—ফাইল চিত্র।
৩৫ বছর আগে রাজ্যের স্কুলগুলির প্রাথমিক স্তর থেকে পাশ-ফেল তুলে দিয়েছিল জ্যোতি বসুর সরকার। মনমোহন সিংহের ইউপিএ-২ সরকারের শিক্ষার অধিকার আইনের সৌজন্যে সেই ছাড়ের আওতা বেড়ে হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। এ বার কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর এক চিঠির উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জানিয়ে দিল, তারা নীতিগত ভাবে পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনারই পক্ষে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় শনিবার বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার চায়, প্রথম শ্রেণি থেকেই ফের পাশ-ফেল ব্যবস্থা কার্যকর হোক।’’
পাশ-ফেল প্রথা নিয়ে ইতিমধ্যেই সমস্ত রাজ্যের মতামত চেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। তাঁর চিঠির উত্তরে পুজোর ঠিক আগে রাজ্যের মত জানিয়ে দিয়েছেন পার্থবাবু। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার যে নীতিগত ভাবে পাশ-ফেল ব্যবস্থার পক্ষে, সে কথাই কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে।’’ কিন্তু রাজ্য কোন শ্রেণি থেকে পাশ-ফেল ফেরানোর পক্ষে, কেন্দ্রকে লেখা চিঠিতে তা জানানো হয়নি বলেই শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর। শিক্ষামন্ত্রীর কথায়, ‘‘এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ভাবনা এখনও রাজ্যকে জানায়নি। সেটা জানতে চেয়ে শীঘ্রই চিঠি দেওয়া হবে। কেন্দ্র তাদের পরিকল্পনা জানানোর পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে রাজ্যের চূড়ান্ত অবস্থান জানাবেন।’’ যদিও সেই অবস্থান পার্থবাবু এ দিন এক রকম স্পষ্ট করেই দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আরও কুড়িটি রাজ্য ইতিমধ্যেই পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছে। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রের খবর, চলতি বছরের শেষে নতুন শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার কথা। দেশের বেশির ভাগ রাজ্যই যে ভাবে পাশ-ফেল ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিচ্ছে, কেন্দ্রের পক্ষে তাকে উপেক্ষা করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে পাশ-ফেলের পুরনো নিয়মে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। তবে তা করতে হলে ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনের সংশোধন প্রয়োজন।
বিশিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই রাজ্যের অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে সিপিএম এখনও প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথার বিরোধী। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার বছর তিনেক পরে ১৯৮০ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি এবং পাশ-ফেল ব্যবস্থাকে যুগপৎ বিদায় জানিয়েছিল। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিনও বলেন, ‘‘দলের নীতিগত অবস্থান পাশ-ফেল প্রথার বিরুদ্ধে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর কোনও বদল দরকার কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন গণ সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আলাপ-আলোচনা করছেন।’’ সর্বশেষ বামফ্রন্ট সরকারের স্কুলশিক্ষা মন্ত্রী পার্থ দে অবশ্য সরাসরি বলেছেন, ‘‘আমরা মনে করি পাশ-ফেল প্রথা জনবিরোধী।’’
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের প্রাথমিকে ইংরেজি এবং পাশ-ফেল তুলে দেওয়া নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক ছিল। একই রকম মতান্তর দেখা দেয় ইউপিএ-২ সরকারের আমলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়া নিয়ে। ২০০৯ সালে সংসদে পাশ হওয়া শিক্ষার অধিকার আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা রদ হয়। ২০১০ সাল থেকে তা কার্যকর হতে শুরু করে। এ রাজ্যে এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল ২০১২ সালে। অনেকেই তখন বলেছিলেন, যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা না করেই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার। এতে মানের সঙ্গে আপস হবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন তাঁরা।
বাস্তবে হলও তা-ই। একের পর এক রাজ্যের কাছ থেকে নয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকায় ২০১৩ সালে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য হরিয়ানার তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী গীতা ভোক্কলের নেতৃত্বে কমিটি গড়ে কেন্দ্র। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রে খবর, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সেই কমিটি প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ-ফেল ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছিল। কমিটির মত ছিল, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল না থাকার বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায়।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে পালাবদল হয়। গীতা ভোক্কল কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্পষ্ট করে রাজ্যগুলির মত জেনে নিতে উদ্যোগী হয় নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই নিয়ে মত জানতে চেয়ে রাজ্যগুলিকে চিঠি দিতে শুরু করে স্মৃতি ইরানির মন্ত্রক। সেই সূত্রেই মমতা সরকার জানিয়েছে, তারা পাশ-ফেল ফেরাতে নীতিগত ভাবে সম্মত।
রাজ্যের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেন, ‘‘রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা, তার পরিকাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত মূল্যায়নের জন্যে পাশ-ফেল প্রথা অবশ্যই প্রয়োজন। কোনও কিছুর উন্নতির জন্যে উপযুক্ত মূল্যায়ন দরকার।’’ প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার ফলে শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে। রাজ্য সরকার পাশ-ফেল ফেরানোর পক্ষে যে মত দিয়েছে তা সমর্থনযোগ্য।’’ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘শিক্ষা সম্পর্কে চেতনার পাশাপাশি তার মান নিয়েও চাহিদা বেড়েছে। সেই প্রেক্ষিতে পাশ-ফেল ব্যবস্থাটা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন রয়েছে।’’
তবে প্রবীণ ওই শিক্ষকের মতে, কেবল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ফেরালেই যে শিক্ষার উন্নতি হয়ে যাবে, এমন মনে করার কারণ নেই। তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক এবং অন্য পরিকাঠামোর জোগান দিতে হবে।
রাজ্যে পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছে সেভ এডুকেশন কমিটি। কমিটির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক সাহা মনে করেন, কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের মত জানানোই যথেষ্ট নয়। অবিলম্বে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। এই দাবিতে আগামী ২৩ নভেম্বর দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্নায় বসবেন কমিটির সদস্যরা। পরে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে দাবিপত্রও দেবেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy