Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৭
Rabibashoriyo Novel

মায়া প্রপঞ্চময়

প্রথমটায় তিন জনকেই হতাশ লাগছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুনে সবাই মিলেই কোরাসে নির্ভেজাল খুশির হুল্লোড় শুরু করে দেয়।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৪০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: মানিকের চিন্তা থেকে বর্তমানে ফেরে অন্নু। তার কর্মক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে জটিলতা। সামলানোর জন্য যেতেই হবে তাকে। ও দিকে অভিনেত্রী মিষ্টি পান তাঁর উপহার পাওয়া দু’কাঁদি কলা নিয়ে এসেছেন চিড়িয়াখানার জীবজন্তুদের খাওয়াতে। তাঁর ধারণা, চিড়িয়াখানার জীবজন্তু ভাল করে খেতে পায় না। বড়বাবু হাল ছেড়ে দেওয়ায় ঘটনা সামলায় অনিকেত। চিড়িয়াখানার রসুইঘরের যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে মিষ্টিদেবীকে অবাক করে দেয় সে।

অনিকেতকে স্বস্তি দিয়ে মিষ্টিদেবী আরও বললেন, ‘‘আপনার পরামর্শ না নিয়ে ভবিষ্যতে আর এমন করছি না। আর আপনাকে বলা রইল, আমিও একজন অ্যানিম্যাল লাভার। যদি এই চিড়িয়াখানার জীবজন্তুর খাওয়া-দাওয়া কিংবা আদর-যত্ন নিয়ে কেউ কখনও সমালোচনা করে তবে আমাকে একটু জানাবেন। কী করে ওদের মুখের মতো জবাব দিতে হয় সেটা আমার জানা আছে। আজ তা হলে উঠি, পরে এক দিন আরও অনেক কিছু জানব আপনার কাছ থেকে।’’

পাঁচ মিনিট বলে উনি বাস্তবে প্রায় আধ ঘণ্টা পর ওর চেম্বার থেকে খুশিমনে বিদায় নেন। উনি সবে গেট পর্যন্ত গিয়েছেন কি যাননি, হুড়মুড়িয়ে বড়বাবু ঘরে ঢুকলেন, পিছন-পিছন মি. হালদার আর স্টোর-ইনচার্জ শ্রীগৌরহরি চ্যাটার্জি। বড়বাবু গরুড়ের ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বলে উঠলেন, ‘‘আর পারি না, স্যর! কী দিলেন আপনি! আজ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেউ মন দিয়ে এত ক্ষণ চিড়িয়াখানার কথা শোনেননি। আরও যা বুঝলাম, এর পর থেকে ওঁর কলার ধাক্কা আর সামলাতে হবে না। কৌতূহল সামাল দিতে না পেরে আপনার জানলার বাইরে কান পেতেছিলাম। ব্লাইন্ড দেওয়া আছে তো, তাই ভিতর থেকে দেখতে পাননি।’’

অনিকেত রাগ করবে না হাসবে, ভাবার আগেই গৌরবাবু খেই ধরলেন, ‘‘অনেক কিছুই বললেন স্যর, কিন্তু এখানকার ম্যাকাও, প্যারট, প্যারাকিটরা যে অত দামি কাজু, আখরোট, পেস্তা আর কিসমিসও খায়, সেটা মিস হয়ে গেল। এ ছাড়া ভালুকের মধু-পায়েস আর হাতির খিচুড়ি-রুটি-তরকারিটাও বাদ পড়ে গেল... যাকগে!’’

মি. হালদার যোগ করলেন, ‘‘পাঁচ মিনিটের প্যাকেজে উনি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে যা সব বললেন, তাই শুনেই আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল, ম্যাডামেরও বোধ হয় সবটা একবারে হজম হত না। আমি কাশ্মীর আর অরুণাচল, দুটো ফ্রন্টেই ফিল্ড ডিউটি করেছি, আর্মিতে কী কী ফেসিলিটি আছে তা মুখস্থ। এখানে আমার দু’বছর হতে চলল, কিন্তু জীবজন্তুরা কী ফেসিলিটি পায়, আজকের আগে পুরোটা জানতাম না!’’

অনিকেত ঘাড় নাড়ে, ‘‘না জানাটা দোষের নয়, তবে আমাদের উচিত নিজেদের কাজ সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল থাকা আর সুযোগ পেলে সেগুলো পাবলিককেও জানানো, তাতে ভুল ধারণাগুলো দূর করা যায়। আমি এখানে জয়েন করার পর পরই যখন প্রথমে ক্যামেরায় ছবি তোলা আর পরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে ফুটেজ নেওয়া শুরু করি, তখন হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন যে, আমি চিড়িয়াখানার সেট-আপ আর কর্মচারীদের অবিশ্বাস করে এ সব করছি। আপনাদের ধন্যবাদ যে, আপনারা আমাকে ভরসা করে সময় দিয়েছিলেন। আজ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, ওই সব প্রমাণ নিয়ে আমি পজ়িটিভ জনমত তৈরির চেষ্টা করে গিয়েছি। আজ মিডিয়া চিড়িয়াখানার বিরুদ্ধে নয়। এখানকার প্রশাসনিক সমস্যাগুলো তারা বোঝে, কারণ বারবার আমি মিডিয়া-পার্সন আর প্রভাবশালীদের কাছে কালীপুর চিড়িয়াখানার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’’

অন্যরা চুপ করে কথাগুলো শোনে, তার পর গৌরবাবু বলেন, ‘‘শুধু সেটুকুই নয়, আমাদের দীর্ঘ দিনের সমস্যাগুলোও যতটা পেরেছেন মেটানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা আপনাকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস আর ভরসা করি। আমরা চাই, আপনি এখান থেকেই সসম্মানে অবসর নিন। কেউ আপনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেনি এত দিন, করবেও না। চিড়িয়াখানার জীবজন্তু হোক বা মানুষ, সবাই আপনাকে ভালবাসে।’’

অনিকেত বিষণ্ণ হাসি হাসে, বলে, ‘‘আমার দিন বোধ হয় ফুরিয়ে আসছে এখানে। হয়তো আমি যা পছন্দ করি, যাকে বা যাদের নিজের বলে ভাবতে শুরু করি, আমার অদৃষ্ট সেটাই আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। বারবার এমন হয়েছে আর আমি আগে থেকে সেটা টের পাই। তবে যাওয়ার আগে আর দু’একটা জিনিস কালীপুর চিড়িয়াখানার জন্য করে যাব আমি, যাতে আপনারা আরও কয়েকটা দিন আমাকে মনে রাখেন!’’

বড়বাবু বলেন, ‘‘স্যর, আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। গত তিন বছর ধরে দেখে আসছি, আপনি আগেভাগে যা বলে দিয়েছেন, সবই বাস্তবে ফলেছে। আপনাদের পিঠে দুটো অদৃশ্য ডানা আছে, সরকারি অর্ডারে সেগুলো আচমকা গজিয়ে ওঠে আর আপনারা সব ফেলে চলে যান, আমরা সেটা জানি। মন চাইলেও আটকাতে পারব না। তবে স্যর, আপনি কি চলে যাওয়ার আগে চিড়িয়াখানায় অ্যালজেবরা কচ্ছপ আনার কথা বলছেন?’’

অনিকেত ছদ্ম রাগ দেখায়, ‘‘আঃ বড়বাবু! ওটা অ্যালডেবরা টরটয়েজ়, বীজগণিত নয়। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, এঁরা এখনও জানেন না তাই খুলে বলছি। আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপ্রধান কূটনৈতিক সফরে এক দ্বীপরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ওখানকার রাষ্ট্রপতি জানতেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওদের এলাকা থেকে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি চারটে অল্পবয়সি অ্যালডেবরা জায়ান্ট টরটয়েজ় এনে তার একটা লর্ড ক্লাইভকে ভেট দিয়েছিল। সেটা দীর্ঘ দিন বারাকপুর লাটবাগানে ছিল। ১৭৬৭-তে লর্ড ক্লাইভ ভারত ছাড়েন আর ১৮৭৫-এ কালীপুর চিড়িয়াখানা পত্তন হলে ওই কচ্ছপটাকে চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হয়। তখন তার বয়েস মাত্র একশো কুড়ি বছর। ২০০৬-এ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে প্রায় আড়াইশো বছর বয়সে মারা যায়, নাম রাখা হয়েছিল মান্ধাতা। ওর মৃত্যুর খবরটা সেই দ্বীপরাষ্ট্রের লোকেরাও জানে। তাই শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় ও দেশের রাষ্ট্রপতি কালীপুর চিড়িয়াখানায় মৃত মান্ধাতার স্মৃতিতে আর-একটি জায়ান্ট টরটয়েজ় উপহার দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিছু দিন আগে প্রস্তাবটা আমাদের কাছে আসে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক মারফত, আমরা ওই উপহার নিতে আগ্রহী কি না।’’

বড়বাবুর কিছুটা জানা আছে বলে চুপ করে থাকেন, বাকি দু’জন এক সঙ্গে হাঁ-হাঁ করে ওঠেন, ‘‘এ তো দারুণ একটা খবর! তা হলে আমরা রাজি বলে জানিয়ে দিয়েছেন তো? দেশে আর কোথাও এ ধরনের কচ্ছপ নেই, দারুণ অ্যাসেট হবে আমাদের!’’

অনিকেত বলে, ‘‘না, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আমি বিদেশ মন্ত্রককে জানিয়ে দিলাম যে, সেন্ট্রাল জ়ু অথরিটির নিয়ম অনুযায়ী আমরা চিকিৎসা আর প্রাণ বাঁচানো ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও সিঙ্গল অ্যানিম্যাল জ়ু-তে গ্রহণ করতে পারি না৷ আমাদের যখন উপহার দেওয়াই হচ্ছে, তখন একটা জুটি অর্থাৎ মেল-ফিমেল এক সঙ্গে দেওয়া হোক। একটু জুয়া খেলেছিলাম, স্বীকার করছি। কেন না বিরক্ত হয়ে ওঁরা কিছু না-ও দিতে পারতেন। তবে কাল অফিশিয়ালি খবর এসেছে যে, আমরা এক জোড়াই হাতে পাচ্ছি। সব কিছু মিটিয়ে মাসখানেকের মধ্যেই ওরা এখানে আসবে। এক জোড়া কিশোর-কিশোরী, বয়েস যথাক্রমে পঁয়ত্রিশ ও ত্রিশ বছর!’’

প্রথমটায় তিন জনকেই হতাশ লাগছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুনে সবাই মিলেই কোরাসে নির্ভেজাল খুশির হুল্লোড় শুরু করে দেয়। মি. হালদার বলেন, ‘‘সবই লর্ড কৃষ্ণের ইচ্ছা, আপনি তো নিজের জন্যে চাননি, চিড়িয়াখানার ভাল ভেবে চেয়েছেন। তাই অলমাইটি আপনার চাহিদা পূরণ করেছেন।’’

ভদ্রলোক খাঁটি কৃষ্ণভক্ত, সবাই জানে। গৌরবাবু বলেন, ‘‘স্যর, আপনি মনেপ্রাণে একটা গন্ডার চাইছিলেন, যে হেতু বিপুলের কোনও সঙ্গী নেই। একটা মা-মরা, কাকে-ঠোকরানো মরণাপন্ন এক মাস বয়সের বাচ্চা গন্ডার জলদাপাড়া থেকে এসে পৌঁছল। সবার সাহায্য নিয়ে তাকে বড় করলেন, এখন সেই রতনপ্রসাদ আমাদের অ্যাসেট। মন থেকে চাইছিলেন বাচ্চা হাতি আসুক চিড়িয়াখানায়, কারণ কেন্দ্র থেকে চাপ দিচ্ছে বড় হাতি রাখা চলবে না। দু’টো অনাথ বাচ্চা হাতি এল।’’

বড়বাবু তার সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘বা রে, গত বছরের কথা ভুলে গেলে? স্যর এক দিন বললেন, কালুরও তো বয়স হচ্ছে, ওর এক-আধটা সঙ্গী থাকলে বেশ হত! দশ দিনও কাটল না, কাস্টমস আর ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরো মিলে তিনটে বাচ্চা শিম্পাঞ্জি, চারটে মার্মোসেট বাঁদর, একটা ক্যাপুচিন বাঁদর আর দুশোর মতো দেশি-বিদেশি নামীদামি পাখি সিজ় করে মহামান্য আদালতের আদেশে চিড়িয়াখানায় জিম্মা দিয়ে চলে গেল। আপনার কিছু দৈবী ক্ষমতা আছে স্যর, আপনি মন থেকে চাইলে সেটা পেয়ে যান।’’

অনিকেত মনে-মনে করুণ হাসি হাসে, ‘‘হ্যাঁ, আমি বিরাট দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন বটেই, সে জন্যেই তো পাঁচ বছর বয়স হতে না-হতেই বিদেশি কনসার্নে মোটা মাইনের কর্মচারী বাবা তৎকালীন সরকারি সিদ্ধান্তে কোম্পানি ন্যাশনালাইজ়েশনের ধাক্কায় চাকরি খোয়ালেন। নিজে লেখাপড়ায় ভাল রেজ়াল্ট করার সুবাদে সরকারি স্টাইপেন্ড আর স্কলারশিপ নিয়ে আগাগোড়া পড়তে পেরেছি ঠিকই, কিন্তু টিচারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে না পারায় সব সময়ই আমাকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। মাস্টার্সেও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে পারতাম না, যদি না ঠিক তার আগেই সর্বভারতীয় গবেষণার প্রবেশিকা পরীক্ষায় রাজ্য স্তরে ফল বেশ ভাল হত! তার পর জীবনটা ঠিক গড়ে ওঠার মুখে যা ঘটল...’’

মনের কথা মনেই থাকে ওর, সব কথা সব পরিবেশ আর সময়ের জন্য নয়, কিন্তু ওর মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করে মি. হালদার। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলেন, ‘‘স্যর, প্রায়ই ভাবি জিজ্ঞেস করব, চন্দনদস্যু বীরাপ্পন তো কর্নাটক-তামিলনাডুর জঙ্গলে দীর্ঘ দিন দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। আপনিও তো ট্রেনিং ও তার পরে বেশ কিছু দিন ও সব দিকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন, ওর গল্পগুলো সব সত্যি?’’

প্রসঙ্গ বদলাতে অনিকেতও স্বস্তি পায়। বলে, ‘‘বীরাপ্পন সম্বন্ধে অনেক কিছুই সরকারি সিস্টেমে তখন সেন্সর করা হত, এতটাই আতঙ্ক আর হিংস্রতা জড়িত ছিল সে সব ঘটনায়। আমরা যখন ১৯৮৯-৯০ সালে প্রথম বার তামিলনাডুর নীলগিরি রেঞ্জ আর কর্নাটকের নাগারাহোল-বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্কে ট্যুর করছি। তার বছরচারেক আগেই বীরাপ্পন বিরোধী পোচার দলের নেতা থাঙ্গাভেলু আর তার ভাইদের একটা সমঝোতা ডিনারে ডেকে খাইয়ে-দাইয়ে, গুলি করে মেরে, গলা কেটে পুলিশের খাতায় ঠান্ডা মাথার খুনি হিসেবে নাম তুলেছিল। কর্নাটক আর তামিলনাডু, দুই রাজ্যেরই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট জঙ্গলের বহু এলাকায় কড়া রেস্ট্রিকশন জারি করেছিল শুধু ওর জন্য।

‘‘বীরাপ্পন বারো বছর বয়সেই কাঠ চুরি আর হাতি শিকার, কুড়ি বছর বয়সের আগেই মানুষ খুনে হাত পাকিয়ে ফেলেছিল। আসলে ’৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দুরাইস্বামী বলে এক ফরেস্ট গার্ড এবং সুব্রহ্মণ্যম নামে এক ওয়াচারকে ধরে চোলাই তৈরি করার ড্রামে ভরে জ্যান্ত সেদ্ধ করেছিল বীরাপ্পন। তার পর পরই চিদম্বরম নামে এক জন ডাকাবুকো ফরেস্ট রেঞ্জারকে প্রথমে পাথর দিয়ে থেঁতো করে, তার পর কুঠার দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটেছিল। সাইকোপ্যাথ লোকটাকে বিশাল জঙ্গল এলাকার মানুষ ভয়ঙ্কর রাক্ষস বা পিশাচ বলে ভয় পেত। ভাবা যায়, একটা মানুষ তার চল্লিশ বছরের ক্রিমিনাল লাইফে দু’হাজার হাতি মেরে প্রায় চল্লিশ হাজার কেজি হাতির দাঁত আর আনুমানিক দশ হাজার টন চন্দনকাঠ পাচার করেছিল!’’

দাম হিসেব করার চেষ্টা করেও হাল ছেড়ে দেন বড়বাবু। তাঁর চোয়াল ঝুলে পড়ে। অনিকেত বলে, ‘‘বীরাপ্পনের মাথার দাম দুই রাজ্যের সরকার মিলে ধার্য করেছিল তিন কোটি টাকা, যা ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে একটা রেকর্ড। তবে কি না একশো কুড়ির বেশি মানুষ মেরে বীরাপ্পনও রেকর্ড করে ফেলেছিল, যাদের মধ্যে চুয়াল্লিশ জন ছিল পুলিশ, ফরেস্ট, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স আর বিএসএফ-এর লোক। সব মিলিয়ে বীরাপ্পন ছিল দেশের এক নম্বর ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল।’’

গৌরবাবু বলেন, ‘‘শেষে এই দানবটার পরিণতি কী হয়েছিল? কোনও শাস্তি দেওয়া গেল না!’’ অনিকেত উত্তর দেয়, ‘‘সব দুর্দান্তেরই তো অন্ত হয় এক না-এক দিন। একটা সময় বীরাপ্পন চন্দনের চোরাব্যবসা থেকে কিডন্যাপ আর মুক্তিপণ আদায়ে সরে আসছিল। আসলে শুরু থেকে কিছু অসৎ পুলিশ অফিসার আর ক্ষমতাশালী রাজনীতিকের সাহায্য পেয়ে আসছিল ও মোটা টাকার বিনিময়ে। ওর বাড়াবাড়িতে তারাও সরে যেতে বাধ্য হয়। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে একশো ছ’দিন পণবন্দি করে রাখার পর সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলাকালীন কর্নাটকের মন্ত্রী এইচ নাগাপ্পাকে ও খুন করে। সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তার পর যে ধরনের ফাঁদে ফেলে ও বছরের পর বছর নরহত্যা করে গিয়েছে, সে রকমেরই এক ফাঁদে ফেলে এসটিএফ-ও বীরাপ্পনকে খতম করে দেয় ২০০৪ সালের অক্টোবরে।’’

একমাত্র মি. হালদারের চাকরিজীবনে যথেষ্ট থ্রিল ছিল বর্ডারে আর্মি-লাইফ কাটানোর সুবাদে, বাকিরা এ ধরনের বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হয়নি কখনও। একটু চুপ করে থেকে বড়বাবু বলেন, ‘‘যাক স্যর, এ রকম একটা জায়গা থেকে যে দু’-দু’বার বেঁচে ফিরেছেন, এটাই তো বিরাট সৌভাগ্য!’’

অনিকেত এ বার হেসে ফেলে বলে, ‘‘রিস্ক কোথায় নেই বলুন তো? দাক্ষিণাত্যের জঙ্গলে বীরাপ্পনের রাজত্ব কেন, পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে আমি তো বারতিনেক মরতে-মরতে বেঁচেছি, তার মধ্যে এক বার মাওবাদী সংগঠন এমসিসি-র সদস্যদের হাতে। সে আর-এক কাহিনি!’’

লালমোহনবাবু সন্ধির কথা বললে কী হবে, বোসস্যর সে পরামর্শ প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিলেন। প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল, তবু বেন্দার মনে হয় যেন এই তো সে দিনের ঘটনা। উনি বাকি সবাইকে রেঞ্জ অফিসেই অপেক্ষা করতে বলে বেন্দাকে ডাকলেন, ‘‘চলো তো বৃন্দাবন, এক বার ব্লক অফিস থেকে ঘুরে আসি।’’

বৃন্দাবন বাইক বার করতে উনি ব্লকে গিয়ে সোজা ধীরেনবাবুর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। বাইরের বারান্দা থেকে বেন্দা শুনতে পেল উনি বলছেন, ‘‘নমস্কার, চিঠিটা পেয়ে আমি নিজেই চলে এলাম। খুবই ভাল পয়েন্ট তুলেছেন আপনি, সরকারের জমিতে বেআইনি ভাবে জবরদখলকারীদের ফরেস্টের লোকেরাই বিশেষ উদ্দেশ্যে বসিয়ে দিচ্ছি কি না। আমি সদ্য এসেছি, এখন আমার কাছে সবাই সন্দেহের পাত্র। আপনার বাড়িও তো ওই দিকেই, তাই আমি ভাবতেই পারি হয়তো আপনিও এটার সঙ্গে... হ্যাঁ, যদিও আমি জানি যে, আপনি জনপ্রতিনিধি, আপনি কেন এ কাজ করবেন! তেমনই আপনিও জানেন, আমরা পাবলিক সার্ভেন্ট, জনগণের সেবক। তা হলে আমরাই বা কেন এ কাজ করব? আপনি কোনও প্রমাণ ছাড়াই লিখিত অভিযোগ এনেছেন, আমি মুখে সন্দেহ প্রকাশ করলাম। কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ রেখে আসুন আমরা যৌথ ভাবে এই অন্যায়ের মোকাবিলা করি। কাল আমি ফরেস্টের লোকজন নিয়ে আপনার উল্লেখ করা জায়গায় গিয়ে ওদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে সরিয়ে দেব। তবে হ্যাঁ, আপনি গেলে তবেই, না হলে বুঝব ওদের সামনে দাঁড়াবার মুখ নেই আপনার। ফলে বিষয়টা এই জেলার মন্ত্রীর গোচরে আনতে হবে আমাকে। আপনার নিজের হাতে-লেখা চিঠিটাই আমার অভিযোগপত্র হিসাবে কাজ করবে। এখন বলুন, ক’টার সময় আমরা যৌথ প্রোগ্রাম শুরু করব কাল?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Literature Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE