Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আকাশের বাড়িতে বেলুনের ঘর

রাতের আকাশে খুব জোরে ছুটে যাওয়া একটা উজ্জ্বল বস্তু কোনও দিন লক্ষ করেছ কি? এর আলো স্থির থাকে, দপদপ করে না, এক এক দিন একে শুক্রগ্রহের থেকেও উজ্জ্বল দেখায়। এটা মানুষের তৈরি আকাশে ভেসে চলা এক বাড়ি। নাম ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আই এস এস)। ১৯৯৮ সালে রাশিয়া, আমেরিকাসহ পৃথিবীর পনেরোটি দেশ এটি তৈরি করতে শুরু করে।

অমিতাভ ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

রাতের আকাশে খুব জোরে ছুটে যাওয়া একটা উজ্জ্বল বস্তু কোনও দিন লক্ষ করেছ কি? এর আলো স্থির থাকে, দপদপ করে না, এক এক দিন একে শুক্রগ্রহের থেকেও উজ্জ্বল দেখায়। এটা মানুষের তৈরি আকাশে ভেসে চলা এক বাড়ি। নাম ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আই এস এস)। ১৯৯৮ সালে রাশিয়া, আমেরিকাসহ পৃথিবীর পনেরোটি দেশ এটি তৈরি করতে শুরু করে। কারা থাকেন এখানে জানো? একাধিক বৈজ্ঞানিক। আর কাজ? মহাকাশ গবেষণা তো বটেই, পৃথিবীরও যে সব গবেষণা কম অভিকর্ষে হয়, সেটাও করা হয় এখান থেকেই। পৃথিবী থেকে দূরে অভিকর্ষের টান কম।

আকাশের বাড়ি পৃথিবী থেকে চারশো কিলোমিটার উঁচুতে ভেসে বেড়ায়। পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরতে এর মাত্র নব্বই মিনিট সময় লাগে। এখানে বসবাসকারীরা প্রত্যেক দিন ষোলো বার সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখেন। আশ্চর্য হওয়ারই কথা, তাই না?

এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের মূল দুটি বিভাগ। একটি আমেরিকার, অন্যটি রাশিয়ার। আমেরিকার বিভাগে নভোচারী ও তাঁদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং বাড়িটার সম্প্রসারণ, মেরামত করার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা— এ সব কাজই করত দীর্ঘ দিন ‘নাসা’-র মহাকাশ ফেরিযান। এরই একটি ‘কলম্বিয়া’ ধ্বংস হয়ে মারা যান কল্পনা চাওলা, মনে আছে? ‘চ্যালেঞ্জার’ ধ্বংস হয়েছে তারও আগে। বাকি ফেরিযানগুলিও পুরনো হয়ে যাওয়ার জন্য বাতিল হয়ে গিয়েছে।

অতএব, আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের দরকার হয়ে পড়ে মহাকাশ ফেরিযানের বিকল্প কোনও যান ও নতুন কাজ এসে যাওয়ার জন্য বাড়িতে এক/দুটি বাড়তি ঘর।

এ বার দু’জন মানুষের কথা বলি। আকাশের বাড়ির ওই দুটি প্রয়োজনে যাঁরা বিশেষ অবদান রাখলেন। এক জন ইলন মাস্ক— নেশায় আবিষ্কারক, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ও বিনিয়োগকারী। দশ বছর বয়স থেকে যাঁর নেশা ছিল কম্পিউটার, একটু বড় হয়ে অ্যাসিমভের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনের লক্ষ্য স্থির করেন: মানুষকে পৃথিবীর বাইরেও বসবাস করাতে হবে। এক মানব জীবনে হতে হবে একাধিক গ্রহের বাসিন্দা। কারণ, পৃথিবীতে লক্ষ কোটি বছরে এক বার গ্রহাণুপুঞ্জ আমাদের ওপরে আছড়ে পড়তে পারে। আবার গত ৬০ বছরে মানুষের তৈরি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োগেও পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে। তখন ডাইনোসরদের মতো আমরাও বিলুপ্ত হয়ে যাব।

এই বিরাট কাজের জন্য প্রথমেই দরকার মহাকাশ যাত্রার ব্যয় কমানো। এই উদ্দেশে মাস্ক-এর ‘স্পেস এক্স’ কোম্পানি মহাকাশের অনেক কাজ করে চলেছে। গত ৮ এপ্রিল ‘স্পেস এক্স’-এর ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেট ‘ড্র্যাগন’ নামের একটি মহাকাশযানকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সমুদ্রের ওপরের একটি জাহাজে পড়েছে, সমুদ্রে নয়। মানে, রকেটটি আবার ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রইল। উদ্দেশ্য সফল।

‘ড্র্যাগন’ মহাকাশযানটি নিয়ে গিয়েছিল বিগলো এক্সপেন্ডেবল অ্যাক্টিভিটি মডিউল। এটা ‘বিগলো এরোস্পেস’ নামে এক কোম্পানির তৈরি একটি চ্যাপ্টা বেলুনের ঘর, যা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের মূল বাড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটা ক্রমশ ফুলিয়ে ফুলিয়ে মে মাসের শেষের দিকে এটি একটা ঘরের আকার নেবে। এই ঘর দু’বছরের জন্য। আকাশের বাড়িতে বসবাসকারী বৈজ্ঞানিক/নভোচারীরা এটা ঘর হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু সব সময়ের জন্য নয়, দু’বছরে হয়তো আট বার। কেন? এই ঘরের ভিতরে রাখা যন্ত্র পরীক্ষা করবে— মহাকাশের তেজস্ক্রিয়তা ও মহাকাশে খুব দ্রুত ভেসে বেড়ানো অজস্র আবর্জনা থেকে এই ঘর মহাকাশচারীদের সুরক্ষিত রাখতে পারছে কি না। সফল হলে ‘বিগলো’-র প্রচলন হবে।

চারশো কিলোমিটার উঁচুতে বাড়ি তৈরি করা বা মাটির পৃথিবী থেকে বাড়ি তৈরির উপাদান নিয়ে যাওয়া অনেক শক্ত। চ্যাপ্টানো ঘর ফুলিয়ে নিয়ে ব্যবহারযোগ্য হলে কাজ অনেক সহজ ও কম খরচে হয়ে যাবে।

‘বিগলো এরোস্পেস’ কোম্পানিটি রবার্ট টি বিগলো নামে আমেরিকার বিখ্যাত এক হোটেল চেন মালিকের। লাস ভেগাসে বড় হওয়া বিগলো ছোটবেলায় শহর থেকে খানিক দূরে অনেকগুলি আণবিক পরীক্ষার খবর পান। তার থেকে
তাঁর স্বপ্নে আসে বিজ্ঞান ও মহাকাশ। মহাকাশে যেতে হবে, থাকতে হবে— তার জন্য চাই অনেক টাকা। নানা ভাবে অনেক টাকা রোজগার করে জীবনের স্বপ্নপূরণ করতে গড়ে তুললেন বিগলো। তাঁর মাধ্যমে শুরু হল মহাকাশের কর্মযজ্ঞ। ইতিমধ্যে ‘নাসা’ চ্যাপ্টানো বেলুনটিকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে যুক্ত করে ফোলানো যায় কি না, সেই পরীক্ষা শুরু করেছে। কিন্তু নানা কারণে শেষ করতে পারেনি। ‘বিগলো এরোস্পেস’ সেই পরীক্ষার প্ল্যানগুলি নিয়ে অবশেষে সেটা কাজে লাগাল। এখন দেখার, ‘বিগলো এরোস্পেস’-এর তৈরি এই নতুন ধরনের ঘর মহাকাশের কতটা উপযোগী হয়।

মাস্ক এবং বিগলো সম্পূর্ণ নতুন যে জিনিস করলেন, তার স্বপ্ন দেখেছিলেন ১২/১৩ বছর বয়সে। স্বপ্ন সফল করার জন্য সব রকম চেষ্টা করেছেন। স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবে রূপ নিল। মনে পড়ে— আমার স্কুলে রোজ দেখা একটা লেখার কথা— হ্যাপি আর দোজ হু ড্রিম ড্রিমস অ্যান্ড আর রেডি টু পে প্রাইস টু মেক দেম কাম ট্রু...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE