Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

নেত্রীর বার্তাই সার, চলছে মার-সংঘর্ষ

বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলা এবং সংযমের প্রশ্নে কড়া বার্তা দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারবার বলেছেন, ‘দলে বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করব না’।

স্টাফরুমে ভাঙচুরের পরে। ছবি: কৌশিক সাহা।

স্টাফরুমে ভাঙচুরের পরে। ছবি: কৌশিক সাহা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৫ ০৪:১৭
Share: Save:

বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলা এবং সংযমের প্রশ্নে কড়া বার্তা দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারবার বলেছেন, ‘দলে বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করব না’। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘সিন্ডিকেট বা খাদান ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তৃণমূল করা যাবে না’। কর্মীদের মনে করিয়েছেন, ‘শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বড়দের সম্মান দিতে হবে’।

তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, দলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দল, সিন্ডিকেট-খাদান ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রেষারেষি ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে দলীয় দাদাগিরি মাত্রা ছাড়াচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষকরা। সব ঘটনাতেই বারবার বিপন্ন হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি। ভোটের আগে এই পরিস্থিতিতে কার্যত বাধ্য হয়েই সাবধানবাণী দিতে হয়েছে দলনেত্রীকে। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কতটা হবে, তাই নিয়ে দলেরই বড় অংশের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। এবং সেই সন্দেহ যে অমূলক নয়, ২১শের সভার ৪৮ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই একাধিক ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে গেল।

নেত্রীর নির্দেশ-নামা অগ্রাহ্য করা শুরু হয়েছিল বুধবারই, আসানসোলে। সেখানে শিক্ষককে মারধরে নাম জড়ায় তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলরের। বুধবার রাতেই সিন্ডিকেট বিবাদকে কেন্দ্র করে কলকাতার বুকে ফের গুলির লড়াই বাধে বলে অভিযোগ। ব়ৃহস্পতিবার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের একাধিক ঘটনা ও তার মধ্যে একটিতে সেই দ্বন্দ্বের সূত্র ধরেই প্রধান শিক্ষকের মারধরের ঘট়নারও অভিযোগ এসেছে। পরিস্থিতি দেখে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু কটাক্ষ করেছেন, ‘‘উনি (মমতা) যেটা চলবে না বলছেন, বুঝতে হবে সেটা চলবে! যা বলেন, তার উল্টোটা হয়!’’ প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তৃণমূলের একাধিক নেতা মুখ খোলেননি। তবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমাদের ব্যাপার আমাদেরই সামলাতে দিন! সংবাদমাধ্যম এর মধ্যে ঢুকছে কেন?’’ তবে তিনিও সেই সঙ্গেই জুড়ছেন, ‘‘২১ জুলাই দলনেত্রী যা বার্তা দিয়েছেন, দলের সবাইকে তা কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে।’’

বড়ঞায় বেধড়ক

শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে পুলিশের উপস্থিতিতেই স্কুলের মধ্যে প্রধান শিক্ষককে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছে দলে ওই শিক্ষকের বিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সকালে মুর্শিদাবাদের বড়ঞা থানার কুলি কোলেশ ঘোষ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে স্কুল খোলার আগে কিছু ছাত্রের সঙ্গে বাইরের ছেলেদের মারপিট হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পথে নামে স্কুলের ছাত্রদের একাংশ। প্রধান শিক্ষক নিয়ত হোসেনের অভিযোগ, ওই ছাত্রদের মদত দেন তৃণমূলের বড়ঞা

উত্তর ব্লকের সভাপতি গোলাম মুর্শিদ ওরফে জর্জ এবং তাঁর অনুগামীরা। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা হলদিয়া-ফরাক্কা বাদশাহি সড়ক অবরোধ করেন। পরে তাঁরা প্রধান শিক্ষক-সহ অন্য শিক্ষকদের তালা বন্ধ করে রাখেন বলে অভিযোগ। তাঁকে বার করে কিল, চড়, লাথি, এমনকী, লাঠি দিয়েও পেটানো হয় বলে দাবি করছেন নিয়ত। তাঁর কথায়, “বড়ঞা ব্লক তৃণমূলের সভাপতি জালালউদ্দিনের নেতৃত্বে দল করি। এটা সহ্য করতে না পেরে গোলাম মুর্শিদ ও তাঁর লোকজন ছুতো খুঁজে আমাকে মারধর এবং স্কুলে ভাঙচুর করে।’’ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে গোলাম মুর্শিদ বলেন, ‘‘ঘটনাস্থলে ছিলাম না। আসলে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। সে সবের প্রতিকার না হওয়ায় এ দিন স্কুলে চড়াও হয়েছিলেন অভিভাবকেরা।’’

বড়ঞা ব্লক তৃণমূল সভাপতি জালালউদ্দিন ওই প্রধানশিক্ষককে ‘দলের লোক’ এবং তাঁর উপরে হামলায় গোলাম মুর্শিদের ‘ভূমিকা’র কথা মেনে নিয়েছেন। যদিও ঘটনাস্থলে গিয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন দাবি করেন, ‘‘জেলা তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। স্কুলের এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের যোগ নেই। ওই প্রধানশিক্ষক সিপিএমের লোক।’’ যা শুনে প্রধানশিক্ষকের প্রতিক্রিয়া, ‘‘তিন বছর আগে সাগরদিঘির বিধায়ক সুব্রত সাহার হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছি। মান্নান তো দলে এসেছেন মাত্র ছ’মাস আগে। তাঁর আমাকে চেনার কথায় নয়!’’

ঘুটিয়ারির ঘটনা

২১ জুলাইয়ের সমাবেশে যাওয়াকে ঘিরেই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়াল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি শরিফে। বাঁশড়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য সঞ্জীব ব্যাপারির উপরে দায়িত্ব ছিল ওই এলাকা থেকে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কিছু কর্মী-সমর্থক আলাদা ভাবে সমাবেশে যান। তার জেরে সঞ্জীববাবুরা ওই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কয়েক জনের বাড়ি থেকে হুক করে নেওয়া বিদ্যুতের সংযোগ খুলে দেন বলে অভিযোগ। বুধবার রাতে তাই নিয়ে মারপিটে জখম হন দু’পক্ষের ১০ জন। পুলিশ সেই ঝামেলা মেটানোর পরে, বুধবার গভীর রাতে সঞ্জীবের দাদা মনোজ ব্যাপারির (এলাকার তৃণমূল নেতা) নেতৃত্বে ফের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকেদের বাড়িতে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। গোলমাল থামাতে গেলে আক্রান্ত হয় পুলিশই। জখম হন জীবনতলা থানার ওসি সুমন দাস-সহ ছ’জন পুলিশ কর্মী। ঘটনায় পাঁচ তৃণমূল কর্মীকে ধরেছে পুলিশ। তবে মনোজ পলাতক।

জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি শৈবাল লাহিড়ীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সঞ্জীব। শৈবালবাবুর দাবি, ‘‘ঘটনার সঙ্গে দল যুক্ত নয়।’’ তবে সঞ্জীবদের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা আরাফত দেওয়ান বলেন, ‘‘কিছু কর্মী-সমর্থক আমার সঙ্গে ২১শে-র মিটিংয়ে যান। সেই আক্রোশেই হুকিংয়ের অজুহাতে হামলা হয়েছে।’’

এবং আসানসোল

বুধবার রহমানিয়া উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ঢুকে অঙ্কের শিক্ষক ওয়াজউদ্দিন জামালকে মারধরের অভিযোগ ওঠে এলাকার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর তথা ওই স্কুলেরই শিক্ষাকর্মী গোলাম সরওয়ার ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। গোলাম-সহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করেছেন ওই শিক্ষক। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কাউকে ধরা হয়নি। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের নোটিস পাঠিয়ে ডাকা হচ্ছে।’’ গ্রেফতার না করে নোটিস কেন? জবাব দেননি পুলিশ-কর্তা।

সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য ‘‘সিন্ডিকেটে জড়িত বা শিক্ষকদের উপরে হামলার দায়ে কারও বিরুদ্ধে কি তৃণমূল কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে? জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া মানে তো ব্যবস্থা নেওয়া নয়। নিচুতলার কর্মীরা বুঝে গিয়েছেন, দলনেত্রী ভাবমূর্তি বাঁচানোর জন্য মুখে বলে যাবেন আর ওঁরা যা করার, করেই যাবেন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE