Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পুলিশ ফাইল থেকে

ফাল্গুনীকে মারল কারা, ধন্দ ছ’বছরেও

সবুজ ধানজমির ধারে পড়েছিল দেহটা। সাদা চেক জামাটা রক্তে লাল। চোখ আধখোলা। বুক পকেটে গোঁজা পেন। যেটা সব সময়েই থাকত। পাশে তখনও ঘুরছে মোটরবাইকের চাকা।

বিচারের অপেক্ষায়। ফাল্গুনীবাবুর স্ত্রী  জয়াদেবী। —অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

বিচারের অপেক্ষায়। ফাল্গুনীবাবুর স্ত্রী জয়াদেবী। —অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৭
Share: Save:

সবুজ ধানজমির ধারে পড়েছিল দেহটা। সাদা চেক জামাটা রক্তে লাল। চোখ আধখোলা। বুক পকেটে গোঁজা পেন। যেটা সব সময়েই থাকত। পাশে তখনও ঘুরছে মোটরবাইকের চাকা।

সাত বছর আগের এক আষাঢ়ে শ্যামবাজার-মাজিগ্রাম রাস্তায় ধান্যরুখী গ্রামের খেড়ুয়া লালবাবা আশ্রমের কাছে ঘটে যাওয়া সেই খুনের স্মৃতি আজও বড্ড টাটকা এলাকার সিপিএম নেতা-কর্মীদের মনে। আততায়ীরা গুলি করে মেরেছিল বর্ধমান জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ, মঙ্গলকোটের দাপুটে সিপিএম নেতা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়কে। বর্ধমান তোলপাড় করে দেওয়া এই খুনের পরে সিপিএমের রোষের আগুন ছাড়খাড় করে দিয়েছিল অজয়ের দু’ধারের মানচিত্র। গ্রামছাড়া হয়ে পড়েন হাজার হাজার সিপিএম-বিরোধী। বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা দফায় দফায় এসেও খেড়ুয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি সিপিএমের বাধায়। ঘটনার ঠিক এক মাস পর, ১৫ জুলাই কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মানস ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ৯ জনের বিধায়ক দল ধান্যরুখী গ্রামে যায়। সিপিএমের তাড়া খেয়ে ধানজমি ধরে মানসবাবুদের দৌড় এখনও মনে আছে রাজ্যবাসীর।

ঘটনার দু’বছরের মধ্যেই রাজ্যে পালাবদল। মঙ্গলকোট, কেতুগ্রামের বিস্তীর্ণ চত্বরেও পতপত করে উড়তে থাকে ঘাসফুলের পতাকা। ধান্যরুখী অবশ্য তৃণমূলের প্রবল দাপটের মধ্যেও সিপিএমের পাশে থেকেছে। ২০১৩ সালে গোটা মঙ্গলকোট-সহ বর্ধমানে সিপিএম কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও স্রেফ ফাল্গুনীবাবুর নামে ভর করেই এই ধান্যরুখী সংসদ থেকে জিতেছিলেন সিপিএমেরই প্রার্থী। পরে যদিও তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।

তবে, সব কিছু ছাপিয়ে ছ’বছর পরেও এক ধাঁধা হিসাবেই রয়েছে ফাল্গুনীবাবুর মৃত্যু। কারা তাঁকে মারল, কী মোটিভ— কিছুই জানা যায়নি। পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ঘটনার পরেই নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে কোঁয়ারপুর গ্রামের সিপিএম নেতা শিবকুমার দে পুলিশের কাছে এফআইআরে মাজিগ্রামের তৃণমূল নেতা বিকাশ চৌধুরী-সহ ১১ জনের নাম লিখেছিলেন। মারা যাওয়ার আগে খুনি হিসাবে ‘দেবু, ফুচু ও ভুটু’র নাম ফাল্গুনীবাবু তাঁর কাছেই করেছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি। ওই তিন জন এখন জামিনে ছাড়া। গ্রেফতারের ৮৯ দিনের মাথায় কাটোয়ার এসিজেএমের কাছে চার্জশিট জমা দেন মঙ্গলকোটের ওসি জ্ঞানপ্রসাদ সাউ।

২০০৯ সালের ১৫ জুন খেরুয়া-লালবাবা আশ্রমের কাছে খুন হন মঙ্গলকোটের সিপিএম নেতা ফাল্গুনী মনুখোপাধ্যায়।

খুনের বদলায় পোড়ানো হয় বিরোধীদের শ’য়ে শ’য়ে বাড়ি।

তৃণমূল নেতা বিকাশ চৌধুরী-সহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট।

পুলিশের ভূমিকায় নানা প্রশ্ন।

জ্ঞানপ্রসাদবাবুর আগে এই ঘটনার তদন্ত করেছেন আজাদ হোসেন ও সুখময় চক্রবর্তী নামে দুই পুলিশ অফিসার। দু’জনেই মঙ্গলকোটের ওসি ছিলেন। কিন্তু উত্তপ্ত মঙ্গলকোটকে শান্ত করতে পারেননি বলে ১৫ দিনের মাথায় তাঁদের বদলি হয়ে যেতে হয়। ওই চার্জশিটে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে পুলিশ। এর মধ্যে তিন জনের বিরুদ্ধে সরাসরি খুন ও অস্ত্র আইনে অভিযোগ আনা হয়। বাকিদের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে পুলিশ। কিন্তু তার পরেও জামিন পেয়ে যান সবাই। প্রত্যক্ষদর্শী শিবপ্রসাদবাবুও পরে আদালতে তিনি জনান, ঘটনার কিছুই মনে নেই তাঁর। তার জেরে তাঁকে সিপিএম দল থেকে বহিষ্কারও করে।

ফাল্গুনী-জায়া জবাদেবীর কথায়, ‘‘ও এত জনপ্রিয় ছিল। রাজনীতি করতে গিয়ে খুন হবে, কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবিনি। মৃত্যুটাও কেমন যেন রহস্যের মধ্যেই থেকে গেল।” সে সময় ফাল্গুনীবাবুর একমাত্র সন্তান তৃষা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। এখন কাটোয়া কলেজের বাংলা অনার্সে ছাত্রী তৃষাও মনে করেন, রহস্যের কিনারা করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। আর দল? এই পরিবারের ‘অভিভাবক’, সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিকের দাবি, “পুলিশ কোনও তদন্তই করেনি।”

আইনজীবীরা জানান, হেলমেট, মোটরবাইক থেকে নিহতের জামা, রক্তমাখা মাটি বাজেয়াপ্ত করলেও ফরেন্সিক রিপোর্টের জন্য পাঠাননি তদন্তকারী অফিসার। আবার পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র বা গুলি উদ্ধার করতে পারেনি। ফাঁকা কার্তুজ পেলেও ব্যালেস্টিক রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। এই মামলায় ২২ জন সাক্ষী রয়েছেন, তার মধ্যে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মারা গিয়েছেন। পুলিশের সাক্ষী এখনও দায়রা আদালতে হয়নি।

সেই সময়ের জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “মঙ্গলকোটকে শান্ত করতে গিয়েই পুলিশের সময় পার। তার উপর এক মাসের মধ্যে চার ওসি বদল। ফলে তদন্তে ঢিলেমি হয়েছে, এটা মানতে তো অসুবিধা নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE