Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পাগল মা-ই যেন তার মেয়ে

আমার কৈশোর-যৌবন কেটেছে বাড়ি-ছাড়া হয়ে, হোস্টেল, বোর্ডিং এবং মেস-এ। প্রায় কুড়ি-একুশ বছর। তবে মা আর বাড়ির টানে বছরে দু’বার, গ্রীষ্মে আর পুজোয় বাড়ি যাওয়া চাই।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

আমার কৈশোর-যৌবন কেটেছে বাড়ি-ছাড়া হয়ে, হোস্টেল, বোর্ডিং এবং মেস-এ। প্রায় কুড়ি-একুশ বছর। তবে মা আর বাড়ির টানে বছরে দু’বার, গ্রীষ্মে আর পুজোয় বাড়ি যাওয়া চাই। নানা ঠাঁই ঘুরে ১৯৫৪-৫৫-তে আমরা শিলিগুড়িতে থিতু হই। বাড়িতে এসোজন-বসোজনের অভাব ছিল না। দূর, অতি-দূর আত্মীয়তার সূত্রেও কত লোক যে আসত! আর বাঙাল ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, তাদের আপ্যায়নও করতে হত। ভিখিরিকে শুধু-হাতে ফেরানো হত না কখনওই। আমার মায়ের বাৎসল্য আবার একটু বেশি।

এক বার পুজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে দেখি, বাড়িতে এক জন নতুন কাজের লোক বহাল হয়েছে। মাঝবয়সি এক মহিলা। সঙ্গে সাত-আট বছর বয়সি তার ছেলে। নিরাশ্রয় হয়ে দিনের পর দিন শিলিগুড়ি রেলস্টেশনে বসে থাকত। আমার মা দৃশ্যটা দেখে এক দিন তাদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। মহিলার নাম যমুনা। ছেলে বাসু। মা আমাকে আড়ালে বললেন, যমুনা নাকি পাগল। সব সময় পাগলামি থাকে না। মাঝে মাঝে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জেগে ওঠে।

তবে এমনিতে যমুনা খুব চুপচাপ। আপনমনে কাজ করে। গুনগুন করে একটু গানও গায়। চেহারায় অতীতের সম্পন্নতার একটু ছাপ আছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর আত্মীয়রা তাড়িয়ে দিয়েছে বলে শোনা যায়।

কিন্তু আমি চমৎকৃত হই বাসুকে দেখে। অতটুকু ছেলে, যেমন তার বুদ্ধি, তেমন গুণপনা। চমৎকার গান গাইতে পারত, ছবি আঁকতে পারত এবং ভীষণ ভাল পারত দুর্গাপূজার সময় আরতি করতে। সেলাই জানত, উল বুনতে পারত এবং অসম্ভব পরিশ্রমী। বাসু আসায় আমাদের বাড়িতে যেন নতুন একটা প্রাণচঞ্চলতা এল। ওই বয়সেই বিভিন্ন প্যান্ডালে আরতি কম্পিটিশনে আরতি করে সে গাদা গাদা প্রাইজ নিয়ে এল। আমার বোনের কাছে গান শিখত। হারমোনিয়ম বাজানো শিখতে তার লহমাও দেরি হয়নি। বেশ ছিল মায়ে-পোয়ে মিলে।

কিন্তু হঠাৎই এক দিন যমুনার পাগলামি দেখা দিল। তেমন ভায়োলেন্ট কিছু নয়। নানা অসংলগ্ন কথা আর উলটোপালটা কাজ। আমি খুব মন দিয়ে তার প্রলাপ শুনে ব্যাকগ্রাউন্ড বুঝতে চেষ্টা করতাম। যমুনা নিশিদারোগার কথা খুব বলত। সে যে কে, বা কী বৃত্তান্ত তা জানি না। আর বলত, হ হ, কত দিছি থুইছি খাওয়াইছি, কত আইছে গেছে, কত লেনদেন। আবার কাকে যেন শাপশাপান্তও করত। বকবকানি চলত দিন-রাত, কখনও তারস্বরে।

বাসু বুঝতে পারত, মা এ রকম করলে তাদের কোথাও আশ্রয় পাওয়া কঠিন। সে মাকে চুপ করাতে প্রাণপণ চেষ্টা করত। তার মুখেই শুনেছি, যমুনার পাগলামির জন্য কোনও বাড়িতেই তারা টিকতে পারে না।

এর পর যমুনা আর বাসু বিদায় নিয়ে আবার স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নিল। তার পর কোথায় গেল, কে জানে। কিন্তু মাসখানেক পরে আবার ফিরে এল তারা। যমুনা শান্ত, বাসুর মুখে হাসি। কিন্তু দেখেছি, পাগল মা’কে কত ভাবে আগলে রাখত বাসু। মাঝে মাঝে মনে হত, সে যেন বাবা, আর যমুনা তার মেয়ে।

এই ভাবেই যমুনা আর বাসু ক্রমে ক্রমে আমাদের বড্ড আপনজন হয়ে উঠল। বাসু বড় হতে লাগল। আরতি করে, গান গেয়ে, হাতের কাজ করে তার আলাদা রকমের একটা খ্যাতিও হল। চমৎকার রান্নাও করতে পারত সে। আমার ভাই আর বোনের কাছেই যা কিছু লেখাপড়া শিখেছিল। স্কুলেও যেত। তবে সেটা বেশি দূর টানতে পারেনি মায়ের জন্য। কিন্তু ঠিকমত লেখাপড়া করলে এই মেধাবী ছেলেটি লেখাপড়াতেও খুব ভাল কিছু করতে পারত।

চোখের সামনে অবিশ্বাস্য যেটা দেখলাম তা হল, দুঃখী, পাগল মাকে রক্ষা করার জন্যই যেন বাসু খুব তাড়াতাড়ি সাবালক হয়ে উঠতে লাগল। যেমন চালাকচতুর, তেমনই বিবেচনাশক্তি, তেমনই অমলিন তার হাসি এবং রসবোধ। ওই বয়সে ছেলেরা নানা কুসঙ্গে পড়ে নেশাভাঙ করে, খারাপ কথা বলে। বাসু সে দিক দিয়ে নিষ্কলঙ্ক। কোনও দিন তার আচরণে বেচাল কিছু ধরা পড়েনি। কখনও মেজাজ হারাত না। কারও সঙ্গে ঝগড়া-কাজিয়ায় যেত না।

প্রায় পনেরো-ষোলো বছর তারা দুটিতে ঘুরেফিরে আমাদের বাড়িতে থেকেছে। তার পর বাসু তার নিজের গুণপনার জন্যই কারও সুপারিশে তিস্তা ব্যারেজে চাকরি পেয়ে গেল। বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে গেল নিজের কাছে। সেই বাসায় আমার মা, বোন, ভাই সবাই গেছে। দেখেছে, মা’কে কী যত্ন করে রেখেছে বাসু। ডাক্তার দেখায়, নিজের হাতে ওষুধ খাওয়ায়, দরকারে খাইয়ে দেয়। বাসুর সব কৃতিত্বের উৎসই বোধহয় তার ওই মাতৃভক্তি। মায়ের পাগলামির জন্য অনেক ভুগতে হয়েছে তাকে। কিন্তু কখনও বিরক্ত হয়নি।

এর পর বাসুর বিয়ে হয়। দুটি মেয়ে জন্মায়। বাসু বাড়িও করেছে। প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে তার এখন সচ্ছল অবস্থা। তার মেয়ে মাধ্যমিক থেকে এমএ পর্যন্ত দুর্দান্ত ফল করে ভাল চাকরি করছে। ছোট মেয়েটি স্কুলের অতি কৃতী ছাত্রী।

যমুনা আর নেই। কিন্তু তার বাসু আছে। পাগল মায়ের যত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান সব মুছে দিয়েছে সে। বাবা-মায়েদের এই দুঃসময়ে বাসুর কথা ভাবলে মনটা ভাল হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shirshendu Mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE