মার্গ সঙ্গীতের পরম্পরাকে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই বহন করে চলেছেন নতুন প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পীরা। তার আভাস দিল ‘আ সেশন অফ ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজ়িক’। দ্য ডোভার লেন মিউজ়িক কনফারেন্স এবং দ্য ডোভার লেন মিউজ়িক অ্যাকাডেমির উপস্থাপনায় বিড়লা অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত দু’দিন ব্যাপী এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতানুষ্ঠানে নবপ্রজন্মের শিল্পীদের প্রত্যয়ী পরিবেশনা বেশ নজর কেড়েছে।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে শোনা গেল ভজন, ঠুমরি, খেয়াল এবং বেহালাবাদন। দু’টি ভজন শোনালেন অঙ্কিতা চৌধুরী— মিশ্র পিলু রাগে ‘তুম বিন মোরি কউন খবর লে’ এবং ভৈরবীতে ‘ম্যায় দ্বার খোল কর ব্যায়ঠা হুঁ’। অঙ্কিতার গায়কিতে স্বকীয়তার ছোঁয়া ছিল। তবে তাঁর কণ্ঠ যতটা শ্রুতিমধুর, গায়ন ততটা পরিশীলিত নয়। কণ্ঠের নিয়ন্ত্রণে খামতি চোখে পড়ছিল। বিশেষ করে, অতিরিক্ত অলঙ্কারপ্রয়োগে ভজনের মাধুর্য নষ্ট হয়েছে। তিন সপ্তকে সুরবিহারের ক্ষেত্রে ভারসাম্যের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তার সপ্তকে মাঝেমাঝেই অঙ্কিতার কণ্ঠ অতিরিক্ত চড়া মনে হয়েছে। বেনারস ঘরানার দু’টি জনপ্রিয় ঠুমরি পরিবেশন করলেন দেবরূপ চক্রবর্তী— ‘কউন গলি গয়ো শ্যাম’ এবং ‘পানিয়াঁ ভরেরি কউন’। দেবরূপের কণ্ঠে সারল্য ছিল। তবে ঠুমরি গায়নের যে নাটকীয়তা, তা তাঁর কণ্ঠে একেবারেই ছিল না। অলঙ্কার প্রয়োগেই ঠুমরির সৌন্দর্য। কিন্তু দেবরূপের কণ্ঠে ছোট ছোট অলঙ্কার, মুড়কি সে ভাবে স্পষ্ট হয়নি। হিন্দোলা সিংহের বেহালাবাদন বেশ ভাল লেগেছে। ইমন রাগে বিলম্বিত এবং দ্রুত শোনালেন তিনি। পরিবেশনার প্রথম দিকে হিন্দোলার বেহালাবাদন খানিক বিভ্রান্ত ছিল। মাঝেমধ্যেই সুরবিচ্যুতি ঘটছিল এবং উপস্থাপনায় জড়তা প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু ক্রমশ তাঁর বাদন একটা অভিমুখ পেয়েছে। ধীর লয়ে হিন্দোলার বাদন একটু অস্বচ্ছন্দ, দ্রুত লয়ে সেই জড়তা কেটে যায়। বিলম্বিতের তুলনায় তিনতালে নিবদ্ধ দ্রুতটি অনেক বেশি সাবলীল। পরবর্তী ধুনটিও তিনি চমৎকার বাজিয়েছেন। সুরের সূত্রে মিলিয়ে দিয়েছেন ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ এবং ‘একলা চলো রে’— এই দু’টি রবীন্দ্রগানকে। সুরেলা নন্দনের খেয়াল পরিবেশনা বেশ বলিষ্ঠ। শোনালেন বাগেশ্রী রাগ। সুরবিস্তারে অনুশীলিত কণ্ঠের আভাস মেলে। সাবলীল বিস্তার এবং তানকারিতে বাগেশ্রী রাগটিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন তিনি। তবে রাগের চলন আরও খানিক বৈচিত্রময় হলে ভাল লাগত।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানও ছিল বৈচিত্রমণ্ডিত। রাগপ্রধান গেয়ে শোনালেন সঞ্চারী সিংহরায়। মিশ্র তিলং রাগে অমলেন্দুবিকাশ করচৌধুরীর একটি কম্পোজ়িশন শোনালেন তিনি। সঞ্চারীর কণ্ঠ বেশ ভাল, কণ্ঠের দাপটও আছে। কিন্তু সুরসঞ্চালনায় আরও নিয়ন্ত্রণ কাম্য ছিল। গলার সূক্ষ্ম কাজগুলি আরও স্পষ্ট হতে পারত। ছোট ছোট অনেক অলঙ্কারের প্রয়োগ করেছেন
সঞ্চারী তার গায়নে, কিন্তু সূক্ষ্মতার অভাবে সেগুলি মনে দাগ কাটেনি। বরং বাহুল্য বলে মনে হয়েছে।
এ ছাড়াও বেহাগ এবং মিশ্র তিলক কামোদ রাগে দু’টি রাগপ্রধান গেয়েছেন শিল্পী। পলাশ কুড়ির খেয়াল গায়ন মন্দ নয়। শোনালেন বেহাগ রাগে বিলম্বিত এবং দ্রুত বন্দিশ। তবে বেশ কয়েক বার তারসপ্তকের দিকে তাঁর গলা খুব কর্কশ মনে হয়েছে। তারসপ্তকের সুরবিস্তারে একটু সংযত থাকলেই বোধ হয় ভাল হত। দ্রুত বন্দিশটি তুলনায় ভাল গেয়েছেন পলাশ। কিরওয়ানি রাগের ভজনটিও মন্দ লাগেনি। স্লাইড গিটারে পুরিয়া ধানেশ্রী বাজিয়ে শোনালেন রতন ভারতী। বাজালেন ন’মাত্রার একটি গৎ। পরে শোনালেন তিনতাল এবং একতালের আরও দু’টি গৎ। তাঁর বাদন বেশ পরিণত। সুরবিন্যাসে অভিনবত্বের ছোঁয়া ছিল।
আনন্দ কল্যাণ রাগে খেয়াল পরিবেশন করলেন সংযুক্তা দাস। সংযুক্তার কণ্ঠ উদাত্ত, গায়নও শ্রুতিমধুর। তবে তানকারির ক্ষেত্রে শিল্পীকে আরও একটু মনোযোগী হতে হবে, খানিক জড়তা এখনও রয়েছে। দ্রুত একতালে চমৎকার একটি বন্দিশ শোনালেন তিনি।
অনুষ্ঠান শেষ করলেন ভৈরবী রাগে নিবদ্ধ ঠুমরি ‘রস কে ভরে তোরে ন্যায়না’ দিয়ে। মন ছুঁয়ে গেল তাঁর গায়ন।
শিল্পীদের তবলায় সহযোগিতা করেছেন তমোঘ্ন চক্রবর্তী, উজ্জ্বল রায়, বিলাল খান সালোনভি, অর্কদীপ দাস, উজ্জ্বল ভারতী এবং বিভাস সাংহাই। হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন প্রদীপ পালিত, শান্তব্রত নন্দন, বিষ্ণুদেব চক্রবর্তী এবং হিরণ্ময় মিত্র।
দু’দিনের এই অনুষ্ঠানে যাঁরা সঙ্গীত পরিবেশন করলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বয়সে নবীন, তালিমরত। সংশোধন, অনুশীলনের প্রয়োজন কম-বেশি সকলেরই আছে। তাও সে সব ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বাদ দিলে বলা যায়, এই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে নতুন প্রজন্মের কাছে একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে ফিরলেন শ্রোতারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy