Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
কা গে র ছা ব গে র ছা

পুরুলিয়া আর ব্লটিং পেপার

আজকাল ফিল্মের শুটিংয়ে যাওয়ার আগে, বা শুটিং থেকে ফিরে এসে, একটা প্রশ্ন কানের কাছে ঘোরাফেরা করবেই করবে, ‘আবার পুরুলিয়া, অ্যাঁ?’ বা ‘সেই পুরুলিয়াতেই তো?’ বলার প্রায় কিছুই থাকে না, কেননা কথাটা সত্যি! মাঝে মাঝেই ভাবি ধুর, আর পুরুলিয়া নয়, এ বার অন্য একটা জায়গায় যাব, দারুণ সুন্দর জায়গা, এত সুন্দর যে ক্যামেরা পাতলে পরদাও ফেটে যাবে, ক্যামেরাও! কিন্তু তার পরেই মনে হয়, আমার ছবির মানুষজন এখানে বাঁচবে কী করে?

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

আজকাল ফিল্মের শুটিংয়ে যাওয়ার আগে, বা শুটিং থেকে ফিরে এসে, একটা প্রশ্ন কানের কাছে ঘোরাফেরা করবেই করবে, ‘আবার পুরুলিয়া, অ্যাঁ?’ বা ‘সেই পুরুলিয়াতেই তো?’ বলার প্রায় কিছুই থাকে না, কেননা কথাটা সত্যি! মাঝে মাঝেই ভাবি ধুর, আর পুরুলিয়া নয়, এ বার অন্য একটা জায়গায় যাব, দারুণ সুন্দর জায়গা, এত সুন্দর যে ক্যামেরা পাতলে পরদাও ফেটে যাবে, ক্যামেরাও! কিন্তু তার পরেই মনে হয়, আমার ছবির মানুষজন এখানে বাঁচবে কী করে? এখানে আলো কোনও কথা বলে না, অন্ধকার শুধু চুপ করে বসেই থাকে। তার চেয়ে ঢের ভাল পুরুলিয়া, যেখানে সবুজটবুজ নেই, হাড়গিলগিলে শুকনো নদী যা বেড়াল অবধি পার হয়ে যায়, ন্যাড়া ন্যাড়া গাছ, লাল ধুলো ওড়ানো রাস্তার পাশ দিয়েই শুরু হয়ে গেছে রোদে পোড়া অদ্ভুত হলুদ ঢাল। আর কান ফেরালেই দেখা যাবে ‘আম গাছে আম নেই কুটা কেন নাড় রে...’ গাইতে গাইতে সাইকেলের পেছনে প্রেমিকাকে বসিয়ে চলেছে বিজয় মাহাত। ওঁর নাম যে বিজয় মাহাতই তা আমি বলতে পারি না, কিন্তু সাইকেল থেকে ঝুলে-থাকা মিশমিশে কালো পায়ে নিপাট করে লাগানো আলতার লাল রং যে তাঁর নারী ছাড়া আর কাউকেই মানায় না, তা না ভেবেই বলে দেওয়া যায়।

পুরুলিয়ায় আমি জন্মেছিলাম, জন্ম হয়েছিল, তা ছাড়া বাকিটা সব ফাঁকি! ডাক্তারি পাশ করে বাবা পুরুলিয়া জেলার আনারা নামের ছোট্ট একটা শহরে রেলওয়ের ডাক্তার হয়ে চলে এলেন। সঙ্গে শোভনা, আমাদের মা। শোভনা আর তারাকান্তর দুই মেয়ে সাত ছেলে। সবচেয়ে বড় মেয়ের জন্ম হয় ঢাকার পুরানা পল্টনে, শোভনাদের নিজেদের বাড়িতে। মেয়ের মুখ দেখে শোভনা তাঁর স্বামীকে এক পয়সার খামের ভিতরে চিঠি পাঠালেন, ‘আমাদের একটি গোলাপফুল হইয়াছে।’ তারাকান্ত তখন মনের দুঃখে আনারায় রুগি দেখে চলেছেন। তার পর বছর পাঁচেকের মধ্যে অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল, শোভনা আর তারাকান্তর ঘরে এক এক করে এল সুখদেব, বুদ্ধদেব, জয়দেব। বাকি চার ছেলে আর এক মেয়ে কখনও এই শহরে কখনও ওই শহরে। নিজের চেহারা সম্বন্ধে আমার বরাবরই একটু কিন্তু-কিন্তু ভাব ছিল। বড় হয়ে মা’কে আমি বলতাম, আমি হওয়ার পর বাবাকে কী লিখেছিলে— ‘আমাদের একটি আরশোলা হইয়াছে?’ মা হাসতেন আর বলতেন, ‘লিখতে আর পারলাম কই? বাবার হাতেই তো হলি!’

সব শহরের ওপর দিয়েই ছুটত রেললাইন আর সেই লাইনের ওপর দিয়ে ছুটত বাবার ট্রলি। ট্রলির ওপর এক বিশাল ছাতার তলায় বাবা, আর তাঁর ওষুধের বাক্স। লাইনের ওপর দিয়ে ভূতের মতন ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ছুটত দু’জন, কখনও তাদের নাম স্বামীনাথন আর প্রহ্লাদ, কখনও দৈতারি আর জান্কীরাম। ট্রলি গিয়ে থামত ছোট্ট ছোট্ট থমথমে সব স্টেশনে, কোথাও এক ঘণ্টা কোথাও দু’ঘণ্টা কোথাও বা লাইন্সম্যান হাত নেড়ে জানিয়ে দিত, আজ রুগি নেই। নদী, নালা, পাহাড় ডিঙিয়ে ট্রলি ছুটত পরের স্টেশনে। কারও দাঁত তুলতে হবে, কারও ভাঙা হাত জোড়া লাগাতে হবে, কারও দুরন্ত বাহ্য বন্ধ করতে হবে। আর একটা তো হামেশাই হত—প্রসূতির দুই পা মাটির সাথে পা দিয়ে চেপে বাচ্চা বের করে আনা। তবে এই ট্রলি-ঠেলা কুলিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রকোপ ছিল একটা বিশেষ রোগের। এদের মধ্যে জাঙিয়া পরার চল ছিল না। লাইনের ওপর দিয়ে ছোটা থেকে শুরু করে, এক কাঁড়ি বালবাচ্চা আর থুত্থুড়ে বাবা-মা-ভরা ঘর থেকে বউকে তুলে নিয়ে মাঝরাত্তিরে সামনের অন্ধকার মাঠে ছুটে যাওয়া— সবই ওই রেলের দেওয়া খাকি প্যান্ট পরে। আর এই ছোটাছুটিতে খাকি প্যান্টের ভেতর ফুলেফেঁপে উঠত তাদের অণ্ডকোষ। বাবার কাছে হাইড্রোসিল অপারেশন ছিল বাঁয়ে হাত কা খেল। এমন দিনও গেছে, দশ-বারোটা পেরিয়েও বাবা নিস্তার পাচ্ছেন না। বাড়ির লাগোয়াই ছিল রেলওয়ে হাসপাতাল। অপারেশন থিয়েটারের কাচের জানলা ছিল পুরু সবুজ রং দিয়ে ঢাকা। কিন্তু এক জায়গায় রং চটে গিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল স্বচ্ছ কাচ, তার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতাম, আলোর নীচে শুয়ে-থাকা উলঙ্গ পুরুষ-শরীর। কখনও কখনও বাবাকে দুটো অণ্ডকোষই কেটে বাদ দিতে হত। তাদের কেউ কেউ রাত্রিবেলা মদ খেয়ে অণ্ডকোষের শোকে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে আবদার করত: আরে একঠো তো লৌটা দে ডাগ্‌দরবাবু!

কলকাতায় একটা ছবি নিয়ে কে বলল, দারুণ সিন-সিনারি! ছোটবেলায় বাবার কাছে ডাকে আসত নানান ওষুধ-কোম্পানির খাম। কত ক্ষণে বাবা সেই খাম খুলবেন, আমরা ভাইয়েরা সেই আশায় বসে থাকতাম। খামের ভেতর হিজিবিজি নানান কাগজের সাথে থাকত রঙিন সব ব্লটিং পেপার। একটা ব্লটিং পেপারের ওপর জলস্রোতের ছবি তো আর একটার ওপর মেঘের, কোথাও মেষপালক পাহাড়ের গা বেয়ে নিয়ে চলেছে এক পাল ভেড়া, কোনওটায় শান্ত নদীর ছবি। আস্তে আস্তে সেই সব খাম আসা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু জমানো ব্লটিং পেপারগুলো আমাদের কাছে রয়ে গেল বহু দিন। স্কুলফেরত বন্ধুরা দেখতে আসত তাড়া তাড়া ব্লটিং পেপার। সুবল নিয়ে এসেছিল তার ন-কাকাকে। দেখতে দেখতে ন-কাকার আবিষ্ট মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটাই মাত্র কথা— কী সুন্দর সিন-সিনারি!

পুরুলিয়ায় সুন্দর সিন-সিনারি একেবারেই নেই। বেড়ানো বলতে থোড়বড়িখাড়ার মতো অযোধ্যা পাহাড়, আর সত্যজিৎ রায়ের জয়চণ্ডী পাহাড়— ‘হাঁ ভাল্ হুই জয়চণ্ডী টিলা, উঠেনে হীরক রাজার দ্যেশের সিনিমার ফোটো খিঁচেছিল সেই লম্বা লোকটো।’ তবু আমার কাছে পুরুলিয়া রহস্যময়। যে-সব উদ্ভুতুড়ে লোকের কথা আমি সিনেমায় বলতে চাই, তাদের বেশ সহজেই মানিয়ে যায় পুরুলিয়াতে। কিন্তু এ রকম আরও অনেক জায়গাই তো আছে। সেখানেও তো আমি ছবি করেছি! আসলে যা দরকার: মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে না থেকে সামনের দৃশ্যকে অন্য ভাবে তৈরি করা। কিছু কিছু জায়গায় এই রহস্যময়তা চোখের সামনে থাকে না। ঘাপটি মেরে বসে থাকে আশেপাশে। ঠিক লেন্সটা বসাও, ঠিক আলোয় ক্যামেরা বের করো, ঠিক দূরত্বে চরিত্রদের রাখো, ঠিক গতি আনো ক্যামেরার নড়াচড়ায়— দেখা যাবে ঘাপটি-মারা রহস্যময়তা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তা না হলে গাছ তো গাছই, রাস্তা তো রাস্তাই... একটু ভূতে-পাওয়া হতে হবে চোখ দুটোকে। সে পুরুলিয়া হোক বা মেচেদা, জকপুর। ‘সুইচ টিপলেই ছবি উঠবে, কী আর বেশি কথা! /সেই ছবি কি তুলতে পারো, স্বপ্ন দিয়ে গাঁথা?/ আলোর কিছু কথা থাকে, অন্ধকারের আরও/ মাঝখানে এক একলা মানুষ, তাকে ধরতে পারো?’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE