশ। তৃণমূলের অভিযোগ, ভোটে ব্যবহার করার জন্যই বিমলকে গ্রেফতারি এড়িয়ে গা-ঢাকা দিতে সাহায্য করেছে বিজেপি। পাহাড় রাজনীতির সমস্ত সমীকরণকে উল্টে দিয়ে সেই বিমলের হাত ধরেছে ‘দুশমন’ মন ঘিসিংয়ের জিএনএলএফ। তৃণমূলের হাত ধরা বিনয় তামাংকে ‘গদ্দার’ সম্বোধন করে মন-বিমল জুটি সমর্থন জানিয়েছে বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তাকে। গোর্খাল্যান্ডের কথা বলে ফের উস্কে দিয়েছেন গোর্খা জাতির সুপ্ত স্বাভিমানকে।

আরও পড়ুন: সি-ভোটার সমীক্ষায় এগিয়ে মোদী, কিন্তু ম্যাজিক ফিগারের নীচে থাকছে এনডিএ

২০১৪ সালে জিএনএলএফের পিঠে সওয়ার হয়েই পাহাড়ে ৯০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন ভাইচুং। এক সময়ে বিমল ঘনিষ্ঠ এক যুব মোর্চার নেতার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘যত ভোট এগিয়ে আসছে, ততই পাহাড়ের আকাশে দীর্ঘ হচ্ছে বিমলের ছায়া।” চোরা স্রোত যে চওড়া হচ্ছে তার আভাস মেলে ৩ এপ্রিল শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে মোদীর সভায় বিমলের ছবি দেওয়া মোর্চার ঝান্ডা হাতে সমর্থকদের ভিড় দেখলে। ট্র্যাডিশন ভেঙে এ বার ভাগ হবে পাহাড়ের ভোট, ধরে নিয়েই তৃণমূলের বিন্নি শর্মা, রাজেন মুখিয়ার মত পাহাড়ের নেতা থেকে শুরু করে শাসক দলের দায়িত্বে থাকা ভোট ম্যানেজারদের এখন পাখির চোখ সমতলের চারটি বিধানসভা। কিন্তু সেখানেও অঙ্কটা সরল নয়। গত দশ বছর ধরে ফাঁসিদেওয়া এবং নকশালবাড়ি বিধানসভায় কংগ্রেসের দাপট। শিলিগুড়িতেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি তৃণমূল। ২০১৪ সালে তৃণমূল সমতলের চারটি বিধানসভায় পেয়েছিল ২ লাখ ভোট। বিধানসভায় সেই ভোটই বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার। অন্য দিকে বাম-কংগ্রেস মিলিয়ে গত লোকসভায় ভোট পেয়েছিল ২ লাখ ৪১ হাজার। বিধানসভায় সেটা বেড়ে দাড়ায় তিন লাখ। নকশালবাড়ির বিজেপি ব্লক সভাপতি দিলীপ বড়োই কিন্তু আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘‘এ বার বাম-কংগ্রেসের ভোটের একটা অংশ আসবে বিজেপির দিকে। কারণ অনেক মানুষই মনে করছেন, তৃণমূলকে হারাতে গেলে বিজেপিই ভরসা।” অন্য দিকে তৃণমূল শিবিরের প্রার্থনা, বিজেপি বিরোধী বাম-কং ভোট অটুট থাকুক, তা হলে পাহাড়ের অর্ধেক ভোটের সঙ্গে সমতলে দলের নিজস্ব ভোট পেলেই জেতার পথে বাধা থাকবে না। আর সেই আশাতেই বুক বেঁধে, শাসক দলের চোখ প্রাক্তন মোর্চা নেতা হরকা বাহাদুর ছেত্রীর দিকেও। তিনিও প্রার্থী। পাহাড়ে তৃণমূল বিরোধী ভোট ভাগ হলে, আখেরে লাভ শাসক দলেরই। শিলিগুড়ির এক তৃণমূল নেতার দাবি, বিজেপি নাকি বারাণসীতে মোদীর হয়ে কাজ করা পেশাদার ভোট ম্যানেজারদের এ বার এখানে মাঠে নামিয়েছে।

যুযুধান দুই শিবিরের গাণিতিক ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে কেবল মনে হচ্ছিল, নির্বাচন নিছকই অঙ্ক। সেই অঙ্কের সামনে আদর্শ, বিশ্বাস, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সবটাই বড্ড ফিকে।

ছবি: সিজার মণ্ডল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE