বৈশাখের দগ্ধ দুপুর। রোদের তাপে যেন গলে যাচ্ছে হলদিয়াগামী ১১৬ নম্বর জাতীয় সড়ক। রাস্তায় জনপ্রাণী দূরের কথা, যানবাহনও চলছে কম। কিন্তু এই দাবদাহ উপেক্ষা করে রাস্তার ধারে ওঁরা কারা? মনে করালেন গাড়ির চালক। জায়গার নাম ব্রজলালচক। হলদিয়া ব্লক। এখানের মাইতি মোড় মাঠে তাঁর কর্মিসভা। আর সে কারণেই গরম উপেক্ষা করে দলের নেতা কর্মীদের অপেক্ষা!
ঘণ্টাখানেকের অপেক্ষার পরে পুলিশের কনভয় নিয়ে কালো স্করপিও এসে দাঁড়ালো মাঠের পাশে। মাইকে গমগমে আওয়াজ উঠল, ‘‘দিব্যেন্দু অধিকারী জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’’
প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই ব্লকে ব্লকে কর্মিসভার উপরে জোর দিয়েছেন দিব্যেন্দুবাবু। ইতিমধ্যে ডজনখানেক কর্মিসভা সেরেও ফেলেছেন। কিন্তু জনসভা বা পথসভা থেকে কর্মিসভায় জোর কেন? উত্তর মিলল ব্রজলালচকেই।
দিব্যেন্দুবাবুর উপস্থিতিতে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাঁকে লক্ষ্য করে ভিড় থেকে এক জন বলে উঠলেন, ‘‘কর্মীদের মনের কথা বলতে পারেন না। সত্যি কথা বলতে এত অসুবিধে কিসের?’’ প্রশ্নটা মঞ্চে বসা নেতাদের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। তবে এই বেসুরো মন্তব্য শুনে বাকি কর্মীরা রে রে করে তেড়ে গিয়ে কোনও রকমে থামিয়ে দিলেন প্রশ্নকর্তা শেখ হারুন নামে ওই যুবককে।
কিন্তু কী তাঁর ক্ষোভ? সভার শেষে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘‘আমি তৃণমূল করি। জানেন, আগের পঞ্চায়েত ভোটে আমি, আমার বাড়ির কেউ ভোট দিতে পারিনি। দলের লোক হয়ে কেন ভোট দিতে পারব না?’’ এমনই ক্ষোভের আঁচ মিলেছিল মেচেদার শান্তিপুরে ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে একটা হোটেল মালিকের কথায়। তিনি বলেছিলেন, ‘‘জেলা জুড়ে উন্নয়নের কাজ অনেক হয়েছে ঠিকই। কিন্তু গত পঞ্চায়েত ভোটে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দলের কর্মী-সমর্থকেরাও ভোট দিতে পারেননি। এটাই তৃণমূলের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।’’ তা হলে কাঁটা যে হতে পারে তা বুঝেই কি এত কর্মিসভা?
আরও পড়ুন- ‘গণতন্ত্রের থাপ্পড়’ মন্তব্যের নিন্দায় সুষমা, সব সীমা লঙ্ঘন করেছেন মমতা, হুঁশিয়ারি বিদেশমন্ত্রীর
আরও পড়ুন- এ এক অন্য অযোধ্যা, ভোপালের ভোটযুদ্ধে প্রজ্ঞার সঙ্গেই হিন্দুত্বের নৌকায় দিগ্বিজয়
ব্রজলালচকের সভা সেরে আরও তিনটে কর্মিসভায় যাওয়ার আগে কাঁথির অধিকারী পরিবারের সেজো ছেলে কিন্তু সরাসরি ওড়াতে পারলেন না প্রশ্নটাকে। বললেন, ‘‘এ সব ক্ষোভ মিটে যাবে। নির্বাচনের যত দিন এগিয়ে আসবে দেখবেন এ সব থাকবে না।’’
কিন্তু মানুষের এই ক্ষোভকেই অস্ত্র করে এ বার তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে লড়তে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে বিজেপি-সিপিএম। দু’পক্ষই বলছে নির্বাচকরা বুথ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে হিসেব উল্টে দেবেন।
উল্টে দেওয়া কি খুবই সহজ হবে? প্রথমত যে জেলায় শিশির অধিকারী আর শুভেন্দু অধিকারীর তৈরি বলিষ্ঠ সংগঠন। ২০১৬ সালের উপর্নিবাচনে তৃণমূলের ঝুলিতে পড়া ৫৯.৭৬ শতাংশ ভোট। সর্বোপরি জেলা জুড়ে ঢালাও উন্নয়ন কি তৃণমূলকে অনেকটাই এগিয়ে রাখেনি?
‘‘এ বার ভোটে উন্নয়নটা গৌণ। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাসে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত। এটাই মুখ্য। আমাদের কাছে প্রচারের প্লাস পয়েন্ট।’’ মন্তব্য তমলুক কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী তথা পাঁশকুড়া পূর্বের সিপিএম বিধায়ক শেখ ইব্রাহিমের। তমলুকের প্রার্থী হওয়ার পর সকাল থেকে তিনিও পরিশ্রম করছেন। প্রচারের ফাঁকে মহিষাদলের গড় কমলপুরের দলীয় অফিসে বসে বললেন, ‘‘২০১৪ লোকসভায় শুভেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে লড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছি। ২০১৬ তে ছাপ্পা ভোটে তৃণমূল জিতেছে। তা-ও আমরা দ্বিতীয় স্থানে। এ বার ৮০ শতাংশ বুথে আধা সামরিক বাহিনী থাকলে হিসেবটা উল্টে যাবে।’’
মেচেদার বুরারির একটি গেস্ট হাউসে বসে একই দাবি করলেন নবদ্বীপের বাসিন্দা বিজেপি প্রার্থী সিদ্ধার্থশেখর নস্কর। তাঁরও দাবি, যদি আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে ভোট হয়, তা হলে তৃণমূল ৫০ হাজারের বেশি ভোট পাবে না। মানুষ বিজেপি-কেই চাইছে জানিয়ে সাত জন ইনসাসধারী কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের নিরাপত্তার থাকা পেশায় কীর্তন শিল্পী বিজেপি প্রার্থীর বক্তব্য, ‘‘ভোটের আগেই যে সন্ত্রাস শুরু করেছে তৃণমূল, তা ফের পঞ্চায়েত ভোটের স্মৃতিকে উসকে দিয়েছে। সেটাই আমি প্রচারে বলছি।’’
শুধু বিরোধী দুই দল সিপিএম-বিজেপি নয়, আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে অবাধ ও শান্তির্পূণ ভোট হলে জয়ের আশার কথা শুনিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী লক্ষ্মণ শেঠ। তিনি বলছেন, ‘‘কেন্দ্রে এখন কংগ্রেসের পালে হাওয়া। সেই হাওয়া বইছে তমলুকেও। আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে নির্বাচন হলে আমি জিতছিই।’’ অবাধ ও শান্তির্পূণ ভোট হলে শাসক দলের হিসেব ওলটপালট হওয়ার দাবি করছে সব বিরোধী।
কী বলছেন ২০১৬ উপনির্বাচনে প্রায় ৫ লাখ ভোটে জেতা তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দুবাবু? ‘‘এ বার জয়ের ব্যবধান বাড়বে। সিপিএমের ভোট ভাঙছে। বিজেপি টাকা ছড়িয়ে ভোট কিনতে চাইছে। মানুষ সব জেনে গিয়েছেন।’’
প্রাক্তন সাংসদের দাবি, সাংসদ তহবিলের ৯৪.৭ শতাংশ টাকাই খরচ হয়েছে উন্নয়নে। শৌচাগার থেকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে আলো সবই হয়েছে। আগের হলদিয়ার সঙ্গে বর্তমানে আলো ঝলমল হলদিয়ার তফাৎ আকাশ-পাতাল।
এটা ঠিকই যে তমলুক থেকে নন্দীগ্রাম বা মহিষাদল থেকে ময়না সর্বত্র রাস্তা এখন ঝাঁ-চকচকে। প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজ ধানখেতের মাঝখান দিয়ে দূরান্তে হারিয়ে গিয়েছে যে পথ, সেটাও ঢালাই করা। ‘‘এই সমস্ত উন্নয়নের পিছনে যাঁর অদৃশ্য ছোঁয়া রয়েছে, তিনি আমাদের দাদা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের সভাপতি তথা রাজ্যের পরিবহণ ও পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী।’’ নন্দীগ্রামের টেঙ্গুয়া মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করেছেন এক তৃণমূল কর্মী। তা হলে ‘দিদি’র রাজ্যে ‘দাদা’ নামই কি দিব্যেন্দুবাবুর চাবিকাঠি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy