বারবিকান-এ ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’ পরিচালনা করছেন সুমন মুখোপাধ্যায় (বাঁ দিকে)। অভিনয় করছেন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়।
বার্কলি, ক্যালিফোর্নিয়া ২০০৫। সবে ‘হারবার্ট’ ছবি শেষ করে পৌঁছলাম বিখ্যাত বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই চত্বরকে বলা হয় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বার্কলি’। কারণ ঐতিহাসিক ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সরকারবিরোধী আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় জন্ম নিয়েছে। বিশেষত ভিয়েতনামে আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হয়েছিল, তার বীজ এখানেই পোঁতা। সেই বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এসেছি ভিজিটিং স্কলার হিসেবে লালন ফকিরের জীবন ও দর্শন নিয়ে একটা নিরীক্ষামূলক নাটক তৈরি করতে। তখন বন্ধু সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় বার্কলি’তে অধ্যাপনা করছে। দুজনে মিলে এই কাজ করব।
১৯৯১ সালে যখন আমি নিউ ইয়র্কে থিয়েটার নিয়ে পঠন-পাঠন করছি, সেই সময় থেকে আমাদের দুজনের ইচ্ছে লালন ফকিরকে নিয়ে মঞ্চের জন্যে কিছু একটা করা। তার ছ’বছর পরে, সেই ইচ্ছের তাগিদেই ১৯৯৭ সালে আমি আর সুদীপ্ত বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় গেলাম লালনের আখড়ায়। শুরু হল তথ্য সংগ্রহ এবং অডিয়ো-ভিডিয়ো রেকর্ডিং। তারও সাত বছর বাদে এই বার্কলি’তে আদতে আমাদের লালনকে নিয়ে মঞ্চের কাজ শুরু হল। দুজন সঙ্গীতশিল্পী এবং সুদীপ্তকে নিয়ে প্রায় দেড় মাস মহড়ার পর সেই নাটকের মঞ্চায়ন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রদের সামনে— ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’ (ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস) হিসেবে।
এটাকে ঠিক প্রচলিত অর্থে নাটক বলা যাবে না, তাই আমরা প্রথম থেকেই এটাকে ‘পারফরম্যান্স’ বা ‘অভিনয়’ বলতাম। ‘কাজ চলিতেছে’— আমরা সব সময় রাস্তাঘাটে পিডব্লুউডি-র এ রকম নোটিস দেখে অভ্যস্ত এবং বিরক্ত। আমাদের অভিনয়ের সামনেও সে রকমই নোটিস ঝুলিয়ে দর্শকের সামনে মঞ্চায়ন করলাম। কারণ জানতাম, কঠিন এবং বিস্তারিত গবেষণা থেকে খুদে খুদে বের করা পরীক্ষামূলক এই অভিনয়কে আমরা সম্পূর্ণ একটা রূপ দিতে পারিনি। যদিও আশার বিষয়, অভিনয়ের শেষে প্রতিক্রিয়ায় বুঝলাম, কাজটা অসম্পূর্ণ বা আলগা থাকলেও, মানুষের মাথায় ব্রিজ ভেঙে পড়েনি।
অভিনয় শুরু হল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পরে প্রবাদপ্রতিম নাট্যতাত্ত্বিক এবং নির্দেশক রিচার্ড শেখনারের আমন্ত্রণ পেলাম নিউ ইয়র্ক-এর ‘অফ অফ ব্রডওয়ে’তে অভিনয় করার। সেটা ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’-এর প্রথম বড় প্রাপ্তি। নিউ ইয়র্কের যে মঞ্চে অভিনয়গুলো হল, সেটা ছিল ডাউনটাউন এলাকার ইস্ট ফোর্থ স্ট্রিটে। কাকতালের ব্যাপার, এই রাস্তার সঙ্গেই আমার নাট্যকলা শিক্ষার একটা বড় স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
১৯৯১ সালে এই রাস্তাতেই জো চেকিন, রুথ মেলাচেক, লিয়ো শ্যাপিরো ইত্যাদি খ্যাতনামা মানুষদের হাতে গড়ে উঠছিলাম। সেখানেই যে পনেরো বছর বাদে আমার নির্দেশিত কাজ মঞ্চস্থ হবে, সেটা কল্পনার অতীত ছিল। নিউ ইয়র্ক-এর অভিনয়গুলোর পর মঞ্চায়ন অনেক পালটে গেল। তার একটা কারণ: লালনের ওপর নতুন গবেষণা এবং তথ্য অভিনয়ে যুক্ত হল। আর একটা বড় কারণ, এই প্রথম আমরা বিদেশের মাটি ছেড়ে কলকাতায় অভিনয় করলাম। এত দিন মূলত বিদেশি দর্শকের সামনেই অভিনয় হয়েছে এবং তাঁদের কাছে লালন ফকির সম্পূর্ণ এক জন অচেনা মানুষ। তাই তাঁর জীবন ও ফকিরি বিষয়ক অনেক তথ্য বা ঘটনা একটু বিশদ ভাবে বিবৃত ছিল। কিন্তু দেশের মানুষের সামনে, বিশেষত বাঙালিদের কাছে অভিনয়ের আগে আমাদের সেই অতিরিক্ত বিন্যাস সম্পাদনা করতে হয়েছিল।
এ ছাড়াও ১৯৯৭ সালে কুষ্টিয়ায় দেখা লালন ফকিরের সেই উন্মুক্ত আখড়া ইতিমধ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে উঠেছিল লালন অ্যাকাডেমি। একটা বড় রকমের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় টানাপড়েন চলছিল লালনকে ঘিরে। সেই সব সংঘর্ষের অভিঘাত জুড়ে যাচ্ছিল নাট্যভাষের বয়ানে, অভিনয়ের শরীরে। আসলে সুদীপ্তর লেখা ও অভিনয়ে এবং আমার নির্দেশনায় তৈরি হওয়া এই অভিনয়ের ছিল অনেক খোলা মুখ।
লালনের জীবন ও দর্শন ব্যাখ্যায় যে বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই হল তাঁর যাপন, সংগীত এবং দর্শন নিয়ে তাঁকে একটা খোপে বা খাপে ফেলার অপচেষ্টা। লালনের দর্শনচিন্তা বা তাঁর ফকিরির ‘গভীর নির্জন পথে’ খুব কম গবেষকই পেরেছেন তাঁকে সেই নির্জনতার স্বাতন্ত্র্য দিতে। তাঁকে একটা নির্দিষ্টতায় বাঁধতে না পারলে তো দেশ, ধর্ম, সমাজের বৃহৎ তত্ত্ববিশ্ব আলগা হয়ে যাবে। যত ক্ষণ না প্রমাণ করা যাচ্ছে তিনি হিন্দু না মুসলমান, কী করে তাঁকে সহজ খাপে ফেলা যাবে? কিন্তু লালন তাঁর সমগ্র জীবন দিয়ে রহস্য করে গেছেন তাঁর জন্ম নিয়ে, কূটকচাল পাকিয়েছেন তাঁর পরিচয় নিয়ে, ধাঁধায় ধাঁধায় বেঁধেছেন তাঁর গানের বয়ান। ইতিহাসের, সমসাময়িকের, রাজনীতির, যৌনতার, ফকিরির নানা গূঢ় তত্ত্বে আমাদের বেহাল করেছেন। তাঁকে যে কোনও একমাত্রিক ব্যাখ্যায় বাঁধা অসম্ভব, সেটা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তাই আমরা অভিনয়ের বয়ানে চাইনি কোন সুঠাম ‘আর্কিটেকচার’ বা অনড় বুনোট বা নাট্য-ব্যাকরণসিদ্ধ শুদ্ধতা, যা আমাদের মঞ্চায়নকে স্থবির করবে। আমরা চেয়েছিলাম লালনের জীবন ও কর্মের ভুলভুলাইয়াতে ঘুরে মরতে। এ আমার কাছে এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মঞ্চ অভিজ্ঞতা। নানা নতুন নাটক করি, চলচ্চিত্র করি, কিন্তু বার বার ফিরে যাই ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’-এর এক নতুন অভিনয়ে।
এর পর ২০১০ সালে, লন্ডনের বিশ্বখ্যাত বারবিকান থিয়েটারে আমন্ত্রণ পেল ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’। বারবিকান-এর বায়না পাওয়া বড় দুষ্কর। কিন্তু মুশকিলের বিষয় হল বারবিকানের যে মঞ্চে আমাদের অভিনয় করতে অনুরোধ করা হল সেটা ঠিক এক দিকে মঞ্চ, অন্য দিকে দর্শক, এমন ব্যবস্থার নয়। এই মঞ্চের দু’দিকে দর্শক। অর্থাৎ পুরো নতুন করে ঢেলে সাজাতে হল অভিনয় এবং মঞ্চভাবনা। সেই অদলবদলের প্রক্রিয়া ঘটল লন্ডন থেকে একটু দূরে লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ে। লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং কারিগরি বিভাগের কর্মীদের নিয়ে প্রায় এক মাসের মহড়ায় তৈরি হল আর এক নতুন অভিনয়।
অভিনয়ের কয়েক দিন আগে আমরা দলবল পৌঁছলাম বারবিকানের পাশেই একটা হোটেলে। শেষ কয়েকটি মহড়া বা টেকনিকাল রিহার্সাল হবে বারবিকানের মঞ্চে। অভিজ্ঞতা হল কাজ করার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যন্ত্রকুশলীদের সঙ্গে। এ রকমই একটা মহড়ার ফাঁকে বারবিকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি আর সুদীপ্ত ধূমপান করছি। হঠাৎ দেখি রাস্তা পেরচ্ছেন বিশ্ববরেণ্য পিটার ব্রুক! হাতে একটা লম্বা পাউরুটি। এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকেই।
আমি সুদীপ্তকে এই কথা বলাতে ও প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। তার পরে সত্যি যখন মুখ ঘুরিয়ে দেখল, তখন হাতের সিগারেট ফেলে ঢিপ করে লন্ডনের ফুটপাতে ব্রুক-কে একটা প্রণাম করে ফেলল। তাতে ব্রুক এমনই লজ্জা পেয়ে গেলেন, আমি আর তাঁর বিড়ম্বনা বাড়ালাম না। আমরা যে ওঁর কতটাই ভক্ত, এ কথা বলতে বলতে ভুলেই গেলাম আমাদের অভিনয়ে ওঁকে আমন্ত্রণ জানাতে। টনক নড়ল যখন, উনি প্রায় অনেকটাই দূরে চলে গেছেন। আর ওই বৃদ্ধকে তাড়া করে বিব্রত করাটা সমীচীন মনে হল না।
তবে এটুকু ভেবে বেশ আত্মশ্লাঘা হয়েছিল যে আমাদের অভিনয়ের পরের সপ্তাহেই বারবিকানে ওঁর নতুন নাটকের প্রথম অভিনয়। ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’ আমেরিকা ও ইউরোপের নানা শহর ঘুরে, কলকাতায় বেশ কয়েক বার অভিনীত হবার পরেও আজও ‘কাজ চলিতেছে’। আজও লালন ফকির আমাদের কাছে নতুন নতুন অবতারে আবির্ভূত হচ্ছেন। তাই তাঁকে নিয়ে গাঁথা এই অভিনয় এত দিনেও সম্পূর্ণতা পায়নি।
sumanmukhopadhyay@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy