Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চৌকাঠ পেরিয়ে জীবনের জলছবি

নেহাত কমার্শিয়াল শো, ফিল্ম প্রদর্শনী নয়। তাই উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে পারিনি। বহু বহু দিন পর বাংলায় এক যথার্থ ডিরেক্টর্স ফিল্ম; অন্যান্য গুণাগুণ তো আছেই, কিন্তু প্রতিটি দৃশ্যায়ন, দৃশ্যের চলন, দৃশ্য ভাবনার মধ্যে দিয়ে এক পরিচালক কথা বলছেন।

লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

নেহাত কমার্শিয়াল শো, ফিল্ম প্রদর্শনী নয়। তাই উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে পারিনি। বহু বহু দিন পর বাংলায় এক যথার্থ ডিরেক্টর্স ফিল্ম; অন্যান্য গুণাগুণ তো আছেই, কিন্তু প্রতিটি দৃশ্যায়ন, দৃশ্যের চলন, দৃশ্য ভাবনার মধ্যে দিয়ে এক পরিচালক কথা বলছেন।

রাজা দাশগুপ্ত। যাঁর পিতা হরিসাধন দাশগুপ্তের তৈরি তথ্যচিত্রের অনুরাগী ছিলাম আমরা। রাজার ‘চৌকাঠ’ ছবির মধ্যে কাহিনির সঙ্গে একটা তথ্য চিত্রায়নের রসায়ন মিশেছে।

রাজা ওঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রে আরও এক মহাপরিচালকের প্রথম সাড়াজাগানো ছবির কথা মনে পড়িয়ে দিলেন। রোমান পোলানস্কির ‘নাইফ ইন দ্য ওয়াটার’।

কারণ দুই ছবির কেন্দ্রেই সন্দেহের ঘুণ পোকা।

বেশি মদ্যপান করে নায়ক বাবুয়া (ডাকনাম) বউ দেবলীনাকে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরতে ফিরতে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে বসল। তাতে দেবলীনা ছিটকে রাস্তায় পড়ল। বাবুয়া নিজে রক্তারক্তি হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল স্টিয়ারিংয়ের ওপর।

পরদিন ভোরে বাবুয়াকে মূর্ছাগ্রস্ত অবস্থায় খুঁজে পেল এক নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক কণিকা। এবং নিজের গাড়িতে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিল। সে সময় দেবলীনা কোথাও নেই, রাস্তাতেও নয়।

বলা বাহুল্য টিভি চ্যানেলে এ খবর উঠতে সময় নিল না। এবং যথারীতি নতুন নতুন প্রশ্ন গজালো সময়ের সঙ্গে। দেবলীনা হাসপাতাল থেকে ফিরেছিল হুঁশ ও বেহুঁশ, স্মৃতি ও বিস্মৃতির মধ্যে ভাসতে ভাসতে। দুর্ঘটনার পরের ঘটনাবলির কোনও গ্রহণযোগ্য বিবরণ সে দিতে পারেনি। অচিরাৎ একটা মুচমুচে স্ক্যান্ডালও চড়তে লাগল টিভিতে, পল্লিতে এবং পরিবারে। এবং, হায়, স্বয়ং স্বামী বাবুয়ার উদার (!) বুদ্ধিজীবী (!) মনেও সন্দেহের বিষফণা চড়তে থাকল: দেবলীনাকে কে বা কারা বাঁচাল? বাঁচিয়ে...? ওকে কি কেউ ছোঁয়নি? মানে রেপ হওয়া কি সম্ভব ছিল না?

‘চৌকাঠ’-য়ে মস্ত অবদান কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপের দায়িত্বে থাকা পারমিতা ঘোষ মজুমদারের। কিছু আউটডোর ছাড়া সামান্য কিছু চরিত্র নিয়ে মূলত ঘরোয়া পরিবেশের এই চিত্রনাট্য অপূর্ব সব অভিনয়ের পরিসর তৈরি করেছে।

দেবলীনা চরিত্রে শ্রীলেখা মিত্রের জীবনের সেরা অভিনয় তো বটেই। নায়িকার ভূমিকায় এহেন অভিনয় ইদানীং কালে খুব একটা দেখেছি কি? উনি অভিনয় করেননি, সঙ্কট, সঙ্কল্প, চোখের জল ও হতাশার মুহূর্তগুলোয় শুধু দেবলীনার জীবনযাপন করেছেন।

এরকমই এক জীবনকৃতি অভিনয় রণজয়ের (বাবুয়ার ভাল নাম) বাবা শরদিন্দুর রোলে অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কী মার্জিত পরিশীলিত সংলাপ, উচ্চারণ ও মনোভাব প্রকাশ! ছবির চোখের জলের দোলাচলটা মূলত শ্বশুর এবং পুত্রবধূর মধ্যে। খুব স্বাভাবিক এবং অনুভূতি ঋদ্ধ অভিনয় দেবলীনার বান্ধবী শ্রেয়সীরূপী বিদীপ্তা চক্রবর্তীর। এবং হ্যাঁ, স্বামী বাবুয়া হিসেবে টোটা রায় চৌধুরীর। চমৎকার।

টোটা নায়কের ভূমিকায়, কিন্তু নায়কের যা মনস্তত্ত্ব, তাতে দর্শকের তাঁর প্রতি বিরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা হালকা ফ্রেমের চশমার কাচের ভেতর দিয়ে ওঁর চোখ সর্বক্ষণ একটা বিপন্নতা তুলে ধরে।

‘চৌকাঠ’য়ের সব অভিনয়ই ভারী নিটোল, তাই গোটা ছবিটাকে জীবনের জলছবি করে তোলে গল্প যত গড়ায়।

সৌমিক হালদারের এমন চিত্রগ্রহণ যে মনেই হয় না দৃশ্যগুলো তোলা হয়েছে। কেবল যেন দেখা গিয়েছে, এই যা। এতটাই সুপ্রবহ, এবং নিজেকে জানতে- না-দেওয়া।

‘চৌকাঠ’য়ের মস্ত তুরুপের তাস গান। কোনও চরিত্রই কিছু গাইছে না, শুধু গান ভেসে আসছে হাওয়ার মতো। আশ্চর্য, সেই গানে ভেসে আসছেন অতি অমর জর্জ বিশ্বাস। যখন গাইছেন, ‘‘কাছে থেকে দূর রচিলে’ এবং ‘কোন গহন অরণ্যে’!

আর রাজা ইস্কাবনের টেক্কাটা ফেলেছেন শেষ দৃশ্যে। ফের গাড়িতে নায়ক-নায়িকা পাশাপাশি বসে, মাঝখানে কত নিরুত্তর প্রশ্ন। না ভেবে উপায় নেই রাজা অভিবাদন জানাচ্ছেন পোলানস্কি-র ‘নাইফ ইন দ্য ওয়াটার’য়ের শেষ দৃশ্যকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE