Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

মনু গাঁধী বলতেন, বাপু ছিলেন তাঁর মা

১৯৪২ সালে মনুর মা-র মৃত্যুর পর ১৫ বছর বয়সি মনুকে বাবা জয়সুখলাল মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধার কাছে সেবাগ্রামে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত আত্মীয় মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ছায়াসঙ্গী: গাঁধীজির ডান দিকে মনু, বাঁ দিকে আভা। সোদপুর, ৯ অগস্ট ১৯৪৭

ছায়াসঙ্গী: গাঁধীজির ডান দিকে মনু, বাঁ দিকে আভা। সোদপুর, ৯ অগস্ট ১৯৪৭

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১৬
Share: Save:

কস্তুরবা মহাত্মার কাছে নালিশ করলেন— মনু এত তাড়াতাড়ি খায় বলে ওর গায়ে পুষ্টি লাগে না, রোগাই থেকে যায়। গাঁধী মনুর দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললেন, কাল থেকে তুমি আমার সঙ্গে খেতে বসবে। বা’ বললেন, ও কি তবে আর খেতে পারবে? বাপু জিজ্ঞেস করলেন, মনু, তুমি কি আমার সঙ্গে খেতে লজ্জা পাবে? মনুর উত্তর— না না, আপনার সামনে কেউ কি লজ্জা পেতে পারে? বাপু বললেন, আজকাল দেখি নিজের শরীরের কথা না ভাবাটা দেশে নতুন এক ধারা হয়েছে। এই কি এখন তোমাদের ফ্যাশন, দুর্বল রোগা শরীর তৈরি করা? খুবই লজ্জা পেলেন মনু। বললেন, বাপু, আমি কি ফ্যাশন বিষয়ে কোনও কালে কিছু জানি, না ভাবি? এক বছর ধরে আমি আপনার সঙ্গে রয়েছি। আপনি জানেন না, আমি সহজসরল, ফ্যাশন না-করা মানুষ? বাপু বললেন, তুমি অন্য সব ব্যাপারে সহজসরল, কেবল খাওয়ার সময়ই ফ্যাশনের কথা ভাবো।

ঠিক যেন বাবা-মায়ের সঙ্গে কন্যার কথার লড়াই! ১৯৪২ সালে মনুর মা-র মৃত্যুর পর ১৫ বছর বয়সি মনুকে বাবা জয়সুখলাল মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধার কাছে সেবাগ্রামে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত আত্মীয় মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার ঠিক পরই গাঁধী ও কস্তুরবা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে আগা খান প্রাসাদে অন্তরিন হলেন, সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল মনুকেও। চুপচাপ শান্ত, প্রীতিপূর্ণ মেয়েটি বাপু আর বা’-এর কাছে এক নতুন জীবন পেলেন, নতুন করে কন্যাস্নেহে সিক্ত হলেন। মনুর আসল কাজ যদিও অসুস্থ কস্তুরবার দেখাশোনা করা, ঘটনাচক্রে মহাত্মার সঙ্গে সঙ্গে থাকার সুযোগও পেলেন তিনি— মহাত্মার সব কাজে, সব অবসরে। গাঁধীর সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই-এর অসময়ের মৃত্যুই হয়তো এমন স্থান শূন্য করে দিয়েছিল মনুর জন্য।

ছয় বছর পর ভিড়ের মধ্যে পিছন থেকে এসে নাথুরাম গডসে এই মনুকেই ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পর পর তিনটি গুলিতে গাঁধীর দেহ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে, মৃদুলা গাঁধী বা মনুবেন যে ভারতীয় ইতিহাসের একটি আশ্চর্য রকম চেনা মুখ, তার কারণ মহাত্মার শেষ কয়েক বছরে তাঁর পাশে এত অব্যর্থ ভাবে মনুবেনকে দেখা যেত। শেষ দুই বছরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহাত্মার ‘ওয়াকিং স্টিক’, প্রতি মুহূর্তের নির্ভর।

দ্য ডায়েরি অব মনু গাঁধী ১৯৪৩-৪৪

অনুবাদ ও সম্পাদনা: ত্রিদীপ সুরহুদ

৭৫০.০০

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

১৯৪৩ সালের ১১ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালের সেই ৩০ জানুয়ারির পর আরও বাইশ দিন— ডায়েরি লিখেছিলেন মনু। মনে রাখতে হবে, ডােয়রি লেখা গাঁধীর শিক্ষায় সত্যাগ্রহীদের কাছে ছিল একটা জরুরি কাজ। আশ্রমিক সমাজের সকলকে তিনি এ কাজ করতে বলতেন। ডায়েরি না লিখলে, কী করে হবে আত্মনিরীক্ষণ, কী করেই বা হবে আত্মশুদ্ধি? ‘‘আমার মনে হয় ডায়েরি লেখার মূল্য বিরাট। কেউ যখন সত্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে, ডায়েরির মাধ্যমেই সে নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে পারে। সে তো জানে, ডায়েরিতে সে সত্য ছাড়া কিছুই লিখবে না!’’ লিখেছিলেন মহাত্মা। পরবর্তী কালের গবেষকরাও জানেন কী অ-মূল্য হতে পারে এই ডায়েরি, ঠিক যেমন হয়েছিল মহাদেব দেশাই-এর ডায়েরির সম্ভার— যার থেকে মহাত্মার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা জেনেছি। মনুর ছয় বছরের ডায়েরি এত দিনে গুজরাতি থেকে ইংরেজিতে পাওয়া গেল, ত্রিদীপ সুরহুদ-এর চমৎকার অনুবাদ ও সম্পাদনায়। প্রথম বইটি ডােয়রিসম্ভারের প্রথম খণ্ড, ১৯৪৩-৪৪ সালের কথা। সময়টির একটি আলাদা তাৎপর্য আছে: কেননা এই সময়কালের মধ্যে, ১৯৪৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয়েছিল কস্তুরবার।

গোড়ার সেই সময়ে, মনু তখন নিতান্তই পঞ্চদশবর্ষীয়া, কী যে তাঁর করার কথা, কেমন ভাবে করার কথা, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বুলেট পয়েন্ট-এ ডায়েরি লেখেন— প্রার্থনা, খাওয়া, পড়া, বাপু ও বা’-এর পায়ে ম্যাসাজ করা ইত্যাদি। গাঁধীর মন্তব্য থাকে পাশে। নীচে থাকে সই, ‘বাপু’। একেবারে প্রথম মন্তব্যটিতে বলা ছিল— কতখানি চরকা কাটা হল তার প্রতি দিনের হিসেব লিখে রাখা চাই। আর কী কী পড়া হয়েছে সারা দিনে, তাও লেখা চাই। এমন মন্তব্যও পড়া গেল, ‘‘হাতের লেখা ভাল করতে হবে! অন্যদের কাছ থেকে কী শিখছ লিখে রাখবে। বোঝা যাবে তুমি কতটা শিখতে পারছ।’’ মনু অবশ্য কিছু দিন পরই ডায়েরি না-দেখানোও শুরু করলেন, যখন নিজের মনের আবেগ-অনুভূতির কথা লিখতে শুরু করলেন। ডায়েরি আরম্ভের ঠিক এক মাস দশ দিন পর, ২১ মে ১৯৪৩, মনু লিখলেন, ‘‘আমি রোজ ডায়েরি লিখি, কিন্তু ওঁকে দেখাই না।’’

আশ্রমে অতি-শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের ছবি মনু-র এই প্রথম পর্বের লেখায় স্পষ্ট। স্পষ্ট সেখানকার কঠোর অনুশাসন, কিংবা ব্যক্তিজীবনের উপর শাসন। লক্ষ না করে উপায় কী, ‘আই হ্যাভ বিগান মেনস্ট্রুয়েটিং’ বাক্যটি কেমন একক— আগে-পরে আর কোনও উল্লেখ কিংবা চিন্তা কিংবা অনুভব ছাড়াই। ফলে বুলেট-পয়েন্টই হোক, আর অনুচ্ছেদই হোক, এ ডায়েরি পড়তে পড়তে কল্পনা না করে উপায় নেই, ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ কিংবা লেখার ভিতরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো ঠিক কী হতে পারে। বুঝতে ইচ্ছে করে, কিশোরী মনু কেমন প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন মানিয়ে নেওয়ার জন্য। বাপুর রুটি বানাতে দেরি হয়ে গেলে প্যারেলাল বকুনি দেন, অশ্রুধারায় ভাসতে ভাসতে মনু ভাবেন, সকলকে খুশি রাখার চেষ্টা করে, সব কাজ ভাল করে করার চেষ্টা করেও কেন এত বকুনি খেতে হয়। কস্তুরবা-র নীরব ভর্ৎসনা কিংবা বিরক্তির প্রকাশও মনুর চোখের জল বার করে আনে। বাপু অবশ্য সব কিছুর মধ্যে অবিচল ভাবে সস্নেহ সতর্ক। আর তাই, মনু বলে গেলেন সেই কথাটি, যা মনু ছাড়া আর কেউ কখনও বলেননি— ‘‘বাপু ছিলেন আমার মা।’’ মনু তাঁকে দেখেছিলেন মা হিসেবে, নারী হিসেবে। ‘‘বাপু জানতেন, কী ভাবে মা হতে হয়।’’ ভোর পাঁচটায় এসে বাপুই সন্তর্পণে ডেকে জাগিয়ে যেতেন মনুকে, অনেক কাজ যে সকাল থেকে। রাতে যে পাজামার দড়ি অত আঁট করে বেঁধে শুলে রক্তচলাচলে অসুবিধে হতে পারে, ঘুমেও ব্যাঘাত হতে পারে, মেয়েটিকে তাঁর বাপুই শিখিয়েছিলেন। বাপু বলেছিলেন, ‘‘তোমার মাকে অল্পবয়সে হারিয়েছ, তাই তিনি এ সব তোমায় শিখিয়ে যেতে পারেননি।’’ এক আশ্চর্য সম্পর্কের দিগন্ত আমাদের কাছে খুলে যায়। তাঁর আর তাঁর ‘বাপু’-মা’র সম্পর্ক আমাদের চেনাজানা ‘জেন্ডার-রোল’ বা লিঙ্গবদ্ধ চিন্তাকে বিরাট একটা ধাক্কা দিয়ে যায়।

সুরহুদ ভূমিকাতে বলেছেন— মনুর সঙ্গে বাপুর সম্পর্কের মধ্যে এক রকমের ‘পার্টনার’ বা সহচরের ভাব ছিল। আশ্রমের মধ্যে এক দিকে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রবল উপস্থিতি, আবার তার পাশেই এই সাহচর্যের পরিবেশ। পরবর্তী কালে (যা এই খণ্ডে নেই) মনুর সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে বাপুর ব্রহ্মচর্য-পরীক্ষার কথা আমরা জানি— সেখানেও কিন্তু এই সাহচর্যের বিষয়টি ছিল, কেননা মনুর মতামত নিয়েই ওই সিদ্ধান্ত নেন গাঁধী। কিছু দিন পর মনু যখন বলেন, গাঁধীর দুর্নাম হচ্ছে বলেই তিনি আর এই পরীক্ষায় রাজি নন— তখন বাপু এক কথায় এই ‘পরীক্ষা’ বন্ধ করে দেন। সুরহুদ এই প্রসঙ্গে একটা জরুরি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, সাধারণ ভাবে ব্রহ্মচর্যের যে অর্থ, গাঁধী সেই অর্থ করতেন না। তিনি মনে করতেন না যে, মেয়েরাই পুরুষের ব্রহ্মচর্য পালনে বাধা। তাঁর বিবেচনায়, একমাত্র অন্তরের বিশুদ্ধি ও সত্যের সন্ধান মিললেই পুরুষ স্বেচ্ছায় এই কঠিন ব্রতে উন্নীত হতে পারে।

তবে ‘কনসেন্ট’ বা মত বিষয়ে অন্য একটি নৈতিক প্রশ্ন উঠিয়েছেন সুরহুদ: গাঁধী নিজে কি কোনও ব্রহ্মচারীর এমন ‘যজ্ঞে’ শামিল হতে পারতেন? এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে তবেই গাঁধীর মনোদুনিয়ায় ‘কনসেন্ট’-এর সমতা বোঝা সম্ভব। তাঁর সত্যাগ্রহের গভীরতা ও ব্যাপ্তি বোঝা সম্ভব।

এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর মেলা সহজ নয়: তাই সুরহুদ এর নাম দিয়েছেন ‘আ পোজ়ার’। উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে গাঁধীকে আরও চেনাটাই বরং কাজ। আজকাল সাদা-কালো ন্যায়-অন্যায়ের চটজলদি তরল ও সরল বিচারে ভরে যাচ্ছে চতুর্দিক— সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সত্যাগ্রহীর সত্যকে আর একটু বোঝাটাই আমাদের কাছে জরুরি হওয়ার কথা। গাঁধীর সার্ধশতবর্ষে সে কাজে আমাদের অনেক সাহায্য করতে পারে ‘কন্যা’ মনু গাঁধীর ডােয়রি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

The Diary of Manu Gandhi Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE