Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ঘর হারিয়ে যায়, কিন্তু আশ্রয় নয়

কারণ আশ্রয় মানে শুধু মাথার ওপর ছাদ নয়। সংস্কৃতি, ভাষার সঙ্গে বেঁধে থাকা। ইরাকের উদ্বাস্তু শিবির থেকে নরওয়ের হরিণশিকারির তাঁবু, ঘরছাড়াদের নিয়ে ছবি করতে গিয়ে এক পরিচালকের বোধ। মালদা-মুর্শিদাবাদের ভাঙনবিধ্বস্ত সেই সব মানুষের অনেকেই এখনও চরে থাকেন। এক পাড়ে ঝাড়খন্ড, অন্য পাড়ে পশ্চিমবঙ্গ। মাঝখানে গজিয়ে ওঠা ৩৫টা চরেই আস্তানা বা ‘শেল্টার’ তৈরি করে নিয়েছেন মানুষ। হারিয়েছেন সব কিছু। শুধু ভেঙে যাওয়া গ্রামের নামটুকু নিয়ে চলে এসেছেন হঠাৎ জেগে ওঠা এক-একটা চরে। মাটি নয়, বাপ-ঠাকুরদাদের গ্রামের সেই নামগুলোই তাঁদের ‘আশ্রয়’।

সন্ধানী: বরিস বেঞ্জামিন বারট্রাম

সন্ধানী: বরিস বেঞ্জামিন বারট্রাম

স্যমন্তক ঘোষ
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৮ ০০:২০
Share: Save:

সময়টা ২০০৬ সালের একেবারে শেষের দিক। পশ্চিমবঙ্গ তখন সিঙ্গুর আন্দোলনে ফুঁসছে। জমি কার, এই প্রশ্নে উত্তাল রাজনীতি, গণমাধ্যম এবং অ্যাকাডেমিক্স। তেমনই এক সময়ে সুযোগ হয়েছিল মালদহের পঞ্চানন্দপুর অঞ্চলে যাওয়ার।

ভাঙনবিধ্বস্ত এলাকা। নৌকো নিয়ে বিস্তীর্ণ নদী বেয়ে এগোতে এগোতে সত্তরোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক আঙুল তুলে দেখাচ্ছিলেন কোথায় ছিল তাঁদের ঘর, বাজার, আড্ডা মারার রোয়াক। আঙুল ধরে চোখের দৃষ্টি যত দূর পৌঁছচ্ছিল, শুধু জল আর জল। বৃদ্ধ বলেই চলেছেন, মৌজার নাম, গাঁয়ের নাম, রাস্তা...

মালদা-মুর্শিদাবাদের ভাঙনবিধ্বস্ত সেই সব মানুষের অনেকেই এখনও চরে থাকেন। এক পাড়ে ঝাড়খন্ড, অন্য পাড়ে পশ্চিমবঙ্গ। মাঝখানে গজিয়ে ওঠা ৩৫টা চরেই আস্তানা বা ‘শেল্টার’ তৈরি করে নিয়েছেন মানুষ। হারিয়েছেন সব কিছু। শুধু ভেঙে যাওয়া গ্রামের নামটুকু নিয়ে চলে এসেছেন হঠাৎ জেগে ওঠা এক-একটা চরে। মাটি নয়, বাপ-ঠাকুরদাদের গ্রামের সেই নামগুলোই তাঁদের ‘আশ্রয়’।

‘আশ্রয়’-এর সন্ধানেই ছিলেন বরিস বেঞ্জামিন বারট্রাম। চারটি মহাদেশ ঘুরতে ঘুরতে বরিস খুঁজছিলেন ঘরের বাইরের ঘর। উদ্বাস্তু, শরণার্থী শিবির থেকে প্রত্যন্ত জঙ্গলে মানুষ কী ভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করছেন, সেই নিয়েই ছিল বরিসের অন্বেষণ। ‘দ্য হিউম্যান শেল্টার’ তথ্যচিত্রে সেই কাহিনি ধরে রেখেছেন পরিচালক।

ইরাকের উদ্বাস্তু শিবিরে তখন পৌঁছেছে ক্যামেরা। তাঁবুর ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে ক্যামেরা কথা বলছে কুর্দ পরিবারের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, সব হারিয়েও কী ভাবে নিজেদের সংস্কৃতিটুকু বেঁচে আছে সার সার তাঁবুর চিলতে ঘরে। সে ঘরেও মননের রং আছে, পালানোর মুহূর্তে লোটাকম্বলে কোনও মতে গুঁজে নেওয়া পিতৃপুরুষের বাসন আছে। আর আছে ৮৫ হাজার দিনারের সুট। ক্যামেরার সামনে সেই সুট-মালিকের আক্ষেপ, উদ্বাস্তু শিবিরে ওই সুট পরে বেরনো যায় না। জীবনের সব সম্বল জমিয়ে ওই সুটটি তিনি তৈরি করেছিলেন কর্মস্থলে পরার জন্য। কিন্তু তার আগেই পালাতে হয়েছে। ছাদ মিলেছে শিবিরে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনের সব কিছু ছেড়ে এসেছেন তিনি ভিটেয়। শুধু সুটটা ফেলে আসতে পারেননি।

মসুলের এক ক্যাম্পে একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বরিসের। গল্প হয়েছিল অনেক ক্ষণ। যার খানিকটা আছে ছবিতে। অনেকটাই ছবির বাইরে। মেয়েটি নিজেই এসেছিল বরিসের কাছে। বুকের কাছে ধরা ছিল একটা নোটবুক। যাতে লেখা ছিল, ‘আমি সুহাদ। আমি এক জন কবি। তোমার ছবিতে কাজ করতে চাই।’

ছবির প্রত্যেক চরিত্রের কাছে যে প্রশ্নটি বরিস করছিলেন, এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না— ‘‘ঘর বলতে তুমি কী বোঝ?’’ পর দিন একটা কবিতা লিখে এনেছিল ওই মেয়েটি। কবিতার নাম ‘হোম’।

এ ভাবেই চলতে থাকে ছবি। পরতে পরতে খুলতে থাকে যাপনের নানা রং। কখনও নাইজেরিয়ার লেগুনে, কখনও সুমেরু অঞ্চলের ধু-ধু বরফের মধ্যে।

নরওয়ের তেমনই এক শীতল মরুভূমি প্রান্তরে বরিস খুঁজে পেয়েছিলেন এক বৃদ্ধ এবং তাঁর কন্যাকে। ছোট্ট কাঠের ঘরে বছরের পর বছর থাকেন তাঁরা বল্গা হরিণের টানে। বরিসের প্রশ্নের মুখে তাঁরা জানিয়ে ছিলেন, প্রতিদিন ওই হরিণের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করেন তাঁরা। অন্য কিছু করার, অন্য কিছু ভাবার ফুরসত পান না। সূর্যের অবস্থান দেখলে তাঁরা সময়ের ধারণা পান। কেটে যাচ্ছে, দিব্যি কেটে যাচ্ছে। নিজেদের মতো করে সভ্যতার সংজ্ঞা তৈরি করে নিয়েছেন বাবা আর মেয়ে।

আর সভ্যতার ছোবলে ঘর হারানো তুর্কিস্তানের উদ্বাস্তুরা বরিসকে শোনাতে থাকেন নিজেদের সংস্কৃতির গল্প। শুনতে শুনতে বরিস বুঝতে পারেন, নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ভাষায় বেঁধে বেঁধে থাকাই আসলে ‘আশ্রয়’। মাথার উপরের ছাউনিটা কেবলই একটা আচ্ছাদন। বেঁচে থাকা, বাসস্থান আসলে একটা মানসিক ‘নির্মাণ’। শুধুমাত্র ইট-কাঠ-কংক্রিটেই তা তৈরি হয় না।

প্রায় দু’বছর ধরে ঘুরেছেন বরিস। খুঁজে বেরিয়েছেন ‘আশ্রয়’-এর সংজ্ঞা। ফিল্মের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে বরিস বোঝার চেষ্টা করেছেন নিজের আশ্রয়। কোপেনহাগেনে বড় হয়ে ওঠা বরিস ছোটবেলা থেকেই সমুদ্রের ভক্ত। শীত হোক, বা গ্রীষ্ম, উত্তর সাগরে সাঁতার কাটা তাঁদের সংস্কৃতি। দীর্ঘ দু’বছর ধরে নানাবিধ ‘আশ্রয়’ দেখার পর বরিস বুঝতে পারেন, কনকনে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেওয়ার পর কেন তাঁর ‘অ্যাট হোম’ মনে হত। কেন সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে সাঁতার কাটতেই থাকতেন তিনি। জলের তলার ওই সবজে-নীল রঙেই তাঁর ‘আশ্রয়’। স্বাচ্ছন্দ্যের বাড়িতে নয়।

বরিসের ছবি কী দেখতে পাবেন মালদার চরের বাসিন্দারা? ট্রাক্টরের ব্যাটারিতে যাঁদের মোবাইল ফোন চার্জ হয়! দেখতে পাবেন পাহাড়ের পোর্টার-হ্যাম্প-শেফার্ডরা? হিমালয় জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে যাঁরা তৈরি রাখেন ছোট ছোট কাঠের ঘর! অতিথি এলে, পথচলতি ট্রেকার এলে পরম যত্নে যে ঘরে খড় বিছিয়ে ‘অ্যাট হোম’ আবেশ তৈরির চেষ্টা করেন তাঁরা! দেখতে পাবেন খাদান শ্রমিক, রাস্তা কিংবা উঁচু উঁচু বাড়ি নির্মাণ করতে আসা শ্রমিকেরা? রাস্তার ধারে, ফুটপাতে যাঁরা তৈরি করেন দিন গুজরানের শেল্টার! সেখানেও দেওয়ালে ঝোলে স্বর্গীয় বাবার ছবি, হিন্দি ফিল্মের নায়িকার ছবি। পরম আদরে মানিব্যাগে সেঁটে থাকে বউ-বাচ্চার পাসপোর্ট সাইজ ফোটোগ্রাফ। দিনের শেষে ওখানেই ‘আশ্রয়’ নেন তাঁরা। ওই ভরসাতেই দিনের পর দিন বিদেশ-বিভুঁইয়ে
পড়ে থাকা।

বরিস আশ্রয় চেনানোর চেষ্টা করলেন এমন এক সময়ে, পৃথিবী যখন শুধুই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE