বসন্ত মাখতে মাখতে প্রকৃতির কুঞ্জবনে শিমুল পলাশ গুলমোহর গাছরাও দুলে দুলে ছিল। মধুমাস যতক্ষণ থাকে বনে আর মনে, ফাগুনের আদেখলেপনাটাও ততক্ষণ ঝটকা লাগায়। কত দিনের মন কেমন করা স্বপ্ন। যে ‘দখিনা বাতাস’ লাগাতার সাড়া জাগাতে চাইছিল বাউন্ডুলে মনে। এই সে দিন পর্যন্ত চার দিক যেই মাত্র নিঝুম হল কি হল না— দখিনা বাতাস চুপিচুপি খবর নিয়ে যাচ্ছিল একলা মনের। শুকনো পাতা খসানো বিকেলে, বুড়ো ঝরাপাতাদের মাড়িয়ে বুলেভার্ড ধরে হেঁটে ঘরে ফেরা। তবে? এই যে ঝরা পাতাদের অবিরাম টুপটাপ, সে পাতা খসানো কী কেবল চৈত্রদিনের? সে তো ব্যক্তিগতও।
বসন্ত কখন যেন চৈত্রপবনের দোহাই দিয়ে এক পা এক পা করে ফিকে হতে থাকে। যারা বলেছিল অতি আবেগে যে এ বার বসন্তে হারিয়ে যাবে। তারা শিবিরে ফিরে এসেছে। যদিও কেউ বলে কয়ে নিরুদ্দেশ হয় না। চৈতালি সময়ের বিহ্বলতায় বসন্তবিলাপ-এর পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। যদিও সময়টা খাতায় কলমে এখনও বসন্ত। তবু বাতাসে তপ্ত ছেঁকা।
চৈত্রপবন মনকে বড় উতলা করে। মুম্বই শহরে সে ভাবে তো বসন্ত আসে না। আর কখন যে এল কখন যে ফিরে যাচ্ছে সেটুকুও তেমন ঠাহর হয় না। যাই যাই বসন্তে পাতা ঝরা গাছেদের অন্য রূপ। মধুক্ষরা প্রকৃতিতে ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে হোরি খেলা। বসন্ত যাব কী যাব না করেও আরও একটু থমকে। হলুদ বিষণ্ণ মনখারাপ চার পাশ ছুঁয়ে যায়। আগামী দাপুটে গরম তার তেজোময় উপস্থিতি জানান দেবে কী দেবে নামাঝের এই আলসেমি সময়টায় গুলমোহর গাছগুলো হলদে চমকে ফুলে ফুলে ছয়লাপ হয়েছে। হলদে উচ্ছ্বাস এই সময়টাতে পারিপার্শ্বিককে রাঙিয়ে দিতে এখনও রয়ে গেছে। রয়ে গেছে সামান্যতম বসন্তের রেশ।
গুলমোহর গাছগুলোর মাথায় হলুদ ফুলের ছটা, রাধাচূড়া গাছগুলোয় দঙ্গল হয়ে থাকা উজ্জ্বল লালা কমলা বাহার। এ সময়টায় এটা কী শুরু হয়। থাকবে টানা মে মাসের মাঝ বরাবর। বা আরও বেশি। রঙবাহারি ফুলেল ছোঁয়ায় সেজে উঠছে চৈত্রদিন। এ পর্যন্ত লিখেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্মরণীয় কবিতাটির রম্য উচ্চারণ।
“গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে যে
হরবোলা ছেলেটা কোকিল ডাকতে
ডাকতে যেত তাকে ডেকে নিয়ে
গেছে দিনগুলো।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত”
এই যে যাই যাই ফাগুন, তাতে তো সাজানো ছিল না কিছুই। তবু ছন্নমতি আহ্লাদে অথবা বিষণ্ণ-বিলাসে শরবিদ্ধ আমরাও কখনও ফাগুন আড়ালে থেকে যেতে চাই আরও কিছুটা সময়। হয়তো কেউ আসবে। কিংবা ফিরে যাবে। যখন তখন। ফেরার সময় সারাটা রাস্তা জুড়ে থেকে যাবে মনকেমনের হাওয়া।
আবহাওয়ার পন্থা অনু-বিধি চৈতালি দহন মেনে ও দিকে পশ্চিমবাংলার আকাশে খান কয়েক কালবৈশাখীর আনাগোনা এই সময় থেকেই তো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।
মহানগরে এখন গ্রীষ্মের উষ্ণতা। কখন যে বসন্ত চলে যাচ্ছে, চৈত্রের আমদানি হচ্ছে টের পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কালবৈশাখীর আবেগ এখানে নেই। নেই মানে, ধারণাটাই নেই। এখানে ঝড় আছে। ঝঞ্ঝা আছে। কিন্তু এখানকার জলবায়ুতে কালবৈশাখী নেই। ঝাঁ ঝাঁ রোদ মেখে মানানসই উষ্ণতার মুম্বই এলিয়ে থাকে। দিনে বাইরে কাঠফাটা রোদ আর উত্তর পশ্চিমী শুকনো গরম হাওয়া। যেটা মূলত মুম্বইয়ে ঢোকে ও পাশে গুজরাট রাজস্থান থেকে। মুম্বইয়ের এই এক বগ্গা গরমের দহন ঢালতে থাকবে সেই মধ্য জুন পর্যন্ত। এখানে আর্ত চাতকের পাখা ঝাপটানো নেই। চৈত্রদিনের কচি নিমপাতা ও বেগুনভাজা, সজনে ফুলের বড়া, কচি আমের টক ডাল, বাংলার স্বাদ মুম্বইয়ে কই?
বাজারে তো খুঁজেই পাই না কচি নিমপাতা। নরম পাতলা সজনে ডাঁটা। ফুটফুটে সাদা সজনে ফুল হয়তো যাঁরা হদিস জানেন, তাঁরা খুঁজে পেতে বাড়ির জন্য কিনেও ফেলেন। তবে এই খুঁজে পাওয়াটাও বেজায় মুশকিল। সংসারের নিত্য গল্পে কখনও সখনও অতি সামান্য, তেমন আহামরিও নয়, মহার্ঘ তো নয়ই—এমন জিনিসগুলোর প্রতিও স্মৃতিকাতরতা উথলে ওঠে। এই নিমবেগুন ভাজা, কচি আম, সজনে ফুল এ সব তেমন কিছুই নয়। তবু ওই সামান্য জিনিসের জন্যও মনকেমন।
আবার ভাবি, অসামান্য এই স্বপ্ননগরী মুম্বই। প্রকৃতির খোলা আঙ্গিনায় অপাঙ্গে বিছিয়ে থাকা আরবসাগরের সুনীল পটভূমি। নিবিড় যতটা গভীরও। ওপাশে ঠেস দিয়ে পশ্চিমঘাট পাহাড়ের বিস্তার। মহানগরের অভিজাত জৌলুস ঠকমদমক তো রয়েছেই। পরবাস যাপনে প্রকৃতির এই রম্যতা মনটাকে ভাল লাগায় ভিজিয়ে দেয়। আর সেই আমার কিনা, সামান্য কয়েকটা কালবৈশাখীর জন্য মনখারাপ? কচি নিমপাতা, সজনে ফুল পাই না বলে এতটাই মুষড়ে আছি? কোনও মানে হয়?
চৈত্রের দুপুরে আজ কোকিল গাইছে না, চাতক গাইছে না, বসন্তবৌরীও নেই। বরং এরই মধ্যে হঠাত্ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়েছে আমের মুকুল। রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়া গুলমোহরের দস্যিপনা। মন্দ কি? এও তো এক ভেজা শেষ বসন্ত। সন্দেহাতীত দীর্ঘ দুপুর। আবারও তো চৌচির রোদের আঁচড় কাটবে প্রকৃতি। তেমন করে টের পাওয়া হয় না ‘চৈত্র মাসের উতল হাওয়ার’।
যদিও ‘উতল হাওয়া’ এখন বাতাসে টের পাই না। দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটাই জানিয়ে দেয়। প্রকারান্তরে কিছুটা ঠায় বিরতি নিয়ে চৈত্র শেষের বেলাগুলোও ফুরিয়ে আসবে। তার পর আরও ক্লান্ত ঘুম ঘুম নিঃঝুম দুপুরগুলোর সময়সীমা বাড়বে। তখন টের পাব, এর নাম গ্রীষ্ম। দাবদাহ। আসলে চৈত্র মানেই প্রবহমানতা বাঁচিয়ে রাখা। এক সৌর মাস পার করে আবারও একটা নতুন মাস ও নতুন বছর আসার প্রকৃতিগত প্রস্তুতি। বলা যেতে পারে আস্ত একটা বছর পেরিয়ে ফুরিয়ে আসা শেষের সে দিনের নামই চৈত্র।
চৈতি হাওয়ায় যে ধুলোটা ওড়ে, সেই ‘সর্বনাশা’ ধুলোটাও তো গায়ে আর লাগে না মুম্বই প্রবাসী বঙ্গ দেহে-মনে। অথচ সময় পেরিয়ে যায় নিজের নিয়মে। যতই বলি ‘মম চিত্ত নিতি নৃত্যে সদা বাজে’। আদপে সত্যিই কি কিছু বাজছে? হয়তো বাজছে। বাজছে প্রকৃতির গুঞ্জরণে। বাজছে কিন্তু শুনতে পাচ্ছি না এমন চৈতালী দিনেই তো কখনও তির্যক, কখনও আশ্লেষ, কখনও অপ্রাপ্তি, স্মৃতিকাতরতা, ঘরে ফেরার গান, অনুরাগ, অপেক্ষা কিংবা বিষাদের কথাও যে অনুভবে উচ্চারিত হয়। সে বিধুরতা তো থাকতেও পারে পাঠকের চোখের কোণে।
এই বছর মরাঠি ‘গুঢ়ি পড়ওয়া’ পড়েছে ২১ মার্চ।
শনিবার চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ দিনটি হল মরাঠির নববর্ষ।
মরাঠা দেশে রয়েছি অথচ এদের আগামী উত্সব তিথি ‘গুঢ়ি পড়ওয়া’ নিয়েও তো কিছু বলার থাকে। এই বছর মরাঠি ‘গুঢ়ি পড়ওয়া’ পড়েছে। ২১ মার্চ। শনিবার চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ দিনটি হল মরাঠিদের নববর্ষ। আমাদের বাংলা নববর্ষের সঙ্গে মরাঠি নববর্ষের কয়েক দিনের আগুপিছু ফারাক আছে। মরাঠা কালনির্ণয় মতে যেখানে শুক্লা প্রতিপদ চৈত্রমাসের নির্দিষ্ট দিনটিতে নতুন বছর উদযাপন করা হয়, সেখানে বাংলায় নতুন বছর বলতে চৈত্র পার করে বৈশাখের প্রথম দিনটি। মহারাষ্ট্রে বছর কয়েক থাকার সুবাদে মরাঠাদের নানান উত্সব পালাপার্বণের সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত হচ্ছি। প্রতিবেশী মরাঠা পরিবারের খুব কাছ থেকে এই পার্বণগুলো লক্ষ করার সুযোগ তো হয়ই।
বিশিষ্ট এই ‘গুঢ়ি পড়ওয়া’ এই দিনটিতে একটি বিশেষ উত্সব হিসেবে পালিত হয় মরাঠি পরিবারে। মরাঠিদের এই নববর্ষের ‘গুড়ি পড়ওয়া’ উত্সবটি খুব সুন্দর। নববর্ষের এই দিনটিতে একটি বাঁশের লাঠির আগায় নতুন কাপড় বেঁধে তার ওপর একটি তামা বা রুপোর ঘটকে উপুড় করে রাখা হয়। এই ঘটে জড়ানো হয় ফুলের মালা, নিমপাতা, আম্র পল্লব ও মিষ্টান্ন। ‘গুঢ়ি’ বলা হয় একেই। আর ‘পড়ওয়া’ মানে হল পরব বা উত্সব। পবিত্র ভাবে সজ্জিত গুঢ়িটিকে মূল দরজার প্রবেশ পথে অথবা জানলায় স্থাপন করা হয়।
এই গুঢ়ি পড়ওয়া ঘিরে দিন কয়েক আগে থাকতেই মুম্বইয়ের যাবতীয় পত্রপত্রিকায় নানান রকম গুঢ়ি পড়ওয়া ধামাকার লোভনীয় বিজ্ঞাপন। এ ছাড়া পুজোআচ্চার সামগ্রী, আলপনার মোটিফ, সাজগোজ, জামাকাপড় গেরস্থালির হরেক কিসিম সব বিকোচ্ছে দেদার। এই সব উত্সব পুজোকে কেন্দ্র করে মরাঠিতে মেতে থাকা, দেখতে ভালই লাগে। মুম্বইকে যে মনে হয় অদ্ভুত রকম কৃত্রিম, অতিমাত্রায় আদবকায়দায় সফিসটিকেটেড, প্রভূত আপ ডেটেড। সচেতন প্রফেশনালিজমে ভরা ফাস্ট লাইফ-সহ যান্ত্রিক শহর—এই সব উত্সব ঘিরে মরাঠি আতিশয্য আবেগ চেনায় অন্য মুম্বইকে।
এই চৈত্র দিনটির পৌরাণিক অন্য কাহিনিও আছে। কথিত আছে, রাবণবধ ও চোদ্দো বছর বনবাস শেষে শ্রীরামচন্দ্র এই দিনই অযোধ্যায় ফেরেন। আবার পুরাণ মতে বলা হয়েছে, মহাপ্রলয় শেষে এই দিনই ব্রহ্মা আবার জগত্ সৃষ্টির কাজে মেতে উঠেছিলেন। তাই গুঢ়িকে ‘ব্রহ্মদ্বজও’ বলা হয়। শিবাজিকে মনেপ্রাণে দেবতা জ্ঞানে পুজো করা মরাঠিরা মনে করেন, শিবাজি মহারাজ ভোঁসলের বিজয়পতাকার প্রতীক হল এই পবিত্র ‘গুঁঢ়ি’। প্রকৃতিগত দিক দিয়ে দেখলেও দেখা যায় ‘গুঢ়ি পড়ওয়া’ উত্সবের অন্য তাত্পর্য হল এই সময়টা মহারাষ্ট্র-কোঙ্কনি উপকূলে রবিশস্য ঘরে তোলার দিন। কোঙ্কন-মরাঠা-গোয়ানিজ মানুষজন, চাষআবাদ ও কৃষিজীবী পরিবাররা এই উত্সবকে কেন্দ্র করে আনন্দোত্সবে মেতে থাকেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy