পাস্তা
পিনাকী ভট্টাচার্য
চি ন থেকে ইউরোপ পৌঁছনোর রাস্তায় নুডল্স কেতাদুরস্ত হয়ে পাস্তা হয়ে গেছে— ছোট থেকেই তাই ভাবতাম। জানতাম পাস্তা নুডল্সেরই বংশের লোক, তাই ম্যাকারনির প্যাকেট কিনে চাউমিন বানায় লোকে। আমার এই অগাধ বিশ্বাসের ওপর সিলমোহর মেরেছিলেন স্বয়ং মার্কো পোলো। তিনি চিনদেশের গপ্প ফলাও করে লিখেছিলেন তাঁর ভ্রমণ-বৃত্তান্তে। আমিও দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়েছি। তাঁর হাত ধরেই নুডল্স পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিল।
কিন্তু, পাস্তার সুলুকসন্ধান করতে গিয়ে মস্ত ঝাঁকুনি লাগল। মার্কো পোলো চিন থেকে ইতালি ফেরত আসার কয়েক বছর আগেই এক ইতালীয় সেনা তার রসদের বিবরণে এক ঝুড়ি শুকনো পাস্তার কথা লিখেছিল। তারও আগে, ১১৫৪ সালে, আরব ভূতাত্ত্বিক মহম্মদ-আল্-ইদ্রিসি সিসিলির নর্ম্যান রাজার জন্যে লেখা নথিতে বলছেন ‘পশ্চিমে ত্রাবিয়া নামে এক সুন্দর উপনিবেশ আছে, সেখানে মফস্সলের দিকে মস্ত মস্ত বাড়িতে ইত্রিয়া তৈরি হয় আর চার পাশের মুসলিম ও খ্রিস্টান দেশগুলিতে তা জাহাজে করে রপ্তানি হয়।’ কী এই ইত্রিয়া? নবম শতাব্দীর আরবি ভাষাবিদ ইশো বার আলি বলেছেন, তা ময়দার তৈরি সিমাইয়ের মতো দেখতে এক খাবার, তা শুকিয়ে নানা রকম রান্না করা হয়। মানে, পাস্তা!
তা হলে পাস্তা ঠিক কতটা পুরনো? অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আরব দেশে পঞ্চম শতাব্দী থেকেই পাস্তা জাতীয় খাবার পাওয়া যায়, যা তারা দূর দেশে যেতে সঙ্গে নিত। কিন্তু ‘জেরুজালেম টাল্মুদ’-এ ইত্রিয়াম বলে যে সেদ্ধ ময়দার মণ্ডের কথা পাই, তা নাকি তৃতীয় শতকে প্যালেস্টাইনবাসীদের ভারী শখের খাবার। গ্রিক লোককথায় ভগবান হিপেস্তাস ময়দার মণ্ড থেকে সরু ময়দার সুতো বানানোর এক যন্ত্র বানিয়েছিলেন, আর সেই যন্ত্রই বিশ্বের প্রথম পাস্তা বানানোর যন্ত্র! রোমের চিচেরো তাঁর বইয়ে বলেছেন লাগানাম্-এর কথা। লাগানাম্ ছিল সেই জমানার পাস্তার লম্বা স্ট্রিপ। তাই কি মার্কো পোলো চিনে নুডল্স দেখে বলে উঠেছিলেন, ‘আরে! এ তো লাগান্!’
এক প্রচলিত মত হচ্ছে, ইউরোপে পাস্তা নিয়ে প্রথমে পৌঁছয় আরব বণিকরা। ধারণাটা পুরো ভুল হয়তো নয়, কারণ ইতালিয়ানরা যে বিশেষ দোরাম ময়দা দিয়ে পাস্তা বানাতে শুরু করল বারো শতক থেকে, তার সঙ্গে পরিচয় করায় আরব বণিকেরাই। এই ময়দা দামে কম, আর তাতে তৈরি পাস্তা অনেক দিন নষ্ট হয় না। পাস্তার সঙ্গে পরিচয় আরও দেড় হাজার বছর পুরনো, কিন্তু পুরনো পাস্তা আর এই নতুন পাওয়া ময়দায় তৈরি পাস্তার মিল শুধু স্বাদে-বর্ণে-গন্ধে, গুণে মিল নেই। ইতালীয়দের কাছে এই নতুন পাস্তা খুব জনপ্রিয় হল। সেখানে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সবজির ফলন হত ভালই, অতএব নানা সস বানিয়ে তা দিয়ে পাস্তা খাওয়াই ছিল দস্তুর। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ তখন অনাবিষ্কৃত দেশগুলো জিততে মরিয়া। সেই নাবিকদের সঙ্গে পাস্তার ভারী বন্ধুত্ব হল। অনেক দিন সঙ্গে রাখলেও পাস্তা পচে না যে। তাদের সঙ্গে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল পাস্তা। সময়ের সঙ্গে নানা নামে নানা আকারে দেখা দিল সে। কখনও লাসানে, কখনও ভারমিচেলি, কখনও ফিদেয়ো, আবার কখনও ম্যাকারনি।
আমেরিকার পাস্তা-প্রীতির কৃতিত্ব তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনকে দেওয়া যেতেই পারে। উনি ১৭৮৪ থেকে ১৭৮৯ ফ্রান্সে থাকার সময় পাস্তার প্রেমে পড়ে যান। দেশে ফেরেন দুই বাক্স পাস্তা নিয়ে। তাতেই থেমে থাকেননি। সেই পাস্তা শেষ হয়ে যেতে তিনি এক বন্ধুকে দিয়ে ইতালির নেপল্স থেকে পাস্তা আনিয়েছিলেন। সেই পাস্তা ছিল ম্যাকারনি।
pinakee.bhattacharya@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy