Advertisement
E-Paper

অভিমানেই পাখোয়াজ বাদক থেকে গায়ক হয়েছিলেন লালচাঁদ বড়াল

তাঁর পরিবারে কেউ আগে সঙ্গীতচর্চা করেননি। তাঁর রেকর্ডের জনপ্রিয়তা গ্রামোফোন কোম্পানিকে এতটাই সাফল্য এনে দিয়েছিল যে, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাঁকে উপহার হিসেবে মোটরগাড়ি পাঠিয়েছিলেন। লালচাঁদ বড়ালকে নিয়ে লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যতাঁর পরিবারে কেউ আগে সঙ্গীতচর্চা করেননি। তাঁর রেকর্ডের জনপ্রিয়তা গ্রামোফোন কোম্পানিকে এতটাই সাফল্য এনে দিয়েছিল যে, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাঁকে উপহার হিসেবে মোটরগাড়ি পাঠিয়েছিলেন। লালচাঁদ বড়ালকে নিয়ে লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৮ ০০:৩৯
লালচাঁদ বড়াল

লালচাঁদ বড়াল

এদেশে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে লন্ডনের গ্রামোফোন কোম্পানি ১৯০২ সালে ফ্রেডরিক উইলিয়াম গেইসবার্গ এবং তাঁর সহকারী জর্জ ডিলনাটকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। শশীমুখী, ফণিবালা কিংবা গহরজানের হাত ধরে যে ইতিহাসের সূচনা, সে কালের আরও কিছু শিল্পীর অবদানে তা পূর্ণতা পেয়েছিল। সে দিন যে তরুণ শিল্পীর গান শুনে গেইসবার্গের মনে হয়েছিল ‘অতিরিক্ত চড়া’ এবং ‘মেয়েলি’, সেই শিল্পীর রেকর্ডই গ্রামোফোন কোম্পানিকে এনে দিয়েছিল অভাবনীয় সফলতা। তিনি লালচাঁদ বড়াল। তাঁকে বলা হত ‘ভারতের ক্যারুসো’। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। সেই সময়ে ধ্রুপদী সঙ্গীত জগতে বহু দিকপাল বিরাজমান। তাঁদের মধ্যেই লালচাঁদ হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক শিল্পী, যাঁর গান ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল।

লালচাঁদের জন্ম ১৮৭০ সালে। তাঁর বাবা নবীনচাঁদ বড়াল ছিলেন অ্যাটর্নি। পিতামহ প্রেমচাঁদও ছিলেন সেকালের গণ্যমান্য ব্যক্তি। ছোট থেকেই লালচাঁদের গানের প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ।

হিন্দু স্কুলে লালচাঁদের সহপাঠী এবং বন্ধু ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর ‘আত্মকথা’য় উল্লেখ রয়েছে লালচাঁদের ছেলেবেলার সঙ্গীত চর্চার বিষয়ে। নারায়ণপ্রসাদ শীল হিন্দু স্কুলে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে লালচাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন। ‘‘অল্প বয়স থেকেই লালচাঁদ যেমন গান গাইতেন, তেমনই ভাল এসরাজ, হারমোনিয়াম ও বাঁয়া তবলাও বাজাতে পারতেন। প্রথম দিকে গলা ছিল জাঁদরেলী আর বাজনার হাত ছিল কড়া। পরে দুই-ই অনেকটা মোলায়েম হয়ে আসে...লালচাঁদ গাইত সেকালে প্রচলিত ব্রহ্মসঙ্গীত... আমি তার সঙ্গে মিশে বহু গান-বাজনার আসরে উপস্থিত থাকতুম...আমি লালচাঁদের সঙ্গে মহেন্দ্র চাটুজ্জ্যে নামক জনৈক হারমোনিয়াম বাদকের বাড়িতে গিয়েছি...আমি এবং আমার ভাই মন্মথ বোধহয় প্রথম বাঙালী ছেলে যারা ফুটবলে পদাঘাত করে... ক্রমে আরও পাঁচজন ছেলে এই ফুটবল খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে। লালচাঁদ বড়ালও এই খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন ছিল।’’

সঙ্গীত বিষয়ে নবীনচাঁদের কোনও আগ্রহ না থাকলেও সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেকালের ‘হিতবাদী’ সাপ্তাহিক সাহিত্যপত্রের প্রধান অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন নবীনচাঁদ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য সেই সময়ে পত্রিকার মূল সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য আর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথ। ছাত্রজীবনে লালচাঁদ সঙ্গীত চর্চা করুক, এটা নবীনচাঁদ একেবারেই চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে। হিন্দু স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পরে তিনি লালচাঁদকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ায় লালচাঁদের মন ছিল না।

স্কুলে থাকাকালীনই লালচাঁদ পাখোয়াজ বাজানো শিখেছিলেন মুরারিমোহন গুপ্তের কাছে। স্কুলে যাতায়াতের পথে ছিল একটি মুদির দোকান। সেখানেই রাখা থাকত লালচাঁদের পাখোয়াজটি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে সেখানেই তিনি পাখোয়াজ বাজাতেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে লালচাঁদ সুযোগ পান পাশ্চাত্য সঙ্গীত শেখার। এখানেই ইংরেজি গান, পিয়ানো বাজাতে শেখেন।

বাবার আপত্তি থাকায় গোপনে চলতে থাকে লালচাঁদের সঙ্গীতচর্চা। বাবার উৎসাহ কিংবা সাহায্য না পেলেও লালচাঁদ মায়ের সাহায্য ও অনুপ্ররণা পেয়েছিলেন। ছেলের সঙ্গীতপ্রতিভার কথা তিনি জানতেন এবং ছেলেকে একটি পাখোয়াজ কিনে দিয়েছিলেন। গান-বাজনা সম্পর্কে স্বামীর কঠিন মনোভাব তিনি নরম করারও চেষ্টা করতেন। যদিও নবীনচাঁদ মনে করতেন, গান-বাজনা করলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। কর্মজীবনে নবীনচাঁদ এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে, ছেলের লেখাপড়া বা অন্য বিষয়ে খোঁজ রাখার অবকাশ পেতেন না।

সেই সময়ে কলকাতার সঙ্গীতের আসরে ধ্রুপদী সঙ্গীতের ভালই চল ছিল। তরুণ পাখোয়াজ বাদক হিসেবে ইতিমধ্যেই লালচাঁদ পরিচিতি লাভ করেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি বন্ধু তথা ধ্রুপদ গায়ক হরিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গত করতেন। হরিনাথ ছিলেন ধ্রপদী অঘোরনাথ চক্রবর্তীর অন্যতম প্রিয় শিষ্য। লালচাঁদের বহু দিনের শখ ছিল অঘোরবাবুর সঙ্গে সঙ্গত করার। কিন্তু সেই সুযোগ আর আসে না। এক সময়ে লালচাঁদ জানতে পারলেন অঘোরবাবু পাথুরিয়াঘাটায় মহারাজ যতীন্দ্রমোহনের প্রাসাদে রয়েছেন। সেই পরিবারেরই আত্মীয় রণেন্দ্রমোহন ঠাকুর লালচাঁদের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। লালচাঁদ একদিন তাঁর ইচ্ছের কথা রণেন্দ্রমোহনকে জানিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, অঘোরবাবুকে বলে একদিন তাঁর গানের সঙ্গে সঙ্গত করার ব্যবস্থা করতে। রণেন্দ্রমোহন বন্ধুর কথা রেখেছিলেন ঠিকই, তবে এখানেই লালচাঁদের জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা তাঁর জীবনের গতিটাই বদলে দিয়েছিল।

নির্ধারিত দিনে নিজের পাখোয়াজটি নিয়ে লালচাঁদ উপস্থিত হয়েছিলেন অঘোরবাবুর কাছে। কিন্তু লালচাঁদের অল্প বয়স দেখেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, অঘোরবাবু বলেছিলেন পরের দিন আসতে। পরের দিন লালচাঁদ যথাসময়ে হাজির হলেও অঘোরবাবুর সে দিন গান গাওয়ার ইচ্ছে না থাকায় লালচাঁদের সঙ্গত করা হল না। তৃতীয় দিনেও নিরাশ হলেন লালচাঁদ। অঘোরবাবুর সঙ্গে বাজানোর সুযোগ তিনি পেলেন না। মনের ইচ্ছে পূরণ না হওয়ায় লালচাঁদ অপমানিত বোধ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাঁর অভিমান হয়েছিল। উপলব্ধি করেছিলেন এত দিন তিনি যে বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে সাধনা করেছেন, সেটি সম্পূর্ণ পরনির্ভর। গায়কের ইচ্ছে না হলে বাদ্যযন্ত্রটিও যেন মূল্যহীন! তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আর কোনও দিন পাখোয়াজ বাজাবেন না। আর মনে মনে গায়ক হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

পাখোয়াজ বাদক থেকে গায়ক হওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। প্রথমে তিনি বন্ধু হরিনাথের কাছে ধ্রুপদ শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু হরিনাথ তাতে কোনও উৎসাহ না দিয়েই বলেছিলেন, ‘‘এই হেঁড়ে গলায় আবার গান শেখা কেন?’’ তবে লালচাঁদও ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি গান শিখবেনই! তাই নতুন করে শুরু হল এক অধ্যায়। লালচাঁদ এ বার তাঁর মায়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আর তাঁর সাহায্যেই লালচাঁদের গান শেখার পথটি খুলে গিয়েছিল।

তখন লালচাঁদের বয়স আঠেরো-উনিশ বছর। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসেছিলেন তৎকালীন গভর্নর, ইংরেজ রাজকর্মচারী ও শহরের প্রভাবশালীরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নবীনচাঁদও। কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে লালচাঁদ পিয়ানো বাজাবেন ও ইংরেজি গান গাইবেন। কিন্তু প্রথমে লালচাঁদ এতে রাজি হননি। কেননা তিনি ভাল ভাবেই জানতেন, তাঁর বাবা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। তবু কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে নিরুপায় হয়েই লালচাঁদ রাজি হয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানের দিন গভর্নর ও অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে এসেছিলেন নবীনচাঁদও। এমন সময়ে সঙ্গীতের আসর শুরু হল। ঘোষণা করা হল পিয়ানো বাদকের নাম— লালচাঁদ বড়াল! নবীনচাঁদ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেই ঘরের এক দিকে রাখা ছিল একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো। এসে পিয়ানোর সামনে রাখা টুলটিতে বসে লালচাঁদ আঙুল ছোঁয়ালেন পিয়ানোর রিডে। তার পরে সুর-ঝঙ্কার তুলতেই নবীনচাঁদের বিস্ময়ের শেষ ছিল না। তিনি যতটা অবাক হয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি বিরক্ত হয়েছিলেন। এর পরে লালচাঁদ একটি ইংরেজি গান শুনিয়েছিলেন। সে দিন উপস্থিত দর্শকরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, অনুষ্ঠানশেষে ঘোষণা করা হয় লালচাঁদকে পিয়ানোটি উপহার দেওয়া হবে এবং তা দেবেন স্বয়ং গভর্নর। শ্রোতাদের করতালি আর প্রশংসায় সে দিন মন ভরেনি নবীনচাঁদের। একই গাড়িতে বাড়ি ফেরার সময়ে নবীনচাঁদ নীরব ছিলেন। শুধু সরোষে লালচাঁদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ সব গান-বাজনা সে কোথা থেকে শিখেছে। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে বিরক্তি এবং রাগ প্রকাশ করলে লালচাঁদের মা বলেছিলেন, একটু গান বাজনা করা খারাপ কিছু নয়। এই ঘটনায় কিন্তু লালচাঁদের সঙ্গীতচর্চা বন্ধ হয়নি।

প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের বহু স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ি

বাড়িতে সঙ্গীতচর্চার উপযুক্ত জায়গা না থাকায় লালচাঁদ তাঁর মাকে বার বার বলতে লাগলেন। নবীনচাঁদ প্রথমে রাজি না হলেও, স্ত্রীর কথায় কিছু দিন পরে আলাদা একটি বাড়িতে লালচাঁদের সঙ্গীতচর্চার অনুমতি দেন। ৯৮ প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে তাঁদের বসতবাড়ির কাছেই ২১ মদনগোপাল লেনের একটি বাড়িতে শুরু হয় লালচাঁদের সঙ্গীতচর্চা। প্রথমে বারাণসীর কাশীনাথ মিশ্রের কাছে ধ্রুপদের তালিম শুরু হয়। বিশ্বনাথ রাওয়ের কাছে ধামার, তারানা ও সরগমের তালিম নিয়ে ছিলেন। এর পরে লালচাঁদ টপ্পা-গুণী রমজান খানের কাছে টপ্পা ও টপ্‌খেয়াল শিখেছিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই লালচাঁদ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্য। এ ছাড়াও লালচাঁদ খেয়াল শিখেছিলেন গোপাল চক্রবর্তীর কাছে।

লালচাঁদের গায়কির মধ্যে এক দিকে যেমন ধামারের বাঁটের নিপুণ কারুকাজ, তারানা ও সরগমের অভিনব চমক ছিল, তেমনই ছিল টপ্পার মাধুর্য। তিনি যখন টপ্‌খেয়াল গাইতেন, তাতে বিদ্যুতের মতো তানলহরী ফুটে উঠত। এক দিকে খেয়ালের তান, অন্য দিকে টপ্পার অলঙ্কার ও দানাদার নকশার মিশ্রণ তাঁর গানে অভিনবত্ব এনে দিত। বাংলায় টপ্‌খেয়াল ও খেয়াল আশ্রিত গানের তিনিই প্রচলন করেছিলেন। এক দিন অপমানে, অভিমানে যে রাগসঙ্গীতকে আয়ত্ত করার প্রতিজ্ঞা তিনি করেছিলেন, অক্লান্ত সাধনায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা গানের এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।

তাঁর সঙ্গীত জীবন ছিল বৈচিত্রে ভরা। একটি আসরে লালচাঁদ গান গেয়েছিলেন অঘোরনাথ চক্রবর্তীর সামনে। আসরশেষে অঘোরনাথ তাঁর গানের প্রশংসা করে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন। সে দিন হয়তো লালচাঁদের মনে জমে থাকা সব অভিমান জল হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, সেই আসরে লালচাঁদ অঘোরবাবুকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন অতীতের সেই ঘটনার কথা। সব শুনে অঘোরবাবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’’

একবার লালচাঁদ তাঁর বাবার উপস্থিতিতেই এক আসরে গান গেয়েছিলেন। এই নিয়ে শোনা যায় এক কাহিনি। হিদারাম ব্যানার্জি লেনে গোকুলচাঁদ বড়ালের বাড়িতে গানের আসর বসেছিল। তাতে নিমন্ত্রিত ছিলেন নবীনচাঁদও। তবে বাবা আসবেন শুনে লালচাঁদ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজন লালচাঁদকে চিন্তামুক্ত করতে এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। আসরে লালচাঁদকে ছদ্মবেশে বসানো হয়েছিল। এক মুখ দাড়ি, মাথায় পাগড়ি। তার উপরে ঘরে একটি মাত্র ঝাড়বাতি জ্বলছিল। নবীনচাঁদের উপস্থিতিতে লালচাঁদ গান গাইলেও আলো-আঁধারিতে তিনি ছেলেকে চিনতে পারেননি।

সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন নবীনচাঁদ। নিয়মিত নিজের দফতরে তাঁকে নিয়ে যেতে শুরু করেন। তবে বিকেল পাঁচটা বাজলেই তাঁকে অফিসে ধরে রাখা যেত না। চলে যেতেন বিভিন্ন আসরে কখনও বা নিজের বৈঠকখানায় সঙ্গীতচর্চায় মগ্ন থাকতেন।

কলকাতায় বহু সঙ্গীত রসিকের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই বসত লালচাঁদের গানের আসর। তার মধ্যে এন্টালির ‘দেবগৃহ’, পাথুরিয়াঘাটার যতীন্দ্রমোহন ও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি উল্লেখযোগ্য।

লালচাঁদের গান প্রথম রেকর্ড করেন হেমেন্দ্রমোহন বসু তাঁর ফোনোগ্রাফ যন্ত্রে। প্রথমে সিলিন্ডার রেকর্ডে, পরে প্যাথে-এইচ বোসেস রেকর্ডে সেই গানগুলি প্রকাশিত হয়। লালচাঁদ ছিলেন অপেশাদার শিল্পী। সেই জন্যই তাঁর রেকর্ডে লেখা থাকত অ্যামেচার। তাঁর রেকর্ডের জনপ্রিয়তা গ্রামোফোন কোম্পানিকে এতটাই ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দিয়েছিল যে, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাঁকে উপহার হিসেবে একটি মোটরগাড়ি পাঠিয়েছিলেন। নবীনচাঁদ অবশ্য সেই গাড়ি ফেরত পাঠান। কারণ তার মাত্র কয়েক দিন আগেই ১৯০৭ সালের ১৪ মার্চ মাত্র ৩৭ বছর বয়সে লালচাঁদ প্রয়াত হয়েছিলেন। সে দিন হয়তো নবীনচাঁদ উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর ছেলে গায়ক হিসেবে কতটা সফল ছিল।

লালচাঁদের গাওয়া গানগুলির মধ্যে ‘তুমি কাদের কুলের বউ’, ‘তোমার ভাল তোমাতে থাক’, ‘হৃদয় রাসমন্দিরে’, ‘নবমী নিশি গো’, ‘আমারে আসতে বলে’ ইত্যাদি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। গ্রামোফোন কোম্পানি প্রকাশিত প্রথম বারো ইঞ্চি মোনার্ক রেকর্ডে তিনি বাংলায় তিনটি খেয়াল আঙ্গিকের গান গেয়েছিলেন। সেগুলি হল ‘কি রূপ হেরি’ —বাগেশ্রী, ‘মনেরি বাসনা শ্যামা ’—ভূপালি-বাগেশ্রী এবং ‘অনুগত জনে কেন’ —সিন্ধু-কাফি। বেশ কিছু হিন্দি গানও তিনি রেকর্ড করেছিলেন।

লালচাঁদ রেখে গিয়েছিলেন তাঁর তিন ছেলে কিষণচাঁদ, বিষণচাঁদ ও রাইচাঁদকে। তাঁদের ডাকনাম ছিল যথাক্রমে জলু, গঙ্গু ও রাই। জলু শিখেছিলেন বড়ে গোলাম আলির কাছে খেয়াল। আবার হাফিজ় আলি খানের কাছে সরোদ শিখেছিলেন গঙ্গু। রাইয়ের জন্য হাফিজ় আলিকে অনুরোধ করায় তিনি উস্তাদ মসিদ খানকে রায়পুর থেকে নিয়ে এসেছিলেন। রাইচাঁদ পরবর্তী কালে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তিনিই বাবার স্মৃতির উদ্দেশে শুরু করেছিলেন এক সঙ্গীত সম্মেলন— লালচাঁদ উৎসব।

শৌখিন রুচিসম্পন্ন লালচাঁদ নতুন একটি বাড়ি তৈরির কাজও শুরু করেছিলেন, যা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। ১/১ প্রেমচাঁদ বড়াল স্টিটের সেই বাড়িতে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম বসবাস করতেন। সেই বাড়ির প্রবেশপথের পাশেই আজও উঁকি দেয় তাঁর নাম লেখা প্রস্তর ফলকটি। সেটা আজও অমলিন।

ঋণ: সেকালের সঙ্গীতগুণী— দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়;

দ্য গ্রামোফোন কোম্পানিজ ফার্স্ট ইন্ডিয়ান রেকর্ডিংস— মাইকেল কিনিয়ার; শুরুর সেদিন— অরুণ চট্টোপাধ্যায়। দেশ বিনোদন ১৩৯১

Lalchand Baral Musical Artist Music লালচাঁদ বড়াল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy