Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

যুদ্ধের দিনগুলিতে প্রেম

তিনি আধুনিক কবিতার অন্যতম পুরোধা। শত্রুপক্ষের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। সেই গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ার সেনা ছাউনি থেকে একের পর এক চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁর প্রেমিকাকে।মাদলেন আর অ্যাপোলিনেয়ার-এর প্রথম দেখা ট্রেনে। তার পর মাত্র একবারই একসঙ্গে তাঁরা কিছুটা সময় কাটিয়েছেন।

সৈনিক: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ছবির দৃশ্য।

সৈনিক: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ছবির দৃশ্য।

রাহুল দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

আমরা আমাদের ভালোবাসা গোপন রাখব। এ হবে শুধু আমাদের নিজস্ব ব্যাপার।’’ ১৯১৫ সালের ১ জুলাই, যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে বসে এক চিঠিতে ফরাসি কবি গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ার লিখেছিলেন তাঁর প্রেমিকা মাদলেন পাজেস-কে। যুদ্ধের মধ্যে বসে যুদ্ধকে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন মাদলেনকে লেখা একের পর এক চিঠি ও কবিতায়।

মাদলেন আর অ্যাপোলিনেয়ার-এর প্রথম দেখা ট্রেনে। তার পর মাত্র একবারই একসঙ্গে তাঁরা কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। ১৯১৫-র ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯১৬-র ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। মাদলেনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন অ্যাপোলিনেয়ার। বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো তাঁর সব কবিতা যেন মাদলেন কপি করে রেখে দেন, যাতে পরে প্রকাশ করা যায়। মাদলেন তা-ই করেছিলেন। ১৯১৬-র ১৭ মার্চ অ্যাপোলিনেয়ার যুদ্ধে আহত হন, শিরস্ত্রাণ ফুঁড়ে গুলি ঢুকে যায় মাথায়। মারা যান ৯ নভেম্বর।

ইতালীয়-পোলিশ মায়ের অবৈধ সন্তান গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ার। বাবা ছিলেন সামরিক অফিসার। জন্ম রোমে, ১৮৮০ সালে। উনিশ শতকের ফরাসি কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল প্রতীকবাদ। এই নতুন কাব্য আন্দোলনের চার পথিকৃৎ ছিলেন বোদল্যের, র‌্যাঁবো, মালার্মে এবং ভেরলেন। বিশ শতকের শুরু থেকেই ফরাসি কবিতা থেকে প্রতীকবাদের প্রস্থান শুরু হয়। নতুন দিগন্তের সূত্রপাত করেন তিন কবি— অ্যাপোলিনেয়ার, ব্লেজ সঁদ্রার এবং মাক্স জাকব। ‘স্যুররেআলিস্ত’ শব্দটা অ্যাপোলিনেয়ারের সৃষ্টি। অদ্রেঁ ব্রেতোঁ পরে ‘স্যুররিয়ালিজ়ম’ শব্দটি গ্রহণ করেই কবিতার নবজন্ম ঘটান।

অ্যাপোলিনেয়ার

১৯১৫-র ২ জানুয়ারি নিস স্টেশনে অ্যাপোলিনেয়ারকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাঁর প্রেমিকা লু। অ্যাপোলিনেয়ার লু-র সঙ্গে আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটিয়ে মার্সেই যাবেন বলে ট্রেনে ওঠেন। তাঁর উল্টো দিকে বসেছিলেন বছর বাইশের সুন্দরী তরুণী স্কুলশিক্ষিকা মাদলেন। পড়ান ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য। থাকেন তৎকালীন ফরাসি উপনিবেশ আলজিরিয়ার ওরানে। মার্সেই থেকে তিনি জাহাজে উঠবেন। প্রথম দর্শনে মাদলেনকে দেখে প্রেমে পড়ে যান অ্যাপোলিনেয়ার। তিন মাস পরে বিচ্ছেদ হয় লু-র সঙ্গে। অ্যাপোলিনেয়ারের মন জুড়ে তখন শুধুই মাদলেন। ১৬ এপ্রিল প্রথম চিঠি লেখেন মাদলেনকে। তার পর দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠি বিনিময় চলতে থাকে। চিঠিতে অকপটে নিজের অতীতের সম্পর্কগুলির কথা মাদলেনকে জানিয়েছিলেন। চাইতেন, মাদলেনও চিঠিতে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করুক।

১৯১৫-র ১০ অগস্ট অ্যাপোলিনেয়ার মাদলেনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তার পর থেকেই চিঠিতে অ্যাপোলিনেয়ারের আবেগ লাগামছাড়া হয়ে ওঠে। চিত্রকলা, সঙ্গীত, সাহিত্য, গ্রিক পুরাণ মিশে যেতে থাকে চিঠিতে। পড়ে মনেই হয় না, যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে—কখনও খোলা আকাশের নীচে, জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত বাড়িতে, কখনও ট্রেঞ্চের মধ্যে, বা অবিরাম বৃষ্টি ও তুষারপাতের ভিতর ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, মোমবাতির আলোয় পেনসিলে টুকরো, ছেঁড়া কাগজে— তিনি চিঠিগুলো লিখেছেন।

মাদলেনের প্রতি প্রেমই যুদ্ধকে সহনীয় করে তুলেছে তাঁর কাছে। তাঁর শরীরের আনাচেকানাচে যে রহস্য লুকিয়ে, কল্পনায় তার মধ্যে তিনি অবাধে ঘুরে বেরিয়েছেন। লিখেছেন, ‘মাদলেন, চলো আমরা শুধু ভালবাসার কথাই বলি, একমাত্র ওটাই সেই বিষয়, যা নিয়ে কথা বলা যায়! ভালবাসা কম বড় যোদ্ধা নয়!’’

প্রথম দেখা হওয়ার দিনে মাদলেনের উল্টো দিকে বসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লু-কে অ্যাপোলিনেয়ার বলেছিলেন, ‘‘কবিতা? তুমি কবিতা পড়তে চাও? ঠিক আছে, বোদল্যেরের ‘লে ফ্লুর দ্যু মাল’ পড়ো।’’ নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মাদলেন। কবিতাকে কেন্দ্র করেই করে দুই সহযাত্রীর মধ্যে বন্ধুতা জমে ওঠে। ট্রেনে যেতে যেতে সমুদ্র, বালুতট, মাছ ধরার নৌকো আর পাইনগাছ দেখেন তাঁরা। আপলিনেয়ারের কণ্ঠস্বর, দৃষ্টি, হাত নাড়ার ভঙ্গি, চোখ ও চুলের বাদামি রং মাদলেনকে মুগ্ধ করে। অ্যাপোলিনেয়ার বলে ওঠেন, ‘‘আপনি ভিঁয়োর কবিতা পড়েছেন? এত প্রিয় আমার!’’ তখনই মাদলেন ভিঁয়োর কবিতার লাইন বলে ওঠেন। অ্যাপোলিনেয়ার বলেন, ‘‘আমার একটা কবিতার বই ১৯১৩ সালে বেরিয়েছে। আপনাকে পাঠাব। নাম ‘আলকুল্স’।’’ তিনি মাদলেনের ঠিকানা চেয়ে নেন। কবির হাত স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছা জাগে মাদলেনের। তাঁর মনে হয়, অ্যাপোলিনেয়ার যে কোনও সময় উঠে এসে তাঁকে চুমু খাবেন। বিদায়-মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে।

একটু আগেই বোমাবর্ষণ হয়েছে, সমানে চলেছে রাইফেল ও মেশিনগান। বনের ভেতর নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। ঠিক সেই সময় আর্দালি এসে জানায়, আলজিরিয়া থেকে একটা চিঠি এসেছে। মাদলেনের প্রথম চিঠি! মাদলেনকে অ্যাপোলিনেয়ার লিখেছেন, ‘আমি আকাশের দিকে তাকালাম। মনে হল আকাশ নয়, তোমার নীল চোখই দেখছি। আর সত্যিই তো, হৃদয়ের সঙ্গে যুদ্ধের কী সম্পর্ক?’ মাদলেন চুল কেটে ফেলেছেন শুনে তিনি মর্মাহত, এটা সৌন্দর্যের অপমান! মাদলেনের প্রথম ফোটো পেয়ে তিনি পাগলের মতো তাতে চুমু খেয়েছেন। তাঁকে সেই জঙ্গলের ছবি পাঠিয়েছেন, যেখানে তাঁদের অস্থায়ী শিবির। এক চিঠিতে লেখা, ‘তুমি সব সময়ই আমার পাশে রয়েছ। আমার কানে কানে কথা বলছ। আমার কাছে এস, নিজের আত্মা, হৃদয় ও শরীরকে নগ্ন করে মেলে ধরো, ঠিক যে ভাবে ইভ নিজেকে মেলে ধরেছিল আদমের কাছে। তোমার হাতে, সুন্দর কপালে ও চুলে আমি পাগলের মতো চুমু খেতে চাই, যা তুমি আমার জন্যই রেখে দিয়েছ। কালো আঙুরের মতো ওই ঘন চুল আর কেটো না, ওই চুল আমার পুরস্কার।’

লিখেছেন, ‘তোমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আমি আদর করতে চাই, চুমুতে চুমুতে সারা শরীর ভিজিয়ে দিতে চাই, শরীরের সমস্ত জায়গার ত্বকের রঙ জানতে চাই, সুস্বাদু ফলের মতোই তোমার জিভের আস্বাদ গ্রহণ করতে চাই। তুমি আমাকে আকাশের কথা বলো, সমুদ্রের কথা বলো, তোমার হৃদয়ের মতোই নীল যারা...কী ভাবে নিজেকে শান্ত করব আমি!’

১৮ জুলাই ১৯১৫-র এক চিঠিতে লিখেছেন, জীবন ভারী অদ্ভুত, আর এই দুনিয়াটা এত ছোট! একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন তিনি, যদিও রোজ লিখতে পারছেন না। কিন্তু চিঠি লিখে চলেছেন। ‘যে দিন তোমার চিঠি পাই না, সে দিনই মাছিরা আমাকে ছেঁকে ধরে। তোমার চিঠিগুলোয় গোলাপের গন্ধ থাকে। তোমার ঠোঁটদুটো ঠিক গোলাপফুলের মতো। সৌন্দর্যই সেই বিস্ময়কর বই, যার মধ্যে সমস্ত জ্ঞান সঞ্চিত হয়ে আছে। আমরা একে অপরকে এত বেশি ভালবেসে ফেলেছি যে আমরা পরস্পরকে ব্যথা দিয়ে ফেলছি।’

শারীরিক ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলেও অ্যাপোলিনেয়ারের মন পড়ে থাকত সাহিত্যে। মাদলেনকে লিখেছেন, সেনা ছাউনিতে কাউকে তিনি ওয়াল্টার স্কটের উপন্যাস পড়তে দেখেছেন, কেউ বা পড়ছেন গ্যেটের ‘ফাউস্ট’। আরব্য রজনী, সারভান্তেসের ‘দন কিহোতে’ ও কোলরিজের জীবনী সম্পর্কে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন প্রেমিকাকে। তাঁর মতে, দস্তয়েভস্কি মহৎ প্রতিভা, টলস্টয়ের লেখায় আছে ধ্রুপদী ট্রাজেডির উপাদান, তাঁর ‘আনা কারেনিনা’ তিনি পড়েছেন। তবূ তাঁর মতে, রুশদের শ্রেষ্ঠ লেখক গোগোল। মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ পড়তে ভাল না লাগলেও তিনি স্বীকার করেছেন, এটা একটা মাস্টারপিস। পিকাসো সম্পর্কে তাঁর মত: মহান শিল্পী, কিন্তু বিবেক বলে কিছু নেই!

ছোটবেলা থেকেই রূপকথার গল্প, ‘রবিনসন ক্রুসো’ আর রাসিন-এর নাটক পড়তে ভালবাসতেন অ্যাপোলিনেয়ার। কোন বই পড়া উচিত আর কোনটা নয়, সে ব্যাপারে নানা চিঠিতে তিনি মাদলেনকে গাইড করতে চেয়েছেন। যেমন লিখেছেন, জ়োলা বিরাট মাপের ঔপন্যাসিক, কিন্তু তাঁর লেখা পড়তে ভাল লাগে না। মপাসাঁর লেখায় সংবাদধর্মিতা বেশি, তাই তাঁর পছন্দ নয়।

অ্যাপোলিনেয়ারের চিঠির সিংহভাগ দখল করেছে যৌন মিলনের বিচিত্র বর্ণনা। মাদলেনকে নিয়ে অনিঃশেষ ফ্যান্টাসি রচনা করে গিয়েছেন একের পর এক চিঠিতে। বদ্ধ ঘরে মাদলিনের সঙ্গে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উষ্ণ বিছানায় পাশাপাশি বসে মোমবাতির আলোয় একসঙ্গে কবিতা পড়ার কথা ভাবতে ভালবাসতেন। গন্ধের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব সংবেদনশীল, আর মাদলেনের শরীরের ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য উন্মুখ। মাদলেনকে উপহার হিসাবে এক বার প্রজাপতির ছেঁড়া ডানা পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘আমরা শুধু ঠোঁট দিয়ে নয়, চোখ দিয়েও কথা বলব। তুমি আমার কাছে

একটা কবিতারই মতো। আমার একাকিত্বেও আমি একা নই, তুমি আছ আমার সঙ্গে।’

১৯১৫ সালের ৪ অক্টোবর যে অ্যাপোলিনেয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আনন্দই জীবনের সব, আনন্দ সূর্যস্নাত পর্বতের চিরন্তন বরফের মতো’, শেষ দিকে সেই তিনিই ডুবে যাচ্ছিলেন গভীর বিষণ্ণতায়। নিজে কয়লার অভাবে আগুন জ্বালাতে পারছেন না; বৃষ্টিতে, তুষারপাতে, ঠান্ডায় কাঁপছেন, কিন্তু মাদলেনকে লিখছেন, ঠান্ডা লাগিও না, ছাতা ছাড়া বৃষ্টিতে বেরিয়ো না। লিখেছেন, ‘কবে আমি সাইপ্রাসের দ্বীপে পৌঁছব, যেখানে আমার ভেনাস আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে তার বিদ্যুতের মতো লম্বা, রোগা শরীর নিয়ে, স্পেনের রানির মতোই যে আমাকে অভ্যর্থনা করবে!’ সেই অ্যাপোলিনেয়ারই আবার লিখেছেন: ‘কী কাদা, কী কাদা, আমার ঘোড়া তিন বার পিছলে পড়ে গেছে, এ ভাবে কর্দমাক্ত হতে আমার ঘেন্না করে!’ বুঝতে পারছিলেন, ক্রমে তাঁর স্নায়ু বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। জঘন্য পরিবেশে ঘুমোতে পারছেন না, অথচ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধও তখন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। চূড়ান্ত আঘাত পাওয়ার আগে অ্যাপোলিনেয়ার লিখেছেন, যাজক হলেই হয়তো আমাকে মানাত!

মাদলেনও আর কোনও দিন বিয়ে করেননি। মারা যান ১৯৬৫ সালে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Guillaume Apollinaire History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE