Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জাদুর চোখে ভারতদর্শন

ঊনবিংশ শতক থেকেই ভারত আর ভারতীয় জাদু বিষয়ে পশ্চিমের আগ্রহ শুরু হয়।

বিশ্বসেরা: জাদুকর পি সি সরকারের (সিনিয়র) জাদু-প্রদর্শনীর সুভেনির। বই থেকে সংগৃহীত

বিশ্বসেরা: জাদুকর পি সি সরকারের (সিনিয়র) জাদু-প্রদর্শনীর সুভেনির। বই থেকে সংগৃহীত

কৌশিক মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯ ০০:৩০
Share: Save:

১৮৪৯ সালের ঘটনা। আইল অব ওয়াইটের ছোট্ট শহর বনচার্চে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য এক চ্যারিটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। একেবারে শেষের চমক ‘ম্যাজিক’। সারা গায়ে হাতে পায়ে কালো কুচকুচে রঙ মেখে, মাথায় ঝলমলে পাগড়ি আর চকচকে জোব্বা পরে মঞ্চে এলেন জাদুকর রিয়া রামা-রুজ়। তিনি নাকি বহু কাল হিমালয়ে থেকে জাদুবিদ্যা শিক্ষা করেছেন, যদিও তাঁর দেখানো জাদুর সব কটাই ছিল একশো শতাংশ পশ্চিমি। নিজের অজান্তেই এই জাদুকর ভদ্রলোক এক ‘কাল্ট’ তৈরি করলেন। ভারতীয় জাদুও যে মঞ্চে ভারতীয় সেজে দেখানো যায়, তা প্রথম হাতেকলমে দেখালেন তিনি। পরের সব জাদুকর, ফকির অব আভা, কালনাগ মায় পি সি সরকার— সবাই জেনে না জেনে তাঁর পথেই চলেছেন। ওই ভদ্রলোক কিন্তু জীবনে সেই একটি বারই মঞ্চে ম্যাজিক দেখান। অন্য সময় তিনি তাঁর আসল নাম ‘চার্লস ডিকেন্স’ ব্যবহার করে লেখালিখিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন!

ঊনবিংশ শতক থেকেই ভারত আর ভারতীয় জাদু বিষয়ে পশ্চিমের আগ্রহ শুরু হয়। বিশেষ করে কোম্পানির আমলের পরে যখন মহারানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নিলেন তখন প্রচুর ব্রিটিশ নাগরিক নানা কাজে এ দেশে আসতে শুরু করেন। ভারতীয় জাদু, তন্ত্রমন্ত্র, জাগলিং নিয়ে যত মিথ এত দিন ফিসফিসিয়ে ও দেশে ঘোরাঘুরি করছিল তা যেন আচমকা উত্তাল হয়ে উঠল। পি সি সরকার তাঁর ইন্দ্রজাল বইতে লিখছেন, “জ্যোতিষ বিদ্যা, যৌগিক ক্রিয়া, মনঃসংযোগ অভ্যাস, দ্রব্যগুণ প্রভৃতি বহু বিষয় এককালে গুরুমুখী বিদ্যা হিসেবে প্রচলিত ছিল। এর সবগুলিকে একত্রে জাদুবিদ্যা হিসেবে গণ্য করা হত।’’ আর এই নতুন অজানা বিদ্যার সন্ধান পেয়ে গোটা পশ্চিমি দুনিয়া যেন হামলে পড়ল। দুঃখের বিষয়, পশ্চিমি জাদু নিয়ে বেশ কয়েকটি মহাগ্রন্থ লেখা হলেও ভারতীয় জাদু নিয়ে গবেষক, বিশেষ করে ভারতীয় গবেষকরা একেবারেই নীরব। বহু বছর আগে অজিতকৃষ্ণ বসুর লেখা জাদু কাহিনী ছাড়া জাদুসাহিত্যের বই বাংলায় বিরল। ইংরেজিতেও বলার মতো বই অল্পই: লি সিগেলের নেট অব ম্যাজিক কিংবা পিটার লামন্টের আশ্চর্য লেখায় সমৃদ্ধ দ্য রাইজ় অব ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক। জন জ়ুব্রিস্কির আলোচ্য বইটি সেই অভাব অনেকটাই মেটাতে পেরেছে।

বিশাল পরিমণ্ডল নিয়ে লেখা ভারতীয় জাদুর ইতিহাসের এই অদ্ভুত আখ্যান শুরু হচ্ছে সেই হরপ্পার যুগ থেকে। গল্পের বুননে একে একে আসছে ‘মায়া’র কথা, আসছে দেবরাজ ইন্দ্রের জালের কাহিনি (ইন্দ্রজাল), রামায়ণ মহাভারতে জাদুর উল্লেখ, পালি ধম্মপদের গল্প, সুরুচি জাতক, আমির হামজ়া, জাহাঙ্গিরের দরবারে এক বাঙালি জাদুকর আর তাঁর বাঁদরের অদ্ভুত চমকে দেওয়া জাদু। এই অংশে লেখক ভারতীয় জাদু আর তাঁর উৎস খুঁজেছেন নানা বিরল কোষগ্রন্থে, জীবনী-আত্মজীবনীতে। সন্ধান করেছেন ভারতীয় জাদুর মূল কাঠামোটির। আর তাই পেরেকের বিছানায় শায়িত ফকির, বাজিওয়ালা, মাদারি, তামাশাওয়ালা, ঠগি, কলন্দর, সাপুড়ে— কেউ তাঁর গবেষণার বাইরে থাকেনি। আর সে গবেষণা থেকেই লেখক দেখিয়েছেন, চিরকালই জাদু এক প্রান্তিক কলা। আর এই প্রান্তিকতা এতটাই, যে ১৮৭১ সালে ‘ক্রিমিন্যাল ট্রাইবস অ্যাক্ট’-এর আওতায় বহু জাদুকরকে গ্রেফতারও হতে হয়েছিল।

জাদুওয়ালাজ়, জাগলার্স অ্যান্ড জিন্‌স/ আ ম্যাজিক্যাল হিস্টরি অব ইন্ডিয়া
জন জ়ুব্রিস্কি
৬৯৯.০০, পিকাডর ইন্ডিয়া

ঠিক এর পরেই লেখক আমাদের নিয়ে যান সেই সময়ে যখন পশ্চিম ধীরে ধীরে আগ্রহী হচ্ছে ভারতীয় জাদু আর জাগলিং নিয়ে। মুখ দিয়ে আগুন ওগরানো, তরোয়ালের ফলায় নিজেকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া ভারতীয় জাদুকররা কী ভাবে প্রথম কালাপানির বাধা পার হলেন। কী ভাবে ক্রীতদাসের মতো তাঁদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে পশুর সঙ্গে নানা ভদেভিল আর ট্রাভেলিং সার্কাসে রাতের পর রাত আধপেটা খেয়ে খেলা দেখাতে বাধ্য করা হত, আর কী ভাবেই বা মতিলাল নেহরু নামে এক উকিল এই জাদুওয়ালাদের হয়ে সওয়াল করে ইংরেজ সরকারকে তাদের আইন বদলাতে বাধ্য করেছিলেন, জ়ুব্রিস্কি তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা দিয়েছেন। এই অংশে জাদুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রক্ত, ঘাম, মাটির গন্ধ যেন এত বছর পরেও তাজা। পাশাপাশি চলতে থাকে আর এক কিংবদন্তি তৈরির কৌশল।

এমনিতেই ভারতীয় জাদুবিদ্যা নিয়ে সত্যি মিথ্যে নানা রং চড়ানো গল্প বিদেশে প্রচার করতেন ইম্প্রেসারিয়োরা, তাতে ঘি ঢালল ১৮৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘শিকাগো ডেলি ট্রিবিউন’-এর একটি খবর। ফ্রেড এস এলমোর নামের এক লেখক দাবি করেন যে তিনি নাকি ভারতে গিয়ে নিজের চোখে দেখেছেন এক ফকির মাটিতে বসে সোজা আকাশে দড়ি ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর সেই দড়ি বেয়ে উঠে আকাশে উধাও হয়ে যাচ্ছে ছয় বছরের এক বালক। ফকির তাকে ডাকলেও সে নামছে না। এ বার ফকির উপরে উঠছেন হাতে ছোরা নিয়ে। উপর থেকে শোনা যাচ্ছে ছেলেটির আর্তনাদ। একে একে খসে পড়ছে তার বিভিন্ন অঙ্গ। শেষে ফকির নেমে সে সবে কাপড় চাপা দিয়ে মন্ত্র বলতেই ছেলেটা আবার একগাল হেসে উঠে দাঁড়াল। এই খবর প্রকাশিত হওয়া মাত্র ইংল্যান্ডের থিয়জ়ফিক্যাল সোসাইটি উত্তেজিত হয়ে উঠল। মাদাম ব্লাভাটস্কি থেকে কোনান ডয়েল সবাই বলতে লাগলেন, যে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার কথা তাঁরা এত কাল বলে এসেছেন এ বার হাতেনাতে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ব্যাপারটা এতটাই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেল যে ট্রিবিউনের সাংবাদিক জন উইলকি নিজে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানালেন, আসলে গোটাটাই তাঁর নিজের মনগড়া গল্প। কিন্তু তত দিনে বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক’ লোকমুখে মিথে পরিণত হয়েছে, যে মিথ আজও সে দিনের মতোই শক্তিশালী।

এই বইতে লেখক সেই সব সাহেব জাদুকরদের কথা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, যাঁরা দাবি করতেন যোগীদের কাছ থেকে তাঁরা অলৌকিক ক্ষমতা পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই জীবনে ভারতে আসেননি। জাদুকর কেলার, কালনাগ, থার্স্টন, ব্ল্যাকস্টোন, কার্ল হার্ৎজ় আর হুডিনির সেই সব ম্যাজিকে পশ্চিমি জাদুকে কি অবাক করা পদ্ধতিতে ভারতীয় বানিয়ে দেওয়া হল, পড়তে পড়তে চমকে যেতে হয়। অবশ্য এ বিষয়ে সেরা মানুষটি ছিলেন বোধহয় জাদুকর পি সি সরকার (সিনিয়র)। জ়ুব্রিস্কি দেখিয়েছেন, নির্ভেজাল ভারতীয় জাদু, এমনকি সম্পূর্ণ নিজের উদ্ভাবিত জাদু কখনওই তাঁর জোরের জায়গা ছিল না। তবু তিনি অসামান্য এক শোম্যানশিপের জোরে একার কাঁধে ম্যাজিককে এক প্রান্তিক কলা থেকে ফাইন আর্টে যে ভাবে পরিণত করলেন তা দেখে আমেরিকান জাদুকর টমি উইন্ডসর বলেছিলেন, “সরকার ইজ় ডুয়িং মোর টু হেল্প কিপ ম্যাজিক অ্যালাইভ, অ্যান্ড কিপ ইট ইন দ্য পাবলিক আই, দ্যান এনিওয়ান আই নো অব।’’ তাঁরই অনুষঙ্গে এসেছে রয় দ্য মিস্টিক, রামস্বামী, গোগিয়া পাশা, লিঙ্গ সিংহ বা গণপতি চক্রবর্তীর কথা। গণপতির কাছেই তো শিক্ষানবিশি করেছিলেন পি সি সরকার (সিনিয়র)।

জন জ়ুব্রিস্কির এই বই নিজেই যেন এক ম্যাজিক শো। জাদু খেলার চরিত্ররা আসে-যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে অন্য প্রসঙ্গে, আসে রাজনীতি, সমাজ, কারুণ্য, বিষাদ, বিদ্বেষ, ভালবাসা, আনন্দ... মনে হয়, আরে, এই তো আমার দেশ! জাদুর চোখ দিয়ে এমন ভাবে ভারতদর্শন আগে কোনও দিন হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

PC Sorcar Book Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE