এ বার থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি ঠিক করবে বধূ নির্যাতনের কোন অভিযোগে স্বামীকে গ্রেফতার করা হবে, কোন ক্ষেত্রে হবে না। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ ধারা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এই নির্দেশের বাস্তব দিকটি নিয়ে ইতিমধ্যেই জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, সমাজের আইনি সহায়কের কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গে সমাজসেবী, অবসরপ্রাপ্ত এবং বর্তমান অফিসারদের স্ত্রী— এঁদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। অভিযোগ হাতে পেয়ে তাঁরা খতিয়ে দেখে পুলিশের কাছে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবেন। তাঁদের সুপারিশের ভিত্তিতে ঠিক হবে, অভিযুক্ত গ্রেফতার হবে, কি না।
প্রশ্ন উঠেছে, যাঁরা এই কমিটির সদস্য হবেন, তাঁরা কি এই ধরনের তদন্ত করার যোগ্য? এক পুলিশ কর্তার মতে, ‘‘এই কমিটির সদস্যরা আইনও জানেন না, তদন্তের কায়দায় জানেন না। তা ছাড়া প্রভাবিত তো তাঁরাও হতে পারেন!’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্তা জানান, বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি বা পুলিশেরই তদন্ত করার ক্ষমতা রয়েছে। সেই ক্ষমতা সাধারণের হাতে গেলে ফল ভাল হবে না।
নিয়মিত তদন্তের কাজে যুক্ত এক পুলিশ অফিসার বলেন, ‘‘কমিটি যখন তদন্ত করবে আমাদের কাছেই সাহায্য চাইবে। আমরাই তদন্ত করব। রিপোর্ট দেবে ওই কমিটি। তফাতটা কী হবে।’’
আরও পড়ুন: প্রদীপের পাশে মমতা, প্রার্থী দিচ্ছে সিপিএমও
রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পাড়ার কমিটি যে ভাবে তৈরি হয়, সে ভাবেই এই কমিটি তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে। তাঁরা আইনের খুঁটিনাটি কিছুই জানেন না। সে ক্ষেত্রে নির্যাতিতাদের অভিযোগ যাচাই করার যোগ্যতাও তাঁদের থাকার কথা নয়। যে সব অভিযোগ জমা হয়, তার ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মহিলা সত্যিই নির্যাতিতা।’’
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান অনুরাধা কপূরের বক্তব্য, সব আইনেরই অপব্যবহার হয়। বেছে বেছে মহিলা নির্যাতনের এই আইন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল কেন? তিনি বলেন, ‘‘অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা, তা তদন্ত করবে পুলিশ-প্রশাসন। বিচার করবে আদালত। সেখানে আইন না জানা সদস্যদের নিয়ে তৈরি কমিটির ভিত্তি কী?’’
তবে, উল্টো মতও রয়েছে। শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে আইনজীবী তথা লিগাল অ্যাক্টিভিস্ট গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রেই ৪৯৮এ আইনে অযথা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের টেনে আনা হচ্ছে। এটাই আটকানোর চেষ্টা করছে শীর্ষ আদালত। এর প্রয়োজনও রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই এক মাসের মধ্যে অভিযুক্ত গা ঢাকা দিতে পারেন বা অভিযোগকারিণীর ক্ষতিও করতে পারেন। তখন কী হবে? গীতানাথবাবুর কথায়, ‘‘এই রকম যাতে না-হয় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশকে নিতে হবে।’’
৪৯৮এ-র এই আইনের অপব্যবহারের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে বিনা কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টানাটানি হয় এবং তাতে বিনা দোষে তাঁদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হয়। সেই জায়গা তাঁরা ফিরে পান না। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ বলে আমার মনে হচ্ছে।’’
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ
• প্রতিটি জেলায় তিন সদস্যের এক বা একাধিক কমিটি
• জেলার লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি কমিটি গড়বে
• কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে
• কমিটির কাজকর্ম বছরে একবার খতিয়ে দেখবেন জেলা বিচারক
• প্রতিষ্ঠিত, সমাজসেবী, অবসরপ্রাপ্ত ও গৃহবধূ কমিটিতে থাকবেন
• কমিটির সদস্যদের মামলায় সাক্ষী করা যাবে না
• বধূ নির্যাতনের অভিযোগ প্রথমে এই কমিটির কাছে পাঠাতে হবে
• কমিটি অভিযোগকারিণী ও অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে
• এক মাসের মধ্যে কমিটি পুলিশ বা আদালতে রিপোর্ট জমা দেবে
• এই রিপোর্ট পাওয়ার আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না
• এই ধরনের মামলার তদন্ত করার জন্য একজন নির্দিষ্ট পুলিশ অফিসারকে রাখতে হবে।
তবে, শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশ আপাতত পরীক্ষামূলক ভাবে চালানো হবে বলেই জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি আদর্শ কুমার গোয়েল এবং উদয় উমেশ ললিত। বলা হয়েছে, আগামী ৬ মাস এই সব নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার পরে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি ২০১৮ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে শীর্ষ আদালতকে একটি রিপোর্ট জমা দেবে। প্রয়োজনে সেই রিপোর্টে সুপ্রিম কোর্টের এই পরামর্শগুলির যুক্তিযুক্ত পরিমার্জনও করা যাবে।
প্রশ্ন উঠেছিল, নয়া এই নির্দেশের সুযোগ নিয়ে অনেক দোষী কি ছাড় পেয়ে যাবে না? শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, কোনও ক্ষেত্রে বধূর অপমৃত্যু, বা শারীরিক আঘাত গুরুতর হলে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে এই সব শর্ত আরোপিত হবে না। সে ক্ষেত্রে আইনের ধারা কড়া ভাবেই প্রয়োগ করা হবে বলেও শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিয়েছে।
অভিযুক্ত স্বামীকে গ্রেফতারের আগে প্রাথমিক তদন্ত করে দেখতে হবে তিনি কতটা দোষী। তাঁকে গ্রেফতারের আগে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার অফিসারের অনুমোদনও নিতে হবে — ২০০৮ সালে দিল্লি হাইকোর্ট এ কথা বলেছিল। তারপরেও সেই প্রবণতা কমেনি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য উদ্ধৃত করে এ বার শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, ২০১৩ সালের গোড়ায় দেশের বিভিন্ন আদালতে বধূ নির্যাতনের যে ৪ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৯টি মামলা ছিল তার মধ্যে ৮২১৮ মামলা তুলে নেওয়া হয়। ৩৮ হাজার ১৬৫টি ক্ষেত্রে বেকসুর ছাড়া পেয়ে যান অভিযুক্তরা। শুধুমাত্র ৭ হাজার ২৫৮ মামলায় সাজা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy