Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
দান-চক্র

শুধু ভাত দিয়ো, ছাড়িয়ো না স্কুলটা

অসহায় রোগী। ত্রাতা ‘এজেন্ট’। লক্ষ লক্ষ টাকায় পাওয়া যায় ‘দাতা’। কিডনির বাজারে অনিয়ম আর প্রতারণা।এটিই একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। কিডনি বিকল হওয়ার পরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত পরিবার অসংখ্য। এক দিকে, বাজার থেকে চড়া দামে অঙ্গ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কখনও কখনও প্রতারিতও হচ্ছেন। 

—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০১
Share: Save:

মোটা বেতনের চাকুরে ছিলেন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। উচ্চবিত্ত পরিবারে যা যা থাকার কথা, ছিল সবই।

দু’টি কিডনি বিকল হতেই চিকিৎসার জন্য একে একে সব যেতে শুরু করল। সঞ্চয় ফুরোতে আত্মীয়-বন্ধুদের থেকে ধার। এক সময়ে সেটাও বন্ধ। ডাক্তার বললেন, কিডনি প্রতিস্থাপন ছা়ড়া পথ নেই। এজেন্টের মাধ্যমে ডোনারের হদিশ মিলল। ‘রেট’ উঠল ১০ লাখ ৭৫ হাজার! সঙ্গে অস্ত্রোপচারের খরচ। তার পর আজীবন প্রতি মাসে বেশ কয়েক হাজার টাকার ওষুধের সংস্থান। ফলে নিজেদের জীবনযাপন রাতারাতি বদলে ফেলা ছাড়া গতি ছিল না। একমাত্র সন্তানকে নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত হল। মেধাবী ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবাকে বলেছিল, ‘‘আমাকে শুধু ভাত দিয়ো। খেয়ে নেব। কিন্তু স্কুলটা ছাড়িয়ে দিয়ো না।’’ কিন্তু বাবা-মা নিরুপায়।

এটিই একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। কিডনি বিকল হওয়ার পরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত পরিবার অসংখ্য। এক দিকে, বাজার থেকে চড়া দামে অঙ্গ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কখনও কখনও প্রতারিতও হচ্ছেন।

কথা হচ্ছিল মাস কয়েক আগে কিডনি প্রতিস্থাপন হওয়া এক জনের সঙ্গে। কিছুতেই কিডনির ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না তিনি। ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’ অর্থাৎ ব্রেন ডেথের পরে অঙ্গ সংগ্রহ করে তা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে তামিলনাড়ু। তাই অন্য রাজ্য থেকে সেখানে যান অনেকেই। নাম লিখিয়েছিলেন তিনিও। বললেন, ‘‘তামিলনাড়ুতে ২২৪ নম্বরে ছিলাম। অত দিন অপেক্ষা করতে হলে মরেই যেতাম। অথচ এখানে দু’বার ডোনার টাকা নিয়ে অস্ত্রোপচারের আগে পালিয়ে গিয়েছিল। দালাল দায় নেয়নি। পুলিশের কাছেও যেতে পারিনি। কারণ, বেআইনি কাজ তো আমিও করছি। দালালরা এই অসহায়তার কথা জানে বলে কলার তুলে ঘুরে বেড়ায়।’’

শুধু যে রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন তা-ই নয়, কিডনি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঘটে চলেছে অন্য অপরাধও। বিভিন্ন জেলা, ভিন রাজ্য থেকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলকাতায় নিয়ে এসে কিডনি কেটে নেওয়ার একাধিক চক্রও ধরা পড়েছে রাজ্যে।

কথা হচ্ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির জন্য এসেছিলেন কলকাতায়। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য স্বাস্থ্যবান নারী-পুরুষ খোঁজা হচ্ছে। কী পদ, তা উল্লেখ ছিল না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, স্বাস্থ্যবান, বত্রিশের যুবক আবেদন করেছিলেন বক্স নম্বরে। কলকাতার একটি হোটেলে ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন চার জন। ওই যুবকের কথায়, ‘‘বাইপাসে একটা গেস্টহাউসে তোলা হয়েছিল। সেখানে আরও অনেকেই ছিলেন। দু’দিন থাকার পরে তৃতীয় দিন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয়েছিল, চাকরির শর্ত মেনে পরীক্ষানিরীক্ষা হবে।’’

ওই যুবক জানান, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। তার পরে আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পরে শুনেছিলেন, আচমকা তাঁর কিডনি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তাই বাদ দিতে হয়েছে। পুলিশে অভিযোগ জানাননি? ‘‘কিডনি কেটে নিয়েছে বুঝে যখন চেঁচামেচি করলাম, বলা হল, আমিই কিডনি বিক্রি করতে এসেছিলাম। তাই থানায় গেলে জেলে যেতাম।’’

এ ক্ষেত্রে কেউ ধরা না পড়লেও উত্তর ২৪ পরগণায় ধরা পড়েছিল কিডনি চক্রের এক পাণ্ডা আক্রাম। মাস কয়েক আগে নৈহাটিতে আক্রামের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে পুলিশ দেখে, সেখানে রয়েছেন আট জন। কেউ বিহারের, কেউ ঝাড়খণ্ডের। দু’জন ছিলেন মালদহের। সকলেই কিডনির ‘ডোনার’। তাদের দেখভালের দায়িত্বে ছিল নৈহাটি পুরসভার তৎকালীন কর্মী মহম্মদ সরফরাজ। সে জানায়, চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে কয়েক জনকে ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয়েছিল। সেখান থেকে অতি দরিদ্রদের বেছে নিয়ে চলেছে মগজ ধোলাই। যাঁরা কিডনি দিতে রাজি হননি, পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাঁদের বাধ্য করা হয়। বাইপাস লাগোয়া একটি হাসপাতালে হয়েছিল অস্ত্রোপচার।

সরফরাজকে জেরা করে সন্ধান মেলে বছর ছাব্বিশের আক্রামের। প্রথমে নিজের কিডনিই বিক্রি করেছিল সে। কালক্রমে পাচার চক্রের দালাল। বছর চারেকের মধ্যে নিজের দল, বাইপাসের একটি হাসপাতালের পিছনে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। ডোনারদের ভুয়ো পরিচয়পত্র তৈরি করতে অফিসও খুলে ফেলেছিল। ধরা পড়ায় আক্রমের চক্র না হয় বন্ধ হল, কিন্তু বাকিগুলো? কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠীর দাবি, ‘‘কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।’’ শুধু অভিযোগের জন্যই অপেক্ষা করে পুলিশ? এমন চক্রের খবর পুলিশের কাছে পৌঁছয় না? তিনি বলেন, ‘‘নজরদারি সব সময়ে থাকে।’’ তার পরেও ব্যবসার এমন রমরমা হয় কী ভাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। যেমন এত কিছুর পরেও স্বাস্থ্যকর্তা কিংবা বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠনের কর্তাদের জবাব একটাই— ‘‘তেমন কিছু তো জানি না! ’’

যাঁরা জানার, তাঁরা কিন্তু জেনে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে কয়েক জন ‘ডোনার’-এর কাছে হুমকি-ফোন গিয়েছে। হাসপাতালের কিছু কর্মীও ফোন পেয়েছেন— ‘‘এত খবর বাইরে যায় কী করে?’’

তথ্য সহায়তা-সুপ্রকাশ মণ্ডল, নীলোৎপল বিশ্বাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE