দলটির নাম ‘অ্যান্টিভাইরাস’। বছর তিনেক আগে পাঁচ জন শিল্পী একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছিলেন এই দল। সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল তাঁদের তৃতীয় সম্মেলক। আগের দু’জন শিল্পী এ বার অংশ গ্রহণ করেননি। নতুন কয়েক জন যোগ দিয়েছেন। মোট আট জন শিল্পীর ছবি নিয়ে আয়োজিত এ বারের প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ইন দ্য শ্যাডো অব প্যারানোইয়া’। বাংলায় বলা যেতে পারে ‘ভ্রান্তির ছায়ায়’। কিন্তু ‘প্যারানোইয়া’ জনিত যে ভ্রান্তি, তা সাধারণ ভ্রান্তি নয়। তার ভিতর থাকে এক ধরনের মানসিক বিকৃতির প্রকাশ, যে বিকৃতি আজকের ভোগবাদী, উচ্চাভিলাষী, বাজার ও প্রযুক্তি-অধ্যুষিত জীবন ও সমাজব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই ‘ভ্রম-বাতুলতা’-র বিরুদ্ধেই প্রতিবাদী ভাষ্য রচনা আলোচ্য প্রদর্শনীর একটি উদ্দেশ্য বলে প্রতিভাত করতে চেয়েছেন শিল্পীরা। যে ‘ভাইরাস’ বা দুষ্ট কীট জীবনকে কুরে কুরে ধ্বংস করে তারও বিরুদ্ধে তাঁদের জেহাদ। দলের নামের ভিতরেও তাঁরা সেই ইঙ্গিত রাখতে চেয়েছেন।
আবহমানের শিল্পকলায় প্রতিবাদীচেতনার প্রকাশ ঘটে থাকে সাধারণত দু’ভাবে। একটি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সৌন্দর্যকে ভেঙে ফেলে। দ্বিতীয়টি সৌন্দর্যের একটি আদর্শায়িত রূপ মানুষের সামনে উপস্থাপিত করে। আলোচ্য প্রদর্শনীতে প্রথম পথই অনুসরণ করেছেন অধিকাংশ শিল্পী। দ্বিতীয় পথের সামান্য আভাসও আছে দু’একজনের কাজে।
দলের একমাত্র মহিলা-শিল্পী সুজাতা চক্রবর্তী পণ্ডিত (জন্ম ১৯৭১)। জলরঙে ছ’টি ছবি করেছেন রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ এই শিল্পী, যার সাধারণ শিরোনাম ‘ফেয়ারওয়েল মাই ডিয়ার’। এ প্রদর্শনীতে তাঁর জলরঙের প্রকরণ অনেক পরিণত। আজকের মানবী চেতনার অন্তর্নিহিত বিষাদজনিত আত্মধ্বংসের প্রবণতাকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী অবয়বকে অভিব্যক্তিবাদী রীতিতে বিশ্লিষ্ট করে।
ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের চিত্রকলার শিক্ষক স্বপন কুমার মল্লিক (১৯৭০) একাধারে কবি ও চিত্রী। ‘প্যারানোইয়া’-র জটিল রূপ তাঁর চারটি ছবিতে বেশি পরিস্ফুট। বিকৃত যৌনতাকে তিনি কশাঘাত করেন। আবার এই বিকৃতির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য ও মূল্যবোধের আভাসও তুলে আনতে চান। তাঁর সুররিয়ালিস্ট ধর্মী উপস্থাপনায় কিছু কিছু চিত্রকল্প প্রতীকের রূপ নেয়। যেমন শুক্রকীট, শরীরের বিভিন্ন ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, গর্ভস্থ ভ্রূণ, মাছের কঙ্কাল ইত্যাদি। ‘নির্ভয়া: আই শ্যাল স্টিল সারভাইভ’ ছবিতে ন’টি ছোট চিত্রপটকে সমন্বিত করে গড়ে তুলেছেন বড় ছবি। ‘ইফ উই হোল্ড অন টুগেদার’ শীর্ষক সিন্থেটিক টেম্পারার বড় ছবিতে তিনি চাঁদের পূর্ণতা ও বিলয়ের প্রতিমাকল্পকে বৃত্তাকারে সাজিয়ে সেই প্রেক্ষাপটে মানব-মানবীর কামনাকে উপস্থাপিত করেছেন।
বিশ্বজিত্ দে-র (১৯৮২) ‘ওয়ান মান্থ এগো’ শীর্ষক তিনটি মিশ্রমাধ্যমের ক্যানভাসে নরনারীর সঙ্গমবদ্ধ শরীর জান্তবতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রেমের ধ্বংসের তীব্র হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয় তাঁর প্রবল শক্তিশালী প্রতিমাকল্পগুলো থেকে।
দিবাকর কর্মকার (১৯৭১) চারটি অনামা অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে পূর্ণ বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকৃতির উদাত্ত সৌন্দর্যের অন্তরালবর্তী এক বিপন্ন বিষাদকেও প্রতিধ্বনিত করিয়েছেন। এই আদর্শায়িত সৌন্দর্যকে উদ্ভাসিত করেই তিনি বিপরীত প্রান্তের ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভাষ্য গড়ে তুলতে চান।
অমিত কুমার দে (১৯৭৬) নাগরিক দৃশ্যাবলিকে বিশ্লিষ্ট করে তিনি উপস্থাপিত করেছেন সংঘাতময় এক ধরনের বিমূর্ততা তাঁর অ্যাক্রিলিকের দুটি ক্যানভাসে, যার ভিত্তিতে আলোকচিত্রের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ভোলানাথ রুদ্র (১৯৮৪) ‘কন্টিগুয়াস’ শীর্ষক চারটি জলরঙের ছোট রচনায় আকাশচুম্বী অট্টালিকাশ্রেণি যে ভাবে শহরের নিসর্গ ও প্রাণ ধ্বংস করছে তারই বিরুদ্ধে আংশিক বিমূর্তায়িত আলেখ্য তৈরি করেছেন। ভাঙনের মধ্যেও কোথাও অন্তঃশীল হয়ে আছে সুষমার সুর। তারই কিছু আভাস উঠে এসেছে প্রতুল রায় (১৯৬৭) ও গৌর চৌধুরীর (১৯৮২) ছবিতে। গৌরও অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে অবয়বী রূপকল্পে তিনি চেষ্টা করেছেন তমসার রহস্যকে উদ্ঘাটিত করতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy