Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মিল খোলা সেটাই যথেষ্ট, শৌচালয় নিয়ে কে ভাবে

পাঁচ বছর পরে নিয়মমাফিক আবার এসে পড়েছে নির্বাচন। তার অবশ্য বিশেষ আঁচ পাওয়া গেল না নর্থব্রুক মিলে। ভোঁ বাজার সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা মিলের গেট পেরিয়ে ঢুকে গেলেন, তাঁরা পাঁচ বছর আগের ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ। তাঁদেরই মধ্যে এক জন জানালেন ওই মৃত্যু নিয়ে কোনও আলোচনা হয় না। মিল চলছে, এটাই বড় কথা।

দুরবস্থা: মহল্লায় নারী-পুরুষের জন্য একমাত্র শৌচালয়। নিজস্ব চিত্র

দুরবস্থা: মহল্লায় নারী-পুরুষের জন্য একমাত্র শৌচালয়। নিজস্ব চিত্র

গার্গী গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:২৫
Share: Save:

২০১৪ সালের জুন মাসের ঘটনা। লোকসভা ভোটের আঁচ তখনও পুরোপুরি নিভে যায়নি। নর্থব্রুক জুট মিলে চলছিল শ্রমিক-মালিক দড়ি টানাটানি। তারই মধ্যে ১৫ জুন বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজের অফিসের সামনেই খুন হয়ে যান মিলের সিইও হরিকুসুম মাহেশ্বরী। অভিযোগ, শ্রমিকদের একাংশের গণপ্রহারেই মৃত্যু হয় তাঁর। এর জেরে বন্ধ হয়ে যায় মিল।

এই ঘটনার দু’ সপ্তাহের মাথায় ভদ্রেশ্বর ও বৈদ্যবাটি স্টেশনের মাঝে রেললাইনে পড়ে থাকতে দেখা যায় মাঝ-চল্লিশের এক শ্রমিকের দেহ। অভিযোগ, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে হিসেবে তাঁর মাথায় চেপে বসেছিল আর্থিক দুশ্চিন্তা। কাজ না-পাওয়ার আশঙ্কায় অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। আর তার জেরেই আত্মহত্যা। অদ্ভুত ভাবে এই মৃত্যুর দিনেই নতুন করে মিল খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই দু’টি মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল সে সময়ে মিলের হাজার চারেক কর্মীর রোজকার জীবন।

পাঁচ বছর পরে নিয়মমাফিক আবার এসে পড়েছে নির্বাচন। তার অবশ্য বিশেষ আঁচ পাওয়া গেল না নর্থব্রুক মিলে। ভোঁ বাজার সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা মিলের গেট পেরিয়ে ঢুকে গেলেন, তাঁরা পাঁচ বছর আগের ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ। তাঁদেরই মধ্যে এক জন জানালেন ওই মৃত্যু নিয়ে কোনও আলোচনা হয় না। মিল চলছে, এটাই বড় কথা।

তবে কি বদলে গিয়েছে চটকল শ্রমিকদের চিরাচরিত বারোমাস্যা ?

‘‘আপকো কোই বদল দিখ রহা হ্যায়? দেখিয়ে ইয়ে শ’সাল পুরানা, টুটাফাটা টয়লেট। ইয়ে কেয়া স্বচ্ছ ভারত হ্যায়?’’ প্রশ্ন করলেন রামদুলারী দেবী। বিয়ে ইস্তক জগদ্দল জুট মিলের লাইন কোয়ার্টারে বাস করছেন। গত ২০ বছর ধরেই ওই ভাঙাচোরা, ২০ ধাপ সিঁড়ি উঁচু শৌচালয় ভরসা। নামেই স্ত্রী-পুরুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। সামান্য দরজার আব্রুও নেই। রাত-বিরেতে অসুস্থ, বয়স্ক মানুষের পক্ষে ওই শৌচালয় ব্যবহার করা আতঙ্কের বিষয় বলে সমস্বরে জানালেন পিঙ্কি সিংহ, সুহানি যাদবরা। বর্ষার সময় ওই শৌচালয়ের সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে পা ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ওয়েস্ট ঘোষপাড়া রোডের সার সার চটকলের আবাসনের অধিকাংশের চেহারা এমনই। মেঘনা, উইভারলি, গৌরীশঙ্কর, অকল্যান্ড, অ্যালায়্যান্স— সব চটকলের আবাসনেই মালিন্যের ছাপ ছড়ানো। সার দিয়ে ঘুপচি ঘর। দিনেও তেমন আলো ঢোকে না ঘরে। থাকা, খাওয়া, রান্না , সবই এক চিলতে ঘরে। আলাদা শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই। দু’পাশের ঘরের মাঝে এক ফালি গলি। তাতে দু’জন মানুষ পাশাপাশি স্বচ্ছন্দে হেঁটে যেতে পারবেন না। আবাসনের চারপাশে জমে থাকা আবর্জনা, পলেস্তারা খসে পড়া দেওয়াল, উনুনের ধোঁয়ায় পাক খাচ্ছে উদাসীনতা। নিত্যদিনের এই ছবি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই বলে মনে করেন বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এই শ্রমিকরা। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বৃন্দাবন ঝা বলেন, ‘‘মিল খোলা থাকলেই হল। পেটের ভাত জোগাড় করাই বড়। শুধু চিন্তা হয় ছেলেকে নিয়ে। ও কি আর এখানে কাজ পাবে?’’ ভোটপ্রার্থীরাও বোধহয় উদাসীন। তাই দেওয়ালে দলীয় চিহ্ন এঁকেও প্রচারের কথা
লেখা হয়নি।

বৃন্দাবন ঝায়ের মতো ভাগ্যবান নন রিলায়্যান্স মিলের আশুতোষ সিংহ। মিল বন্ধ। মিলের সাইরেন বন্ধ হওয়ার সঙ্গে বন্ধ হয়েছে বড় ছেলের পড়াশোনা। স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে কাজ করে সে। পাঁচ জনের সংসারে সেই রোজগার জরুরি বৈকি। কাজ না-থাকলেও চটকলের আবাসনে এখনও মাথা গোঁজার ঠাঁই রয়েছে। বাইরে বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো সামর্থ্য নেই। তাই যেমনই হতশ্রী, ঘুপচি ঘর হোক, তা ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।

চটশিল্পের এই সামগ্রিক দীন ছবি এখন আর ভোটের প্রচারেও ঠাঁই পায় না বলে মেনে নিচ্ছেন শ্রমিক নেতারা। সিটু নেতা অনাদি সাহুর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের মিলগুলি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে আলেকজান্ডার, কিনিসন-সহ পাঁচটি মিল। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় নীতি থাকলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে সব স্তরেই। কারখানার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রেও ঘাটতি থেকে গিয়েছে।’’ আইএনটিইউসির গণেশ সরকারও একই সুরে জানালেন, বাজার থাকলেও বিপণনে এখনও পিছিয়ে রয়েছে দেশের চটশিল্প। যে বাজার দ্রুত বাংলাদেশের দখলে চলে যাচ্ছে।

তবে কি বৃন্দাবন, আশুতোষরা আর ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে মান্যতা পান না ? দেশের ৮৯টি জুট মিলের ৬৬টি এ রাজ্যে রয়েছে। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে দু’লক্ষ মানুষ এর উপরে নির্ভরশীল। যাঁদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ দেনার দায়ে জর্জরিত। কারণ মিল খোলা ও বন্ধ হয়ে যাওয়ার বৃত্তে পড়ে সন্তানদের পড়শোনা, চিকিৎসা, মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করতে ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে যাচ্ছেন ওঁরা। এ সব নিয়ে ভোটবাবুদের হয়তো ভাবারই সময় নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 BJP TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE