Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ যেন রোগশয্যায় আরোগ্যের ‘কৃষ্ণযাপন’

একত্রিশটি কাজের দু’টি অ্যাক্রিলিক, বাকি সব পেন, ইঙ্ক ও জল রং। ড্রয়িং করে পেনেরই বিভিন্ন রং দিয়ে ছবি সম্পন্ন করেছেন শিল্পী। তেল ও জল রঙে বরাবরই সিদ্ধহস্ত সিদ্ধার্থ রিয়্যালিজ়মকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন তাঁর ক্যানভাস ও কাগজে এক নিবিড় আধ্যাত্মিক চেতনার উপাসনায় নিমগ্ন থেকে।

প্রদর্শনীর একটি ছবি।

প্রদর্শনীর একটি ছবি।

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০১:১০
Share: Save:

পনেরো বছর আগে ২০০৪ সালে কঠিন রোগে শয্যাশায়ী অবস্থায় কিছু ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী। সম্প্রতি দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে সুদূর মুম্বইয়ে টেনে নিয়ে গেল অস্ত্রোপচারের জন্য। সেখানে হাসপাতালের বিছানায় আধশোয়া ভাবে আঁকা তাঁর সেই সব যৎসামান্য মিশ্র মাধ্যম ও প্রধানত রেখাঙ্কনের এ যেন দ্বিতীয় ‘কৃষ্ণযাপন’। এই ছবিগুলি নিয়েই আলতামিরা আর্ট গ্যালারিতে শেষ হল সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তের সিরিজ় ‘হা কৃষ্ণ, হে কৃষ্ণ’ প্রদর্শনীটি। এ বার জন্মাষ্টমীর আগেই কলকাতায় ছোট একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন শিল্পীর দু’-তিন জন বন্ধু মিলে। হাসপাতালে অসুস্থ শরীরেও ডাক্তারদের অনুমতি নিয়ে ছবিগুলি এঁকেছিলেন সিদ্ধার্থ।

সেই একত্রিশটি কাজের দু’টি অ্যাক্রিলিক, বাকি সব পেন, ইঙ্ক ও জল রং। ড্রয়িং করে পেনেরই বিভিন্ন রং দিয়ে ছবি সম্পন্ন করেছেন শিল্পী। তেল ও জল রঙে বরাবরই সিদ্ধহস্ত সিদ্ধার্থ রিয়্যালিজ়মকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন তাঁর ক্যানভাস ও কাগজে এক নিবিড় আধ্যাত্মিক চেতনার উপাসনায় নিমগ্ন থেকে। তাঁর এই দেবদর্শনের আশা-আকাঙ্ক্ষার দীর্ঘ লালন কিন্তু ওই শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে। তাঁর মগ্ন চৈতন্যে বারবার তাই কৃষ্ণ রঙে-রেখায় একাকার। এই চেতনা বা বিশ্বাসের নিরিখে নয়, কল্পনাকে রচনার বিন্যাসে, রঙের অবিশ্বাস্য ব্যবহারে, রেখার অনন্যসাধারণ কাব্যিক টানটোনে তিনি ছবিকে বারবার করে তুলেছেন মহার্ঘ্য। ছবি তৈরির সেই সব গুণ যে কোনও মাধ্যমেই তাঁর করায়ত্ত। এ তাঁর বহু বছরের অবিরাম চর্চার ফল। তাঁর শিল্পচর্চায় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধা, পটের মধ্যিখানে যেন পুরাণের নানা কাহিনি বিধৃত হয়েও প্রেমের আশ্চর্য সম্মিলন এবং ভক্তিরসের উন্মীলনে একাকার হয়েছে।

ধর্ম, দর্শন, ভক্তিরস, আধ্যাত্ম-চেতনার উৎসমুখ নয়। ছবির টেকনিকের মাহাত্ম্য এবং বিভ্রমকে খুঁজে পাওয়া সহজ তখনই, যখন চিত্রকর তাঁর নিজস্ব স্টাইল ও টেকনিকের গভীর অনুসন্ধিৎসায় মগ্ন থাকেন। এমনকি কাজের মাধ্যমের কৌশলগত ব্যবহার ও সারফেসের বৈশিষ্ট্যকে আত্মস্থ করে শিল্পী রঙের প্রাচুর্য ও প্রয়োজনীয় অপ্রতুলতায় কম্পোজ়িশনকে বিন্যস্ত করলেও সহজ হয় তাঁর সৃষ্টির কাজ বোঝা।

অত্যন্ত স্বল্প রেখায় শিল্পী অবয়বের বিভঙ্গ ও ভিন্ন স্টাইলকে দেখাচ্ছেন। একই সঙ্গে ওই চিত্রেই নরম রং ঘষে ঘষে হাত বা শরীরের কিছু অংশ ও মুখমণ্ডলকে চিত্রায়িত করছেন। তখন একঘেয়েমি কেটে গিয়ে ছবি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাচ্ছে। সামান্য রং কখনও পোশাক এবংডিজ়াইনেও দৃষ্টিনন্দন এক আবহ তৈরি করছে।কাগজের সূক্ষ্ম টেক্সচারকেও বর্ণের গাঢ়ত্ব ও আপাতনরম স্নিগ্ধ ব্যবহারে ছবির সঙ্গে একাত্ম করেছেন। ওই টেক্সচার তখন হয়ে যাচ্ছে পেন্টিংয়ের মোহময় স্তর। বংশীবাদনরত কৃষ্ণের এই রূপ সহজেই আচ্ছন্ন করে।

সরু তুলির টান কবিতার মতো ছন্দোবদ্ধ হয়ে যেন হঠাৎ বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে কোনও অনির্দেশের দিকে। কিংবা আবার অদৃশ্য হয়ে হঠাৎ ভীষণ নরম হালকা বর্ণের যে আবছায়া রূপ, তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁর এই টানটোনের অনিন্দ্য চলন বর্ণহীন রূপারোপ বা পশুর উপস্থিতিকেও প্রাধান্য দিচ্ছে রচনার মধ্যে।

এখানে তিনি রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে গাভী-গরুকে তাঁর অনেক ড্রয়িংয়ে মায়াময় করেছেন। ভাবলেশহীন চোখের গাভীও যেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমপ্রীতিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে নিরীক্ষণ করছে, আবার বাঁশিও শুনছে যেন! কোনও অর্থেই যা সচিত্রকরণের আভাস দেয় না বিন্দুমাত্র।

কখনও পটের অনেকটা জুড়ে রং জলের সঙ্গে মিশে, ছড়িয়ে কিছুটা ধোঁয়ার মতো মিশে যাচ্ছে কাগজের টেক্সচারে। এ-ও এক ধরনের স্টাইল।

তাঁর অধিকাংশ পটে বেশি রং ও অল্প রঙের অভিজাত কৌলীন্যকে সিদ্ধার্থ প্রশ্রয় দিয়েছেন। এখানে রেখাপ্রধান অবয়বগুলির অবস্থান ও ভঙ্গিমা যেন সেই সব বর্ণের গভীর আস্তরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করে জানান দিচ্ছে, তাদেরও আর এক আভিজাত্যের প্রকাশকে। এখানে উল্লম্ব রেখাসমূহের ছন্দোবদ্ধতার আপাতবঙ্কিম টানটোন কম্পোজ়িশনকে সন্নিবেশিত করছে বর্ণের স্বল্পতায় আর সাদা ছেড়ে দেওয়া রূপারোপের বিন্যাসে। সিদ্ধার্থের কালো রেখার কাজগুলিও অবিস্মরণীয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Art Exhibition Painting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE