Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

উজ্জ্বল নক্ষত্রের পরিচয়

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইতিহাসে প্রথম বছরের বেঙ্গল একাডেমি পর্ব বাদ দিলে পরবর্তী সিকি শতাব্দীকে ‘রামেন্দ্র পর্ব’ বলে নির্দ্বিধায় চিহ্নিত করা যায়।

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০৭:৩২
Share: Save:

অনাদৃত নায়ক ইন্দ্রজ অর্জুন
দীপঙ্কর মিত্র
৩০০.০০, আনন্দ পাবলিশার্স

‘‘...মহাভারতে অর্জুন চরিত্র ঢাকা পড়ে গেছে কৃষ্ণ চরিত্রের অবিশ্বাস্য বিশালতায়। তবু, এ কাজ মহাকবির ইচ্ছাকৃত চেষ্টায়। একটু খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, পরিস্থিতির বিন্যাস এমনই ছিল, অর্জুন চরিত্র নিজস্ব পূর্ণতায় আসার সুযোগ কখনওই পায়নি। সবসময়েই থাকতে হয়েছে তাকে কৃষ্ণের অকল্পনীয় ব্যাপ্তির ছায়াতলে।’’ আবার এ কথাও ঠিক, ‘‘অর্জুন চরিত্র যেমন মহাকবি সযত্নে এঁকেছেন বীররসের তুলিতে, ওর বহু দোষ ত্রুটিগুলো দেখাতেও কার্পণ্য করেননি। সেটাই অর্জুন চরিত্রকে মহান করে তুলেছে। আমরা চিনেছি ওকে মানুষের পরিচয়ে।’’ লেখক মহাকাব্য তন্নতন্ন করে পড়েছেন, এই বইয়ে অর্জুন চরিত্রকে নিজস্ব কল্পনায় আরও একটু গভীর ভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। দেবতাদের বৃহত্তর পরিকল্পনার সুতীব্র চাপে নুয়ে পড়া এক ঐশী ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, যে বার বার জর্জরিত হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বের টানাপড়েনে, আবার সব ঝেড়ে ফেলে তৈরি হয় দৈবী ইচ্ছা পূরণে। শেষ বিচারে সে হয়তো সত্যিই ক্রীড়নকমাত্র, তবু তার নিজস্ব সত্তা বার বার উঁকি মারে, ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়। মহাভারতের কাহিনির ধারাবাহিকতায় অর্জুনকে কেন্দ্র করে এগিয়েছেন লেখক, দেখিয়েছেন তার মানসিক বিবর্তনকে, তার চোখে পাঠক দেখছেন পরিপার্শ্বকে। মহাকাব্যের এ এক অন্যতর পাঠ, অর্জুন চরিত্রের নিজস্বতাই এর উজ্জ্বল অভিজ্ঞান।

রামেন্দ্রসুন্দর স্মরণ গ্রন্থ/ ১৫০ বছরে শ্রদ্ধাঞ্জলি
সম্পাদক: রতনকুমার নন্দী ও অশোক উপাধ্যায়
৬৫০.০০, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ

‘‘সাহিত্য পরিষদের সারথি তুমি এই রথটিকে নিরন্তর বিজয় পথে চালনা করিয়াছ।’’ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর (১৮৬৪-১৯১৯) পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতে ‘রামেন্দ্র প্রশস্তি’তে লেখেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইতিহাসে প্রথম বছরের বেঙ্গল একাডেমি পর্ব বাদ দিলে পরবর্তী সিকি শতাব্দীকে ‘রামেন্দ্র পর্ব’ বলে নির্দ্বিধায় চিহ্নিত করা যায়। গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা স্থাপন থেকে জমি সংগ্রহ করে নিজস্ব ভবন নির্মাণ— বহু বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিষদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করে গিয়েছেন তিনি। শুরু করেছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন। অন্য দিকে, নিজে ছিলেন অত্যন্ত কৃতী বিজ্ঞানের ছাত্র, রিপন কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিয়ে ১৯০৩ থেকে আমৃত্যু অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞানের দুরূহ বিষয় ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই ছাত্রদের সহজ করে বোঝাতে যেমন তাঁর জুড়ি ছিল না, তেমনই বাংলায় বিজ্ঞান রচনাতেও তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। তাঁর ভাবনার জগৎ ছিল বহুপ্রসারী, বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্য দর্শন ব্যাকরণেও তিনি ছিলেন সমান ব্যুৎপন্ন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর, রচনা করেন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা। তাঁর সার্ধশতজন্মবর্ষে এই শ্রদ্ধার্ঘ্যের প্রথমাংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁকে নিয়ে ২২টি পুরনো লেখা (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে ভবতোষ দত্ত), পরিষদে সংরক্ষিত কিছু চিঠি এবং দ্বিতীয় অংশে আশীষ লাহিড়ী প্রসাদরঞ্জন রায় প্রমুখের দশটি নতুন লেখা। আছে বিস্তারিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি। পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে এতাবৎ অগ্রন্থিত রামেন্দ্রসুন্দরের দুটি ইংরেজি রচনা— জন টিন্ডাল ও টি এইচ হাক্সলিকে নিয়ে। সব মিলিয়ে বঙ্গ সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পরিচয় ফুটে ওঠে।

প্রবন্ধসংগ্রহ
দীপেন্দু চক্রবর্তী
৫০০.০০, এবং মুশায়েরা

তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধই প্রায় পাঠককে নতুন ভাবনায় পৌঁছে দেয়, ভাবনা-চিন্তা বা পর্যবেক্ষণের তেমনই নিজস্বতা দীপেন্দু চক্রবর্তীর। শুরুতেই বলেছেন এ-বই “সেইসব পাঠকের জন্য যাঁরা পণ্ডিত নন, অথচ মুড়ি-মুড়কির তফাতটা বোঝার ক্ষমতা রাখেন।’’ তাঁর এই প্রবন্ধসংগ্রহ কোনও অবিন্যস্ত সংকলন তো নয়ই, বরং বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ভিতর সেঁধিয়ে থাকা উদ্ভাবনকে পরখ করে দেখা, সময়ের নিরিখে, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে। গত শতকের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিকেরা অনেকেই উঠে এসেছেন তাঁর আলোচনায়, তাঁদের সূত্রে এসে পড়েছেন ভিনদেশি স্রষ্টারাও। যেমন বাংলা চলচ্চিত্রে তো বটেই, এমনকী বাংলা নাটকেও শেক্সপিয়ার-চর্চার অপ্রতুলতা নিয়ে একটি গদ্যের শেষে তিনি লিখছেন “আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশের বংশধর হয়েও শেক্সপিয়রকে শুধু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবস্তু হিসেবে বন্দি করে রেখেছি বহুকাল ধরে। অথচ উপনিবেশ না হয়েও রাশিয়া বা জাপান শেক্সপিয়রকে কতটা আপন করে নিয়েছে... ।” পাশাপাশি অন্য গদ্যে লিখছেন, “রুশদির মুখে ছাই দিয়ে বলা যেতে পারে বাংলা ছোটগল্পের যে-ঐতিহ্য তা পাশ্চাত্যের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে।” মেতেছেন গান নিয়ে লেখা গদ্যেও: “রবীন্দ্রনাথও বুঝেছিলেন তিনি যে গান রচনা করেছেন তা ব্যতিক্রমী... বুঝিয়েছেন কেন তাঁর গানে কথার প্রাধান্য, কেন তবলা ও হারমোনিয়ামের বদলে তিনি শান্তিনিকেতনে খোল ও এস্রাজের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছেন।” বড় স্বাদু তাঁর গদ্য, পড়তে পড়তে অনায়াসে ঢুকে পড়া যায় তর্কে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE