Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-west-bengal

‘ধর্মের নামে আর যেন ভাগ না হয় দেশ’

আমি জানি, দুটোই আপনাদের খুব চেনা সিন। একটা দিলীপকুমারের বিখ্যাত সিনেমা ‘গঙ্গাযমুনা’-র। আর একটি অমিতাভ বচ্চনের ‘দিওয়ার’-এর। মনে হয়, প্রথমটি থেকেই দ্বিতীয়টির ভাবনা দানা বেঁধেছিল।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০২:৫১
Share: Save:

ভারতীয় সিনেমার দু’টি দৃশ্য আজকাল আমার ক্ষণে ক্ষণে বড় মনে পড়ে। শুধু ভোট এলে নয়, সারা বছরই বলতে পারেন, ঘুরে-ফিরে নানা ঘটনার সূত্রে তাড়া করে দু’টি দৃশ্যই।

আমি জানি, দুটোই আপনাদের খুব চেনা সিন। একটা দিলীপকুমারের বিখ্যাত সিনেমা ‘গঙ্গাযমুনা’-র। আর একটি অমিতাভ বচ্চনের ‘দিওয়ার’-এর। মনে হয়, প্রথমটি থেকেই দ্বিতীয়টির ভাবনা দানা বেঁধেছিল। ছবির নায়ক সেখানে মন্দিরের ঈশ্বরের মুখোমুখি। পরবর্তী কালে এমন দৃশ্য বোধহয় সামগ্রিক ভারতীয় ছবিরই একটা পরম্পরা হয়ে উঠেছে। তখন একা-একা আয়নার সামনে এমন সংলাপ আমিও আওড়াতাম। সিনেমার নায়ক হিসেবে এমন সিন আমাকেও করতে হয়েছে।

সেই অভিজ্ঞতার সূত্রেই কিছু ভাবনা আজকাল মাথার ভিতরে জট পাকায়। ঈশ্বর তো আমাদের যে কারও একটা নিভৃত ব্যক্তিগত আশ্রয়ের জায়গা। ‘দিওয়ার’-এর অমিতাভ নাস্তিক! জীবনে মন্দিরের ছায়া মাড়ায়নি। কিন্তু বিপদে পড়ে শেষমেশ সে-ও ঈশ্বরের শরণাপন্ন। আমাদের জীবনেও তো ঠিক এমনই ঘটে। চরম অসহায় মুহূর্তে, সঙ্কটে হয়তো কোনও ভুল করে ফেলেছি, যে কথাটা মাকেও বলতে পারছি না, নিভৃত আলাপচারিতায় ঈশ্বরকে সে-কথাটা বলে ফেলি। তিনি ভগবান হতে পারেন, কিংবা আল্লা বা জিশু--- ঈশ্বরের সঙ্গে তো আদতে আমাদের এমনই একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এখানেই মনের অতল থেকে একটা প্রশ্ন উঠে আসছে। আচ্ছা বলুন তো, আমাদের দেশে ইদানীং সেই বুকের ভেতরের গোপন ঘরের ঈশ্বরের অস্তিত্ব হঠাৎ এ ভাবে ঠেলে বের করার খেলা কেন শুরু হল? দেখুন আমি কোনও দলের লোক নই। রাজনীতির ‘র’ বুঝি না। কিন্তু কেমন যেন মনে হয়, মানুষের একান্ত নিজস্ব পরিসরের সেই ঈশ্বর তিনি রাম বা রহিম যে-ই হোন, তাঁকে রাজনীতির ঘুঁটি করা হচ্ছে না তো? আমাদের দেশটা তো ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার। আলাদা করে কোনও ধর্ম নিয়েই তাতে মাথা ঘামানোর কথা নয়। তা হলে কেন এমন হচ্ছে?

আমার ছবির দর্শকদের সঙ্গে যখন দেখা হয়, কিংবা অজ পাড়াগাঁ-মফস্সলে যখন শো করতে যাই, তখন অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকা অজস্র মুখের মধ্যে আলাদা করে কোনও ধর্মের রং তো দেখতে পাই না। কার কে ঈশ্বর, সেটা আমার কাছে অবান্তর। মাদার টেরিজ়া আমাকে খুব ভালবাসতেন। কম বয়সেই আমিও চেষ্টা করতাম সাধ্যমত ওঁর সেবাকাজে যৎসামান্য সাহায্যের। আবার টালিগঞ্জে স্টুডিয়োয় ঢোকার সময়ে পাশাপাশি মন্দির আর মাজার, দু’টোর সামনেই আমি অভ্যেসবশে হাতটা মাথায় ঠেকাই। বরাবর ঠেকিয়েছি, কখনও হিসেব করিনি, এটা আর ওটা কোথায় আলাদা। তা হলে আমাদের দেশে আজকাল, কার কী ধর্ম, কার কী জাত তা নিয়ে এত বেশি মাতামাতি হচ্ছে কেন?

ভোটের সময়ে বিভিন্ন এলাকায় কানে আসে, হিসেব কষা হচ্ছে, কে কোন ধর্মের। এই ভাষাটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু ইদানীং যা দেখছি, তাতে একটা ভয় ক্রমশ দানা বাঁধছে। ধর্মের নামে, জাতের নামে, দলের নামে দেশটা আবার ভাগ হয়ে বসবে না তো! আমি আর আমার পাশের বন্ধুটি হয়তো আলাদা। আমি যেমন, একেবারেই খাদ্যরসিক নই। ফিট থাকতে অল্পস্বল্প খেলেই আমার চলে যায়। বন্ধুটি হয়তো কব্জি ডুবিয়ে মাছ-মাংস-পোলাও খেতে ভালবাসেন। তা আমাদের এই বিভিন্নতা নিয়ে তো আমরা মজা করব! কিন্তু কে কী খেল, পরল, কাকে পুজো করল, তা কেন মানুষে মানুষে বিরোধের কারণ হয়ে উঠবে? আমাদের দেশ এই ভাগাভাগির খেলায় আগে অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করেছে, এখন তাই খালি মনে হয়, অতীত থেকে আমরা কি কোনও শিক্ষা নেব না?

আমার কাছে আসল ধর্ম বলতে, কী মনে হয় জানেন, তা হল কাজ। মানুষের রুজিরুটি। আমি যেমন কাজ দিয়েই যেটুকু অর্জন করেছি, মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। বরাবরই সব দলের নেতানেত্রীরা তো কাজের জন্যই আমায় স্নেহ করেছেন। তেমনই মনে হয়, আরও অনেক মানুষ তো জীবন থেকে প্রত্যাশা নিয়েই নিজের কাজ করে চলেছেন। তাঁরা কি তাঁদের প্রাপ্যটুকু পেলেন?

কোনও কোনও দিন অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে ফুটপাতে, ফ্লাইওভারের নীচে, ঘুমন্ত মানুষদের দেখি। কেমন একটা শঙ্কার কাঁটা বেঁধে, তাঁদের ঘুমের আবেশের মধ্যে কিছুটা নিশ্চিন্তি, প্রশান্তি কি আমরা গুঁজে দিতে পেরেছি? ভারতে তো কত গরিব মানুষ! অনেকেই গ্রাসাচ্ছাদনের রুটিটুকু খুঁজে আনতে পারলে বর্তে যান। সকলেই চেষ্টা করেন, যার যেমন সাধ্য পরিবার-সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে। সকলেরই লক্ষ্য থাকে, কী করে নিজের অবস্থাটা আর একটু ভাল করা যায়! ১০০ টাকা রোজগারটুকু কী করে ১১০ টাকা করা যায়। ভোট এলে মনে হয়, এই মানুষগুলোর ভাল থাকাই তো সবার আগে আমাদের মনে আসা উচিত। কিন্তু তার বদলে এতশত ধর্মের ভাগাভাগি নিয়ে কেন চর্চা হচ্ছে?

জীবনে অনেক ছবি করেছি। অনেক প্রিয় চরিত্র। কিন্তু একটি ছবি আমাকেও ভিতর থেকে পাল্টে দিয়েছিল। ‘মনের মানুষ’! লালন ফকিরের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আমি ধৈর্য শিখেছি, অপরকে ক্ষমা করতে শিখেছি। কিছুটা হলেও মানুষ হিসেবে উন্নত হয়েছি। আর লালনের ভাবনার দর্শন আমাকেও ঋদ্ধ করেছে। সেই যে ‘জাত গেল, জাত গেল বলে এ কী আজব কারখানা, সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, শুধু দেখি তা না, না না’!

এ গান কবে লিখেছিলেন লালন! তা হলে আজ একুশ শতকের ভারতে দাঁড়িয়ে এ কথা কেন ফের মনে করতে হচ্ছে আমাদের! ২০০১-এর ভোটের আগে হরদার (হরনাথ চক্রবর্তী) ছবি ‘প্রতিবাদ’ করেছিলাম। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী এক পুলিশ অফিসার রাজনীতির দলাদলির সঙ্গে লড়ছে। আজকাল ভোট এলে অত উত্তেজনা ভাল লাগে না। খালি মনে হয়, সকলে শান্তিতে থাকুক। সক্কলকে মিনতি করি, ভোটের নামে হিংসার ফাঁদে যেন আমরা পা না-বাড়াই। আর ভাবি, ‘বম্বে-ম্যাড্রাস-কলকাতা’ নয় গোটা দেশ এক হয়ে থাকুক। মানুষে-মানুষে ভাগাভাগি, ভাঙাভাঙির কারবারটা কি এ দেশ থেকে চিরতরে মুছে যেতে পারে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE