মুর্শিদাবাদে সাগরদিঘি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের রেডিয়োলজি বিভাগ। নিজস্ব চিত্র
কয়েক কিলোমিটার দূরে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিন জনকে আনা হল হাসপাতালে। মাথায় গুরুতর আঘাত। দ্রুত ট্রলি জোগাড় হল। নার্স ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। ডাক্তারবাবুও এলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে আহতদের রেফার করা হল বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে। বাড়ির লোকেরা কাতর হয়ে জানতে চাইলেন, এত বড় হাসপাতালে কেন চিকিৎসা হবে না? বহরমপুর নিয়ে যেতে যেতে তো বিপদ ঘটে যেতে পারে! ডাক্তারবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘‘এখানে আইসিইউ নেই। ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই। এমনকি, চোট কতটা গুরুতর তা বোঝার জন্য ন্যূনতম পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।’’ আবার রেডিয়োলজি বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা গেল, দরজার কাচ ঢাকা অংশটিতে খবরের কাগজ সাঁটানো। দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে নজরে পড়ল ধুলো জমা ঘরে একটি বিড়াল ঘুমোচ্ছে।
স্থান— মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল।
সম্প্রতি এমন একটি ঘটনার সাক্ষী থাকার পরে হাসপাতালের প্রশাসনিক স্তরে কথা বলার জন্য ভিতরে ঢুকলাম। জানা গেল, সুপার দীর্ঘ ছুটিতে। সহকারী সুপার ওই মুহূর্তে নেই। কার সঙ্গে কথা বলা যাবে? উপস্থিত ডাক্তার-নার্স-চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। হাসপাতাল ক্রমশ নিঃঝুম। দূর থেকে আসা ডাক্তারেরা যে যার মতো ফিরে গিয়েছেন। যাঁরা আছেন, তাঁদেরও স্থানীয়ভাবে থাকার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। ফলে তাঁদের অনেকেও কাজ সেরে দূরে ফিরে যাচ্ছেন। ইমার্জেন্সি রোগী এলে পত্রপাঠ ফেরত পাঠানোই রেওয়াজ।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বোঝা গেল, সুপার স্পেশ্যালিটি রয়েছে সুপার স্পেশ্যালিটিতেই!
প্রায় চার বছর আগে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, পরিস্থিতি তার থেকে খুব বেশি বদলায়নি। আগের বার সামনে এসেছিল, ডাক্তারের ভয়াবহ আকালের বিষয়টি। এ বারে দেখা গেল, বন্ডের কারণে ডাক্তারের সমস্যা অনেকটা মিটেছে। কিন্তু যে বিভাগের জন্য যত ডাক্তার প্রয়োজন, তা পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, আইসিইউ, আইটিইউ চালানোর পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ জায়গায় তৈরি হয়নি ব্লাড ব্যাঙ্ক। প্রসবের ব্যবস্থা থাকলেও বহু জায়গায় এখনও ‘সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট’ তৈরি হয়নি। অনেক জায়গায় এক্স রে হলেও শুধু এক্স রে প্লেটটুকুই পাওয়া যায়। রিপোর্ট পাওয়া যায় না। কারণ, রেডিয়োলজিস্ট নেই।
মোট হাসপাতাল ৪১টি
কী কী থাকার কথা
• স্নাতকোত্তর স্তরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
• আইসিইউ, আইটিইউ, ব্লাড ব্যাঙ্ক, প্যাথোলজিকাল ল্যাবরেটরি
• এক্স রে, আল্ট্রোসোনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যানের মতো পরীক্ষার ব্যবস্থা
• কার্ডিয়াক সার্জারি, নিউরো সার্জারি, এন্ডোক্রিনোলজি, গ্যাস্ট্রো সার্জারির মতো বিভাগ
কী হয়
• আউটডোর বসে
• ইন্ডোরে কিছু রোগী ভর্তি থাকেন
• পরিকল্পিত কিছু অস্ত্রোপচার হয়
• ইমার্জেন্সি রোগী এলে তৎক্ষণাৎ ফেরত পাঠানো হয়
• এমনকি প্রসবে ঝুঁকি বুঝলেও বহু ক্ষেত্রে রেফার করা হয় প্রসূতিকে
• অধিকাংশ জায়গাতেই ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরির প্রক্রিয়া সবে শুরু
তা হলে কিসের সুপার স্পেশ্যালিটি? একাধিক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে শোনা গেছে একই ধরনের হতাশার কথা। যেমন, বড়জোড়ার হাসপাতালের এক ডাক্তার বললেন, ‘‘এত বড় হাসপাতাল। সকলে ভাবেন, এখানে এলে বোধহয় সমস্ত রোগের চিকিৎসা সম্ভব। যখন আমরা তাঁদের নিজেদের অপারগতার কথা বলি, অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। ভাবেন, আমরা দায় এড়াতে চাই বলে রেফার করছি। কতগুলো সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে কতজন ডাক্তার শুধুমাত্র এই কারণে রোগীর পরিবারের হাতে মার খেয়েছেন খবর নিন। তা হলেই ছবিটা স্পষ্ট হবে।’’
প্রায় একই পরিস্থিতি পাঁশকুড়া, নন্দীগ্রাম, ছাতনা, ফালাকাটা, জলপাইগুড়ি হাসপাতালে। আগেভাগে ঠিক করে রাখা কিছু অস্ত্রোপচার হয়। ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচার হয় না। দিনে রক্তের প্রাথমিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা, এক্স রে হয়। কিন্তু রাতবিরেতে দরকার হলে কোনওটাই হয় না। প্রসবের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালেই আলট্রাসোনোগ্রাফির ব্যবস্থা নেই। সিটি স্ক্যান, এমআরআই তো
দূরের কথা।
ভোটের বাজারে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের প্রতিশ্রুতি নেতাদের কথায় ঘুরে ফিরে আসে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে সমস্ত মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার দাবিই মুখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এমন গুরুত্বপূর্ণ দিক উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
চিকিৎসকদের সংগঠন— ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের তরফে কৌশিক চাকির কথায়, ‘‘ঝাঁ চকচকে বাড়ি কিংবা দামি সরঞ্জাম নিয়ে সমস্যা নেই। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেগুলোর ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার কোথায়? সুপার স্পেশ্যালিটি বলতে যে বিভাগগুলি বোঝায়, অর্থাৎ নিউরো সার্জারি, গ্যাস্ট্রোসার্জারি, ইউরোলজি, পালমোনোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, কার্ডিয়াক সার্জারির ডাক্তারের এমনিতেই অভাব। মেডিক্যাল কলেজগুলিতেই ডাক্তার দেওয়া যাচ্ছে না, এখানে ডাক্তার কোথা থেকে দেওয়া হবে?’’
সরকারি ডাক্তারদের উচ্চশিক্ষায় সুযোগ দেওয়ার শর্ত হিসেবে অন্তত তিন বছর জেলায় কাজ করার কথা বলা হয়েছে। ৩০ লক্ষ টাকার বন্ড সই করতে হচ্ছে তাঁদের। এর ফলে সাধারণ ভাবে জেলায় ডাক্তারের আকাল কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই ম্যাজিকের মতো পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে হার্টের রোগীর চিকিৎসা করছেন মে়ডিসিন-এর ডাক্তার। স্নায়ুর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে যেতে হচ্ছে ইএনটি চিকিৎসককে।
তবু রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র দাবি করেছেন, ‘‘পরিস্থিতি এখন অনেক ভাল। আপনারাই শুধু খারাপ দেখেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy