মান্না দে
মুম্বইর ফ্লাইট খানিক বাদে ল্যান্ড করবে কলকাতা এয়ারপোর্টে। অতিথিদের রিসিভ করার জন্য অনেকের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন দেবাশিস বসু। আর উত্তেজনাটা একটু অন্য রকম, সবার থেকে বেশি। এই প্রথম আলাপ হবে তার স্বপ্নের গায়ক মান্না দে-র সঙ্গে। শুধু আলাপ নয়, এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বও তার, মান্না দে-র সঙ্গে প্রথম। বেশ টেনশনের ব্যাপার বৈকি।
দুর্গাপুরে বেশ বড় অনুষ্ঠান। বেশ বড় টিম নিয়ে আসছেন মান্নাদা। মান্নাদা-র সঙ্গে ফিমেল ভয়েসে গাইবেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। দীনেশ হিঙ্গ তো থাকবেনই। দারুণ কমেডি করেন। অনুষ্ঠানে আর একটি দারুণ চমক আছে। গজল গাইবেন উমা দেবী। সবার অত্যন্ত প্রিয়, জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ঠিক ভাবে বলতে গেলে কমেডিয়ান হিসেবে। আমরা তাকে টুনটুন নামেই চিনি। অসাধারণ গজল গাইতেন উমা দেবী নামে। মান্নাদার সঙ্গে দেশ-বিদেশে বহু অনুষ্ঠান করেছেন। মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় পারিবারিক বন্ধু। সব মিলিয়ে বিশাল টিম। এখান থেকে চৌহানের বড় বাসে করে সরাসরি দুর্গাপুর। যেতে যেতে মান্নাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়। ‘কী ভাবে অনুষ্ঠান শুরু করার কথা ভাবছেন?’ সবাই জানেন হোম-ওয়ার্ক ঠিক মতো করা না থাকলে মান্নাদার সঙ্গে কাজ করা খুব কঠিন। তিনি তাকে অ্যালাউই করবেন না। দেবাশিস যেমন ভেবে রেখেছিল, বলল সে কথা—ভেবেছি এ ভাবে শুরু করব—‘একটি সাঁঝে অনেক মনের/অনেক ভালবাসা, ঘর ভুলে আর পথটি চিনে/এইখানে আসা, দুর্গাপুরে আসা’। মান্নাদা বললেন, ‘মন্দ নয়। একটু অন্য ভাবেও ভাবতে পারেন। মঞ্চের অনুষ্ঠান মানে তো শ্রোতাদের সামনে বসে তাদের সরাসরি গান শোনানো। গায়কের যেমন দায়িত্ব শ্রোতাদের ভাল লাগানো, আবার গায়কও তো শ্রোতাদের কাছ থেকে উৎসাহ পেতে চান, নইলে চার্জড হবে কি করে?’ ততক্ষণে সম্পর্কটা ‘তুমি’-তে চলে এসেছে। দেবাশিস সাগ্রহে বলল, ‘ঠিক বলেছেন। কী বলা যায় তা হলে?’ মান্নাদা বললেন, ‘তুমি ‘মেহেকো’ আর ‘বাহারো’ মানে জানো তো? বেশ বেশ—তা হলে বলা তো যেতেই পারে ‘মেহেকো তো অ্যায়সে মেহেকো/বাহারো কো হোস আ যায়ে, অর/তালি বাজাও তো অ্যায়সে বাজাও/কলাকার কো জোস আ যায়ে’। একটা অসাধারণ টিপস পেয়ে গেল দেবাশিস। মঞ্চে যখনই বলে কথাগুলো, শ্রোতাদের দিক থেকে দারুণ সাড়া মেলে। নামে ঘণ্টা আড়াই। অনেকটা সময়। আর মান্নাদা থাকা মানে তো দুর্দান্ত আড্ডা চলবেই। কথায় কথায় এল রাধাকান্ত নন্দীর কথা। অল্প কিছু দিন প্রয়াত হয়েছেন। মান্নাদা সব সময় বলতেন, তাঁর বাংলাগানে দু’জনের অবদান ভীষণ রকমের। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাধাকান্ত নন্দী। পুলকবাবু তাঁকে দিয়েছেন নানা বিষয়, নানা বৃন্দ। মান্নাদা তো সুরে ছন্দের যাদুকর। বলতেন, রাধুবাবুর মতো ওই সুর, তালে বাঁধবে কে? ও হচ্ছে ন্যাচারাল জিনিয়াস। কয়েক দিন আগে মেট্রো হলে একটা গানের অনুষ্ঠান ছিল। সেই উপলক্ষে একটা স্যুভেনির প্রকাশিত হয়েছে। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেবাশিসের চোখ আটকে গেল একটা লেখায়—‘তবলা আমায় বাজায়/ তাই তো আমি বাজি,/ তবলাকে মোর দুঃখ দিয়ে/ বাজাতে নয় রাজি।’ কবিতাটি লিখেছেন রাধাকান্ত নন্দী। দেবাশিস, মান্নাদাকে শোনালেন রাধুবাবুর লেখা কবিতাটি। মান্নাদার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বললেন, ‘কত গুণ ছিল রাধুবাবুর। ওর একটা হারমোনিয়াম ছিল। একটা বেশ বড় সড় রকমের। ও যখন বাজাত, একদম ভরিয়ে দিয়ে বাজাত। শুনলে মনটা জুড়িয়ে যেত।’ জানো দেবাশিস, কলকাতা থেকে যখনই মিউজিক ডিরেক্টর আমার ডেট চাইতেন, আমি বলতাম, আগে দেখুন ওই দিন রাধুবাবু বাজাতে পারবেন কি না। ও না থাকলে গানটাই জমবে না। মজার ব্যাপার ঘটেছিল ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবির গানের রেকর্ডিং-এর সময়। গৌরীপ্রসন্নর লেখা, সুর নচিকেতা ঘোষের। রেকর্ডিং-এর রিহার্সাল করছি, ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’। যখন ওই জায়গাটায় এলাম —‘আঃ রাধাকান্ত তুমিই দেখছি আসরটাকে করবে মাটি’, রাধুবাবু হা হা করে উঠলেন। হ্যাঁরে গৌরী, তুমি করেছোটা কি, একেবারে আমার নাম বসাই দিছো। শেষমেষ গৌরী ‘রাধাকান্ত’-কে ‘শশীকান্ত’ করতে রাধুবাবু বললেন—এইটা ঠিক হইছে।’
‘সন্ন্যাসী রাজা’র প্রসঙ্গ যখন এল তখন একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। মান্নাদা-র ঘরে আড্ডা চলছে। সো বার ম্যাডামও মান্নাদা-র সঙ্গে এসেছেন। সামনের গলি দিয়ে ফুলওয়ালা যাচ্ছে। মান্নাদা ডাকলেন তাকে। ফুল মান্নাদা-র খুব প্রিয়। ম্যাডামেরও। একবার মনে আছে, ম্যাডাম এসেছেন জেনে আমি কিছু ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম। মান্নাদাকে বললাম, ‘বৌদিকে একটা জিনিস দিতে চাই।’ শুনে মান্নাদা বললেন, ‘না, না এ সব উপহার কেন আনতে গেলেন? ও আপনি বাড়ি নিয়ে যান। ’ এমনটা বলবেন সে তো আমি জানতাম। কেউ কিছু দিক মান্নাদা এটা একদম পছন্দ করতেন না। আমি বললাম, ‘বৌদির জন্য একটু ফুল এনেছিলাম।’ মান্নাদা একটু হেসে বললেন, ‘ফুল এনেছেন? উপরে আছে, আপনি নিজে গিয়ে দিয়ে আসুন।’ তা মান্নাদা ফুলওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার এই ফুলের দাম কত?’ দাম শুনে কৃত্রিম বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘সে কি, ফুলের এত দাম !’ সে তো মান্নাদাকে চেনেন না। হাত জোড় করে বলল , ‘বাবু দাম তো ফুলেরই হয়। ফুলের মতো আর কিছু কি এত কাজে লাগে? ফুল পুজোয় লাগে, আনন্দ-আনুষ্ঠানে লাগে, ফুল ছাড়া বাবু শেষযাত্রাও হয় না।’ মান্নাদা অনেক ফুল কিনলেন, যা চেয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি দামও দিলেন। ফুলওয়ালা চলে যেতে মান্নাদা বললেন, ‘কী অদ্ভূত দেখুন। মানুষের দর্শন কী ভাবে মিলে যায়। গৌরীর (গৌরীপ্রসন্ন) এত পড়াশোনা, এত শিক্ষিত গীতিকার। আর এই ফুলওয়ালা হয়তো লেখাপড়াই জানে না। একটু আগে যে কথাগুলো বলল, ঠিক সেই একই কথা গৌরী লিখেছিলেন ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে। বলে মান্নাদা গুন গুন করে গাইতে লাগলেন—‘ফুল সাজতে লাগে, পুজোয় লাগে, লাগে মালা গেঁথে নিতে, লাগে জন্মদিনে, ফুলশয্যায়, লাগে মৃতদেহ সাজিয়ে দিতে।’
এ প্রজন্মের কারও গান ভাল লাগলে, সেই ভাল লাগার কথা শিল্পীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সে চেনা হোক বা অচেনা হোক। মান্নাদার অনুষ্ঠান। দেবাশিস বসু সঞ্চালক। গ্রিনরুমে চা খেতে খেতে হাল্কা কথাবার্তা চলছে। মান্নাদা হঠাৎ বললেন, সে দিন টেলিভিসনে একটি মেয়ের গান শুনলাম। রবীন্দ্রনাথের গান গাইছিল। খুব ভাল লাগল। কিন্তু ঠিক আইডেন্টিফাই করতে পারলাম না।’ মান্নাদা ছটফট করছিলেন নামটা না জানায়। দেবাশিস জিজ্ঞেস করল, ‘কোনও হিন্টস দেওয়া যায়? তা হলেই বের করে ফেলব।’ মান্নাদা বললেন, ‘একবারই নামটি দেখিয়েছিল। আমি ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। মনে হয় কোনও বাঙালি মেয়ে সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলেকে বিয়ে করেছে। এখনকার পদবিটা সম্ভবত ‘নায়ার’। দেবাশিস, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘ইয়েস, আই গট। শি ইজ মনীষা মুরলি নায়ার। দক্ষিণ ভারতের মেয়ে। ওর দাদা মনোজ মুরলি নায়ার। দু’জনেই শান্তিনিকেতনের। রবীন্দ্রসঙ্গীত করে। জানা না থাকলে ভাষা শুনে বোঝার উপায় নেই ওরা সাউথ ইন্ডিয়ান জন্মসূত্রে। বাংলা ওদের মাতৃভাষা নয়।’ শুনে মান্নাদা অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আবেদন কতখানি ভেবে দেখ। গান দিয়ে সব মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয় মীরা দেবীকে বলো ওঁর গান আমার খুব ভাল লেগেছে।’
যারাই মান্নাদার নানা দিক দেখেছে, চমৎকৃত হয়েছে। মান্নাদার প্রায় প্রতিটা অনুষ্ঠানে আজও থাকবেই দেবাশিস বসুর এই কবিতাটি—‘হাতের কাছে থাকতো যদি, আকাশ মাপের খাতা/রাখতাম না, রাখতামই না, একটি খালি পাতা,/বুকের মাঝে থাকতো যদি, সাগর-ভরা কালি/রাখতাম না, রাখতামই না, একটুও তার খালি/ওই স্বরেতে উছলে ওঠে হীরে-চুনি-পান্না/ বুকের খাতায়, মনের পাতায়/আজও লেখা—মান্না, মান্না, মান্না।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy