গানের জগতে কুড়ি বছর পার হয়ে গেল। এখন অনেকে মনে করছেন রূপঙ্করের মাঠে নেমে ক্যাপ্টেন্সিটা করা উচিত...
মানে বুঝলাম না।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির রানরেট তো শূন্যতে ঠেকেছে। এ বার অন্তত মাঠে নামুন।
দেখুন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির রানরেট বাড়াতে গেলে একটা টিমের প্রয়োজন। আমি একা কিছু করতে পারব না।
আপনার মতো সকলেই এমনটা ভেবে নিজেরা ফিল্মের গান গাইছেন আর শো করে বেড়াচ্ছেন। একজন সিনিয়র হিসেবে গানের বাজারটাকে ঠিক করার কি কোনও দায়িত্ব নেই আপনার?
আপনি বিষয়টা বুঝতে চাইছেন না কেন বলুন তো! আরে আমি কি শ্রীকান্তদা, রাঘব বা লোপাদিকে পরামর্শ দিতে যাব? আর দিলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে?
কিন্তু অনুপম, সোমলতা বা নিদেন পক্ষে অন্বেষাকে তো পরামর্শ দিতে পারেন?
‘পিকু’তে অনুপমের ‘বেজুবাঁ’ গানটা শুনে মনে হল ও আবার রেওয়াজে মন দিয়েছে। খ্যাতির স্রোতে গা না ভাসিয়ে ও যেন নিজের গানে মন দেয়।
আর সোমলতা?
সকলের সঙ্গে সহজে মেশা উচিত সোমলতার। আর অন্বেষাকে বেরিয়ে আসতে হবে শ্রেয়ার গায়কি থেকে।
ব্যস, তা হলেই গানের বাজারে মন্দা ঘুচবে বলে মনে হয়?
না, আর্টিস্টদের একজোট হতে হবে। ফোরাম তৈরি করতে হবে।
কলকাতায় ধরা যাক গানের অনুষ্ঠান করার জন্য আমি দশ টাকা নিই। আর দিল্লিতে কুড়ি টাকা। এখন অন্য একজন শিল্পী পনেরো টাকাতেই দিল্লিতে শো করতে রাজি হয়ে গেল। আমার বাজারটা ডুবল। ফোরাম থাকলে এটা কখনওই হত না। ভাবুন তো কলকাতায় গানের সিডি বিক্রির দোকানে কফি বিক্রি হচ্ছে। তাও আমরা আর্টিস্টরা চুপচাপ বসে আছি কিছু না করে।
কিন্তু এখন পাবলিক শো কমে গিয়েছে...
দেখুন, আগে কখনও বলিনি এটা... অনেকেরই মতো শুনতেও খারাপ লাগবে। বরাবরই গানের অনুষ্ঠানের টাকা এসেছে কিন্তু কালোবাজার থেকে। আগে পাড়ায় পাড়ায় যে সব জলসা হত, নামীদামি গুন্ডারা সব আয়োজন করতেন। এখন তা করে চিট ফান্ড। সারদা, রোজভ্যালি সবই তো শেষ। অনুষ্ঠান হবে কোথা থেকে?
‘অ্যাপস’ বলে তো শিল্পীদের একটা সংগঠন ছিল।
আমি ‘অ্যাপস’-এর আশাবাদী নই। আমরা যে যার আখের গোছাতেই ব্যস্ত। তাই লোকে অ্যালবাম করছে। অনুষ্ঠান করছে।
আপনিও তো লোকসঙ্গীতের অ্যালবাম করছেন। বেশ কিছু দিন আগেও দেখেছি ‘আত্মা’ ব্যান্ডের সঙ্গে গান গাইছেন। সেটার কী হল?
‘আত্মা’তে একসঙ্গে গান গাইতে গিয়ে দেখলাম ওখানে লোক ‘বৌদিমণির কাগজওয়ালা’ বা ‘গভীরে যাও’ শুনতে চাইছে। আমারও মনে হল আমাকেই যদি লোকে আলাদা করে শুনতে চায়, তা হলে আমি আলাদাই গাই।
আচ্ছা, পাব-এ বাজতে পারে আপনার এই অ্যালবাম?
কেন বাজবে না? মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট শুনলেই বুঝতে পারবেন।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী আপনি। আপনার গান বহু লোকের কলার টিউন। মনে হয় না কলকাতা তো অনেক হল, এ বার মুম্বই যাই?
বিশ্বাস করুন, একটুও মনে হয় না।
কী বলছেন? মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরাও মুম্বই গিয়ে স্ট্রাগল করেছেন...
দেখুন কলকাতা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
ছেড়ে যেতে কে বলেছে? যাতায়াত করবেন। গিয়ে তো দেখুন...
যাতায়াত করলে হবে না। শান্তনুদা (মৈত্র) বলেছিলেন মুম্বইতে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সেখানে থেকে যেতে হবে। সে আমি পারব না। মুম্বইয়ের লোকজন যেমন স্মার্ট, কথায় কথায় যে রকম পোশাক পাল্টায়, পার্টি করে, ওগুলো জাস্ট আমার দ্বারা হবে না। আমি ভেতো বাঙালি।
আচ্ছা, তাতে যদি আপনার গানের মেয়াদ কমে যায়?
দেখুন, মুম্বইতে সোনু নিগম, শান-রাও কি চুটিয়ে ফিল্মের গান গাইতে পারছেন? উল্টে টাকা রোজগার করে নিয়ে যাচ্ছে ওই ট্র্যাশ-টা... কী যেন আতিফ আসলাম...
অরিজিৎ সিংহ তো ভাল কাজ করছেন।
হ্যাঁ, ও তো নম্বর ওয়ান। খুব ভাল গাইছে। প্রচুর টাকা রোজগার করছে। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সুরে ‘অপুর পাঁচালী’তে ওর একটা গান শুনে বুঝতে পেরেছিলাম ও কী জাতের শিল্পী। কিন্তু এখন খুব রিদমে যে সব গান গাইছে, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সেগুলো কি ওর ভাল লাগছে! অরিজিতের একটা গান শুনে আমার বৌ সে দিন বলছিল, ‘এটা কি অঙ্কিত তিওয়ারি গাইছে?’ আমি বললাম না, অরিজিৎ। আবার অঙ্কিত তিওয়ারির গান শুনে মনে হচ্ছে অরিজিৎ গাইছে।
কেন এমন মনে হচ্ছে বলুন তো?
এখন সব রেকর্ডিংই হাই পিচ-এ হয়। আমাকে এখানকার সঙ্গীত পরিচালকেরা বাধ্য করেন হাই পিচ-এ গান গাইতে। উফ, আমার যে কী
কষ্ট হয়!
রূপঙ্করের মতো শিল্পীকে সঙ্গীত পরিচালকেরা বাধ্য করেন, এটা মানতে হবে?
আমি যদি ওই মুহূর্তে চড়া পর্দায় গানটা গাইব না বলি, তো তীর্থঙ্কর, শুভঙ্কর এসে গেয়ে দেবে। ঘাড়ের কাছেই লম্বা লাইন। আনন্দবাজারে এই সাক্ষাৎকারটা বেরোলে হয়তো লোকে বলবে হ্যাঁ, রূপঙ্কর শিল্পী। কিন্তু শিল্পী বলে এখন আলাদা করে কেউ পাত্তা দেয় না। মোহিত চহ্বণের মতো শিল্পীকেও সারাক্ষণ টেনশন করতে দেখেছি। এই বুঝি ওর গান অন্য কেউ গেয়ে দিল।
আপনার গান কখনও কেড়ে নেওয়া হয়েছে?
‘একটি তারার খোঁজ’, ‘বুনোহাঁস’য়ে আমার গান গাওয়া হয়নি।
কবীর সুমনের সঙ্গে ঝামেলা মিটেছে?
কুড়ি বছর ধরে দেখছি ওঁকে। উনি আমায় আদরও করতে পারেন, আবার পরক্ষণেই চড়ও মারতে পারেন। সেটা জেনেই ‘জাতিস্মর’-এ গান গাইতে গিয়েছি।
নচিকেতাকে কি নকল করতেন?
প্রথম দিকে খুব ফলো করতাম। সেটা বুঝতে পেরেই ওঁর গায়কি থেকে বেরিয়ে এসেছি।
আপনি তো বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা। কিন্তু আজও নাকি বিয়ের প্রস্তাব পান?
ওরে বাবা, একটি মেয়ে তো বাবা-মা সবাইকে নিয়ে শিয়ালদহের রাস্তায় আমার গাড়ি আটকে বলেছিল তুমি সত্যিই আমায় বিয়ে করবে না? পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল।
মানে রূপঙ্করের জীবনে আর প্রেম নেই?
জীবনে তিনটে প্রেম আমার। দিদিমা, মা, স্ত্রী।
বেশ বোরিং ব্যাপার। প্রসঙ্গ পাল্টাই। ফিল্মের গানেও ইদানীং রূপঙ্করের হিট নেই। কেন?
ছবি হিট না হলে গান যত ভালই হোক, হিট হয় না। এখন অস্থির সময়। অনুষ্ঠানে লোকে চিৎকার করে বলছে গুরু, ‘চোখের তারায় আয়না ধরো’ গানটা হোক। ওমা, গানটা গাইতে শুরু করলাম, দু’লাইন শোনার পর দেখছি লোকে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক করছে। ফোন করছে। দু’লাইনের বেশি কেউ আজকাল আর গান শোনে না। আর ফিল্মের গান হিট করতে হলে নামকরা পরিচালক দরকার।
মানে বলতে চাইছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে দরকার। তাই তো?
সৃজিত গানগুলো খুব যত্ন করে শ্যুট করে। তবে বড় ব্যানার, নামী প্রযোজকেরও দরকার হয়। তবে গানটা ছড়ায়।
ছবির গান বাদ দিয়ে রূপঙ্করের গান তবে ছড়াবে কী করে? আপনি তো ইন্ট্রোভার্ট...
সত্যি আমি ঘরকুনো। নিজের জন্য খারাপও লাগে। মন খারাপ হলে আরও বেশি করে গিটার বাজাই। ইউটিউবে নোরা জোনস শুনি। আবার গানে ফিরে আসি। তবে আমি জানি আমার মেয়াদ বড়জোর ছ’থেকে সাত বছর। যে টাকা জমেছে, বাদবাকি জীবনটা ওতেই চলে যাবে। তখন নতুনরা গাইবে আর আমরা পুরনোরা নতুনদের গালাগালি দেব। বলব নতুনরা কিছু গাইতে পারে না। রাস্তায় রাস্তায় ফ্রাস্ট্রেট্রেড হয়ে ঘুরে বেড়াব আর অবাক হব। বলব, আমি রূপঙ্কর, লোকে আমায় চিনছে না কেন...
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy