হাইওয়ে। চকাচক পথ। শাঁইশাঁই গাড়ি। আমি আর দিদি বকমবকম করতে করতে ফিরছি। রাস্তা এ বার ক্রমে আলুথালু হচ্ছে। সাংঘাতিক অবস্থা। এখানে গর্ত, ওখানে উঁচু, সেখানে পাতালের কাছে ঢাল নেমে গেছে হাত দেড়েক। আমাদের গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা বেশ টাল খাচ্ছে। গাড়ির এ-দিক এক বার, ও-দিক এক বার।
সাঁতরাগাছি এসে পড়লাম। একটা ব্রিজ মতো সামনে। তার আগে একটা বেশ খটমটে বাঁক, আর সেখানে রাস্তার কারুকার্য একদম সূক্ষ্ম শিল্পের পর্যায়ে উতরেছে। সেই বাঁক বেয়ে আমাদের গাড়ি যাওয়ার সময় দেখলাম, কোথা থেকে দুটো বড় আপদ উপস্থিত। একটা তো দৈত্যের মতো। অমন ট্রাক আমি জীবনে দেখিনি। অত বড়, আর অত ধাপে, কী করে একটা গাড়ি তৈরি হয়, তা-ই আশ্চর্যের। আমার ড্রাইভার খুব আপার হ্যান্ড নিয়ে বলল, ‘দিদি, ওটাতে গাড়ি আছে।’ তাই নাকি? মানে গাড়ির ফ্যাক্টরি থেকে গাড়ি ডেলিভারি হবে শো-রুম বা ডিলারের কাছে। ওই ট্রাক-ড্রাইভারের প্রতি ভারী সমীহ হল। দ্যাখো, কেমন দু-তিন, কিংবা ছ-সাত দিন ধরে অত বড় ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তো!
হঠাৎ খেয়াল পড়ল, বাঁ দিকের একটা মাঝারি ট্রাক প্যাঁক প্যাঁক করে একনাগাড়ে জোরসে হর্ন দিচ্ছে। বড় ট্রাকের প্রতি প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়েই বুঝতে পারলাম, একটা ঘোরতর সিচুয়েশনে পড়েছি! আমাদের গাড়িটা বড় ট্রাক আর মাঝারি ট্রাকের মধ্যে ঢুকে গেছে, আর প্রত্যেকেই তখন বাঁক নেওয়ার জন্য যার যার প্রয়োজন মতো গাড়ি টার্ন নেওয়ার চেষ্টা করছে।
মুহূর্তের মধ্যে আমি আর দিদি একেবারে সিঁটিয়ে গেছি! দুজন দুজনকে খামচে ধরেছি। কথা সরছে না মুখ দিয়ে, হৃৎপিণ্ড ঠোঁটে। যে বড় ট্রাকের প্রতি আমি এত ক্ষণ মুগ্ধ ছিলাম, দেখলাম সেই ট্রাকটা আমাদের গাড়ির ওপর আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে। আমাদের ড্রাইভার আর পাশের লরির ড্রাইভার প্রাণপণ হর্ন বাজাচ্ছে। কিন্তু এ কিছু হওয়ার নয়। আমি বেশ বুঝতে পারছি— এই যে সময়টা বাঁচছি, এটাই হয়তো আমাদের জীবনের শেষ কয়েকটা মুহূর্ত। এর পর ট্রাকটা আমাদের গাড়ির ওপর সপাটে পড়বে আর আমরা থেঁতলে যাব।
মৃত্যুর সময় মানুষের কী মনে হয়, কী মনে পড়ে? শুনেছি গোটা জীবনটা নাকি খুব ফাস্ট ফরওয়ার্ড হয়ে চোখের ওপর দিয়ে এক বার চলে যায়! আমি তো কিচ্ছু মনে করতে পারলাম না। প্রিয়জনদের মুখ— কই তা-ও মনে পড়ছে না তো। কেবল পল গুনছি যে, কখন ট্রাকটা এসে চৌচির হবে আমাদের গাড়ির ওপর। শেষ কিছু সেকেন্ড চোখ বুজে ছিলাম। প্রতীক্ষায়।
কিন্তু থেঁতলে গেলাম না দেখে সাহস করে চোখ খুললাম। দেখলাম আমার ড্রাইভার অসম্ভব নিপুণতায়, ঠান্ডা মাথায় এবং একটা অবিশ্বাস্য সরু ফালির মধ্যে দিয়ে গাড়িটাকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, ট্রাকটা ওই লরিটার ওপর হেলে পড়েছে। লরির চালক বুদ্ধিমান ছিল। সে আর তার হেল্পার কোনও মতে লরি দাঁড় করিয়ে লাফিয়ে নেমে তখন পাঁইপাঁই দৌড়চ্ছে।
আমি আর দিদি ঘেমে জল। চোখে জল। আনন্দের না আতঙ্কের, এখনও জানি না। ভেতরটা এমন থরথর করে কাঁপছিল যে বাকি রাস্তায় আমার ড্রাইভারকে ধন্যবাদ বলার জন্যও শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট খুলে উঠতে পারিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy