Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

চোরাস্রোত ঠেকিয়ে বাঁধ বাঁচানোর যুদ্ধ

কী এমন ঘটল যে রাতারাতি লাস্ট বয় থেকে ফার্স্ট বয় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বিজেপি? 

ফিরোজ ইসলাম 
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০৩:১৬
Share: Save:

গত লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশের মধ্যে শতাংশের বিচারে মথুরাপুরে সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছিল বিজেপি। মাত্র ৫.২১ শতাংশ। অথচ সেই মথুরাপুরেই এ বার নির্বাচনী প্রচারে উপচে পড়ছে বিজেপির মহাতারকাদের ভিড়।

বাবুল-সুপ্রিয়, নির্মলা সীতারামন, রাজনাথ সিংহ থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী— কে নেই সেই তালিকায়। কিন্তু, কী এমন ঘটল যে রাতারাতি লাস্ট বয় থেকে ফার্স্ট বয় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বিজেপি?

পাথরপ্রতিমার মৃদঙ্গভাঙা নদীর ঘাটে বসে কথা হচ্ছিল মাছ ব্যবসায়ী অসিত ভুঁইয়ার সঙ্গে। মধ্য চল্লিশের অসিতবাবু বলছিলেন, বর্ষার আগে নদীর বাঁধ যত শক্তপোক্তই হোক না কেন, তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায় সুন্দরবন লাগোয়া অঞ্চলের মানুষদের মনে। কখন কোথায় জল ওঠে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। কিন্তু, তাই বলে ভোটের জলও কি বন্যার মতো দু’কূল ছাপিয়ে বইবে নাকি ? সাবধানী অসিতবাবু বললেন, ‘‘বাঁধ হয়তো ভাঙবে না। কিন্তু চোরাস্রোতে বাঁধের তলায় ক্ষতি হতে পারে।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এত ক্ষণ পাশে বসে আলোচনা শুনছিলেন তাঁরই পরিচিত আরও দু’জন। তাঁরা ইঙ্গিতে বললেন, এ বার নাকি বিজেপির দিকেই চোরাস্রোত। কিছু ক্ষণ পরে আড্ডা ছেড়ে উঠে পড়লেন তাঁরা। তবে, কিছুতেই নাম জানাতে চাইলেন না। অসিতবাবু অবশ্য কথা চালিয়ে গেলেন। এক সময় লগ্নি সংস্থার সচ্ছল এজেন্ট বছর ছ’য়েক ধরে কয়েক কাঠা জমিতে কিছু চাষাবাদ আর মাছের খুচরো ব্যবসা করে দিন চালান। সারদা-কাণ্ডের পর তাঁর সংস্থা উঠে না গেলেও কমিশনের হার অনেকটাই কমিয়ে দেওয়ায় মাছের ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। নোট বাতিলের জেরে সেই ব্যবসাতেও ধাক্কা খেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জমি থেকে ফসল চুরি যাওয়া এক জিনিস। কিন্ত নোনা জল ঢুকলে তো চাষই বন্ধ হয়ে যাবে। বাঁধ তাই বাঁচাতেই হবে।’’

এক নজরে মথুরাপুর

• মোট ভোটার: ১৬ লক্ষ ৫১ হাজার ৮৭
• ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী চৌধুরী মোহন জাটুয়া জয়ী হয়েছিলেন। ব্যবধান ছিল ১,৩৮,৪৩৬ ভোটের।
• ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের ফলের নিরিখে পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর, কুলপি, রায়দীঘি, মন্দিরবাজার, এবং মগরাহাট পশ্চিম— ৭টি বিধানসভার সব কটিতেই এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।

পরের গন্তব্য ওই লোকসভারই কাকদ্বীপ বিধানসভার উত্তর চন্দনপিঁড়ি গ্রাম। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উদ্বোধন করা তেভাগা আন্দোলনের শহিদ অহল্যা-বাতাসীদের স্মারকস্তম্ভের চারপাশের কংক্রিটের দেওয়াল বহুকাল হল অযত্নে ভেঙে পড়েছে। তবু ভোটের মরসুমে খোলা মাঠের প্রান্তে কয়েকটা বাঁশের লাঠিতে লাল পতাকা পতপত করে উড়তে দেখা গেল। পাশেই বড় গাছের ডাল পোঁতা। তাতে সার দিয়ে বিজেপির পতাকা লাগানো। কিছুটা এগিয়ে খোঁজ মিলল গ্রামের প্রবীণ সিপিএম সদস্য শশাঙ্ক মণ্ডলের। বছর পঁচাত্তরের শশাঙ্কবাবু পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সিপিএমের শাখা কমিটির সদস্য। উত্তর চন্দনপিঁড়ি গ্রামে তিনি ছাড়া সিপিএম সদস্য রয়েছেন আর মাত্র দু’জন। আজ পর্যন্ত সিপিএমের কোনও বিগ্রেড সমাবেশ বাদ পড়েনি তাঁর। নবান্ন অভিযানে গিয়ে পুলিশের মারও খেয়েছেন। এ বার ভোটে কী হবে জানতে চাইতেই বললেন, ‘‘বামপন্থা থেকে সরে দাঁড়াতে পারব না। অন্যদেরও বোঝাচ্ছি। কিন্তু কত দূর কী হবে বলতে পারছি না।’’

মথুরাপুর কেন্দ্রের বাম প্রার্থী শরৎচন্দ্র হালদার পেশায় চিকিৎসক। দলের স্বার্থে সাধ্যমত দৌড়চ্ছেন তিনি। কিন্তু শাসক দলের দাপটের সামনে একটা অংশের ভোটারদের যে বিজেপির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে, তা অস্বীকার করতে পারছেন না তিনিও।

রায়দিঘি, মন্দিরবাজার, কুলপির মতো কেন্দ্রে শাসক দলের পতাকার পাশে পাল্লা দিয়ে উড়ছে বিজেপির পতাকা। পরিস্থিতি বুঝেই কৌশল পাল্টেছে সিপিএম। মথুরাপুর লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র জুড়েই বড় জনসভার বদলে একাধিক ছোট সভা করে ভোট ধরে রাখতে মরিয়া বাম নেতৃত্ব। শাসক-বিরোধী সংখ্যালঘু ভোটের একাংশ পাওয়ার বিষয়েও আশাবাদী তাঁরা। তবে সেখানেও কাঁটা হয়ে রয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী কৃত্তিবাস সর্দার।

বিপরীতে শাসক শিবিরের ছবিটা কেমন? এক সময় দলের তরফে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগঠন সামলানোর দায়িত্বে থাকা শোভন চট্টোপাধ্যায় এ বারে অনুপস্থিত। তৃণমূলের নির্বাচনী কর্মিসভায় ভিড় যেমন হচ্ছে, তেমনই নেতা-কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দিন কয়েক আগে রায়দিঘিতে খোদ তৃণমূল প্রার্থী চৌধুরীমোহন জাটুয়ার সামনেই জেলা পরিষদের এক নেতাকে নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন দলীয় কর্মীরা। প্রায় পণ্ড হতে বসা সভা কোনওমতে সামাল দেন নেতৃত্ব। পরে অবশ্য ওই সভাতেই বক্তৃতা করেন তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়। এক সময়ের অভিভাবক শোভনকে ছাড়াই দলের প্রচারে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন তিনি।

তৃণমূলের লোকসভা প্রার্থী অবশ্য শোনাচ্ছেন উন্নয়নের কথা। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া সেতু, রায়দিঘিতে ইকো-টুরিজম পার্ক ছাড়াও সাগর এবং বকখালিতে সরকারি উদ্যোগে নানাবিধ উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরছেন তিনি।

এ সবের পাশে, গত লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া মাত্র সাড়ে ছেষট্টি হাজার ভোটকে কী ভাবে জেতার অঙ্কে নিয়ে যাবেন, তা জানা নেই বিজেপি প্রার্থী শ্যামাপ্রসাদ হালদারের। দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশে হাত জোড় করে হাসিমুখে জনসংযোগ করে যাচ্ছেন তৃণমূলের এক সময়ের শিক্ষক সেলের নেতা। তবে বিজেপির দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অভিজিৎ দাসের দাবি, এ বার বামেদের মতোই বিপুল ভাঙন ধরবে শাসক দলের ভোটে। যদিও চোরাস্রোতের টান কত, জানাতে পারেননি তিনিও।

মথুরাপুরের ভোটে তাই ঘুরেফিরে আসছে বাঁধ বাঁচানোর কথাই। চোরাস্রোত চিনতে সতর্ক সবাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE