Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যে অভিনন্দনরা ফেরেননি

১৯৭১-এ পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন ওঁরা। ৫৪ জন ভারতীয় সেনা— কেউ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, কেউ সুবেদার, হাবিলদার। সংবাদপত্রের খবর, পুরনো চিঠি সম্বল করে এখনও তাঁদের খুঁজে চলেছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা। ১৯৭১-এ পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন ওঁরা। ৫৪ জন ভারতীয় সেনা— কেউ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, কেউ সুবেদার, হাবিলদার। সংবাদপত্রের খবর, পুরনো চিঠি সম্বল করে এখনও তাঁদের খুঁজে চলেছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা। ঋকদেব ভট্টাচার্য

খোঁজ: বায়ুসেনার মিউজিয়মে বিজয় তাম্বের ছবির দিকে চোখ দময়ন্তীর। ছবি সৌজন্য: সুপ্রিয় সেন

খোঁজ: বায়ুসেনার মিউজিয়মে বিজয় তাম্বের ছবির দিকে চোখ দময়ন্তীর। ছবি সৌজন্য: সুপ্রিয় সেন

ঋকদেব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

তখন ছোট। বন্ধুদের বাবাকে দেখে মনে হত, আমার বাবা কোথায়? তার পর নিজে বড় হয়েছেন, নিজের সন্তানদেরও বড় করেছেন। তবু মনে থেকে গিয়েছে সেই প্রশ্ন, আমার বাবার কী হল?

মিনু জৈন। একাত্তরে হারিয়ে যাওয়া স্কোয়াড্রন লিডার এম কে জৈনের মেয়ে। তাঁর বাবার মতো এ দেশের মোট ৫৪ জন সেনার কোনও খোঁজ নেই ১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধের সময় থেকে। তাঁরা সবাই পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে নিখোঁজ। যুদ্ধ সে বার থেমেছিল। সিমলায় শান্তিচুক্তি হয়েছিল। দু’দেশের যুদ্ধবন্দিরা ফিরে গিয়েছিলেন নিজের নিজের ঘরে। ফেরেননি ওই ৫৪ জন। সশস্ত্র বাহিনীর ২৯ জন, বিমান বাহিনীর ২৪ জন, নৌসেনার এক জন। তালিকায় রয়েছেন লেফটেন্যান্ট, মেজর। হাবিলদার আছেন, সেপাইও। বিবিধের মাঝে মিল একটাই। তাঁরা কোথায়, কেউ জানে না।

অভিনন্দন বর্তমান ফিরে আসার পরে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন একাত্তরে নিখোঁজ মেজর এস পি এস ওয়ারিচের মেয়ে সিমি ওয়ারিচ। লিখেছেন, ‘ওয়েলকাম হোম উইং কমান্ডার অভিনন্দন। একাত্তরের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া পঞ্জাব রেজিমেন্টের যশপাল সিংহকে মাত্র ছ’বছর আগে ওমানে দেখা গিয়েছে। আমরা এ বার হারিয়ে যাওয়া ওই লোকগুলোকেও খুঁজে বার করি?’

সেপাই যশপাল সিংহ। বেঁচে আছেন। ওমান থেকে এই খবর নিয়ে এসেছিলেন শুকদেব সিংহ নামে এক ছুতোর। সে দেশের মশিরা দ্বীপে একটা জেল আছে। সেখানে মেরামতির কাজে গিয়েছিলেন শুকদেব। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বন্দি এক বৃদ্ধের। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। পাগড়ি পরা শিখ দেখে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিলেন, দেশ কোথায়। শুকদেব বলেছিলেন, দুরগি। পঞ্জাবের একটা গ্রাম। ওই বৃদ্ধ বন্দির কুটুমবাড়ি আবার দুরগিতেই। অনেককে চেনেন। গড়গড় করে বলে দিচ্ছিলেন বহু নামধাম।

বৃদ্ধ ওখানে জেলের হোমরাচোমরা লোকজনকে চা-জল দিয়ে আসেন। ওটাই তাঁর কাজ। লুকিয়ে-চুরিয়ে কয়েক বার দেখা করেছিলেন শুকদেবের সঙ্গে। জানিয়েছিলেন, তিনিই সেপাই যশপাল সিংহ। কোন রেজিমেন্ট, কত নম্বর— সব জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন আরও চার জন। কিছু দিন পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলেন। তার পরে তিন জনকে ওমানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

একাত্তরের যুদ্ধবন্দিদের কথা ১৯৮৯ সালে ভারতের প্রতিনিধিদের কাছে এক বার মেনে নিয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। ভিক্টোরিয়া শোফিল্ডের লেখা বেনজিরের জীবনীতেও এক আইনজীবীর কথা আছে। তিনি জানিয়েছেন, লাহোরের কোট লাখপত জেলে ভারতের যুদ্ধবন্দিরা রয়েছেন। দেওয়ালের এ পার থেকে তাঁদের চিৎকার শুনতে পেয়েছেন কোনও কোনও বন্দি।

১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয় পাকিস্তানে। সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ ক্ষমতা দখল করেন। পরে বসেন রাষ্ট্রপতির চেয়ারে। আর যুদ্ধবন্দি কাউকে ধরে রাখার কথা সরকারি ভাবে উড়িয়ে দেন। পরিজনদের নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের কয়েকটা জেল ঘুরিয়ে দেখাতে। প্রত্যাশিত ভাবেই, কাউকে খুঁজে পাননি তাঁরা। বলা হয়েছে, নেই যখন কী করবে? ধরে নাও, ওঁরা শহিদ হয়ে গিয়েছেন।

সে কথা দেশ বিশ্বাস করতে পারে। কিন্তু ঘরের লোকে কেন বিশ্বাস করবে? একটা লোকের থাকা-না-থাকা দেশের কাছে যেমন, বাড়ির লোকের কাছেও কি তেমন হতে পারে? হয় কখনও? যশপালের স্ত্রী বলজিৎ কৌর কী করে মেনে নেবেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই? কী ভাবে মেনে নেবেন অর্জুন পুরস্কার পাওয়া ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় দময়ন্তী তাম্বে, তাঁর স্বামী বিজয় বসন্ত তাম্বে মৃত? বায়ুসেনার মিউজিয়মে বিজয়ের ছবির নীচে লেখা থাকতেই পারে, যুদ্ধে গিয়ে শত্রু হানায় মৃত। কিন্তু দময়ন্তীর কাছে পাকিস্তানের খবরের কাগজ আছে। সেখানে নাম উল্লেখ করে স্পষ্ট লেখা, লোকটাকে জীবন্ত ধরা হয়েছে। তাঁর কাছে বিদেশের পত্রিকার ছবি আছে। সেই ছবিতে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে যুদ্ধে নিখোঁজ মেজর ঘোষকে। উপরে এক জোড়া চোখ। দময়ন্তীকেও কি তা হলে বাকিরা বলে দেবে, ওটা বিজয়ের চোখ নয়? অন্য লোকে তাঁকে চেনাবে বিজয়ের চোখ?

দময়ন্তীর যখন তেইশ বছর বয়স, সংসার পেতে উঠতে না উঠতেই বিমান নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন বিজয়। তার পরে কী হল লোকটার? ২০০৭ সালে সুপ্রিয় সেন একটা তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, নাম ‘হোপ ডাইজ় লাস্ট ইন ওয়ার’। সেই ছবিতে দময়ন্তী চোয়াল শক্ত করে একের পর এক প্রমাণ বার করে দেখিয়েছেন, লোকগুলো যুদ্ধে মরে যায়নি। কাঁদেননি দময়ন্তী। কখনও না। বরাবর স্পষ্ট বলে এসেছেন, দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে লড়াই করেছেন ওই চুয়ান্ন জন। তাঁদের স্বাধীনতার জন্য দেশের মানুষেরও লড়াই করা দরকার। তিনি হাসিমুখেই কথা বলেন। অদ্ভুত একটা হাসি। বলেন, “আমার এখনও সেই মুখটা মনে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি এখন ফিরে আসে? কী রকম দেখতে হবে এই বুড়ো বয়সে? আর যদি ওই সাতাশ বছরের চেহারাতেই ফিরে আসে? এসে দেখে, আমি এ রকম বুড়ো হয়ে গিয়েছি? কেমন লাগবে ওর?”

দেশের মাটিতে গাছের মতো, মানচিত্রে ভারতমাতার মতো স্থির দময়ন্তী। সময় না কি সব থিতিয়ে দেয়? কাজের বেলায় সে দোলাচল বাড়ায়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কিছু হলেই বেজে ওঠে দময়ন্তীর ফোন। সবাই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।

এই অপেক্ষারও একটা শেষ আছে, দময়ন্তীরা জানেন। শুধু জানেন না, শেষটা কখন, কোথায়, কী ভাবে? সুপ্রিয়ই জানালেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে মারা গিয়েছেন আশুতোষবাবু— মেজর এ কে ঘোষের দাদা আশুতোষ ঘোষ। যিনি বিদেশি পত্রিকায় ভাইয়ের গরাদ-বন্দি ছবির পাশে কলেজ-জীবনের একটা ছবি ফেলে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মিলিয়ে দিতে পারতেন— এই চোখ। এই নাক। এই থুতনির এখানটা। মারা গিয়েছেন নিখোঁজ ক্যাপ্টেন রবীন্দ্র কাওরার মা-বাবাও। যাঁরা বলতেন, এসপার বা ওসপার, কিছু একটা হয়ে যাক। ছেলেটা বেঁচে আছে? হ্যাঁ কি না? বলতে বলতে আবার নিজেদের মধ্যেই গজগজ শুরু করে দিতেন। কার ইচ্ছা ছিল ছেলে সেনায় যাক? বাবার না মায়ের? ছেলের তো ইচ্ছা ছিলই। আর কার ছিল? তাঁদের কোনও অনুযোগ ছিল না। দেশের প্রতি তো নয়ই। শুধু একটা সত্যের মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন। এসপারও হয়নি। ওসপারও হয়নি।

দময়ন্তীর তুলে রাখা পাকিস্তানের পত্রিকার কাগজটা আরও হলুদ হবে। আর এই সমস্ত তথ্য, লেখা, শব্দ বা ছবি অভিজ্ঞান হয়ে থেকে যাবে নিখোঁজ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মেঠারাম আডবাণীর মেয়ে ডলির কাছে। তোলা থাকবে তাঁর ছোট্ট ছেলেটার জন্য। গোটা জগৎটা এখন একটা মস্ত শেলফ। তাকে তাকে কথা রাখা থাকে। দেশের কাছে তথ্য আর দশের কাছে অ্যালবাম। স্যালুট জানাতে নিহত জওয়ানদের কফিনের সামনে বেজে ওঠে বন্দুক। ঋজু হয়ে ওঠে জাতির মেরুদণ্ড। আর ডলিদের বুকের ভিতরে একটা বিস্ফোরণ হয়।

সেই বিস্ফোরণের মানুষগুলো মরে যায়।

শহিদ হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE