Advertisement
১১ মে ২০২৪

ভালবেসেছিল ট্রাপিজের মেয়েও

কিন্তু থাকল না। বেঁটে বলে সবাই মজা ওড়ায়। এ দিকে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও রিঙে নামা, টানা তিনটে শো লোককে হাসানো। অথচ মাইনে হাজার কয়েক। জোকারের জীবন যে রকম। গৌরব বিশ্বাস কিন্তু থাকল না। বেঁটে বলে সবাই মজা ওড়ায়। এ দিকে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও রিঙে নামা, টানা তিনটে শো লোককে হাসানো। অথচ মাইনে হাজার কয়েক। জোকারের জীবন যে রকম। গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

গাঁয়ের পথ ধরে পড়িমরি ছুটছে ছেলেটা। চটিজোড়া কখন খুলে গিয়েছে। পাথরকুচিতে পা কেটে রক্তারক্তি। তবুও ছুটছে। সে দৌড়ের যেন শেষ নেই। পিছনে ছুটে আসা ছেলেগুলোও ছাড়ার পাত্র নয়। ‘জোকার, জোকার... তোর দশ পা মানে তো আমাদের এক পা রে! না দৌড়ে বরং ডিগবাজি মার... অ্যাই জোকার!’

বড় রাস্তার মোড়ে এসে হাঁপাচ্ছে ছেলেটা। বয়স আঠারো। কিন্তু বাড়-বৃদ্ধি যেন থমকে গিয়েছে। দেখে মনে হয় বারো কি তেরো। তাই ‘বামন’, ‘নাটা’ এবং ‘জোকার’!

আচমকা ব্রেকের আওয়াজ। কখন পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে ম্যাটাডোরটা, ছেলেটা টেরই পায়নি। সম্বিৎ ফিরল ব্রেকের শব্দে। ব্যাক গিয়ারে পিছিয়ে আসছে গাড়িটা। পিছনের হুড খোলা। কতগুলো মুখের উঁকিঝুঁকি। ‘আমাদের সঙ্গে কাজ করবে?’ ছেলেটা অবাক, ওকেই বলছে? ‘ভাল মাইনে, থাকা-খাওয়া ফ্রি।’ হ্যাঁ, আশেপাশে আর তো কেউ নেই। ‘আমরা আছি ক’দিন। ভেবেচিন্তে জানিও। ধুলোয় ঘূর্ণি তুলে বেরিয়ে যায় গাড়ি। ছেলেটা চেয়ে থাকে। এরা কারা? হুবহু তারই মতো দেখতে!

সে জোকার দেখেছে গাঁয়েরই ধান-কাটা ন্যাড়া খেতে পড়া সার্কাসের তাঁবুতে। বড় বড় খিলাড়ির মাঝখানে তারা যেন নিছকই বাড়তি। তবু তারাই সার্কাসের জান! তারাই সেই ধরতাই, আগুনে-লাফ থেকে ট্রাপিজ-উড়ানের মধ্যে যারা টান টান করে রাখে ফুর্তির সুতো।

ওড়িশার জসিপুরে সে বার তাঁবু গেড়েছিল সার্কাস। ছেলেটা বছর দুই আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ দিয়ে তখন কাঠ বেকার। তাই কাজের প্রস্তাব যখন এল, ঢোক গিলে বলেই ফেলল, ‘আমার ভাইকেও নেবে তোমরা? ও আমার মতোই।’ বলো কী হে! একেবারে জোড়া জোকার! হেসে উঠল মুখগুলো। সে মুখে রং নেই, মুখোশও নেই।

১৯৮৪ সাল। ‘ফেমাস সার্কাস’-এ ঢুকে পড়ল জসিপুরের দুই ভাই, বসন্তকুমার নায়েক আর তুলসীদাস নায়েক। বাড়িতে মা-বাবা, চার ভাই, এক বোন। সবাই অন্যদের মতো। আলাদা কেবল ওরা। বাবা গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, ‘যে নাম শুনে রাগ করিস, শেষে সেই জোকারই হবি?’ বাদ সেধেছিলেন মা, ‘লক্ষ্মী বাপ আমার, দাদা-ভাইদের খেতের কাজে সাহায্য কর। সার্কাসে কী সব্বোনেশে সব খেলা দেখায়! তোরা পারবি না।’

সব্বোনেশেই বটে। ওই উঁচু দড়ি, ঝুলন্ত দোলনায় ঝুলতে ঝুলতে নাটুকে মুহূর্ত তৈরি করে পড়ে যাওয়া, নিখুঁত সময়জ্ঞান— চাট্টিখানি কথা! তবু ওঁরা পেরেছেন। সে সব ‘ট্রেনিং’-এর কথা বলতে গিয়ে বসন্ত-তুলসী আজও কপালে হাত ঠেকান সেই গুরুদের উদ্দেশে, যাঁরা প্রায় রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলেন দুই ভাইকে। বত্রিশ বছর কেটে গেছে তার পর। ফেমাস সার্কাস-এ বসন্ত-তুলসী জুটি রীতিমত ফেমাস। ইউটিউবে ‘ফেমাস সার্কাস’ টাইপ করলেই দেখা যাবে, পঞ্চাশ আর সাতচল্লিশের দুই যুবক কী ভাবে মাত করছেন সার্কাসের রিং।

যে রিঙে জোকারদের মুখ নয়, মুখোশটাই দেখতে আসে দর্শকেরা। যে মুখোশ হাসবে, হাসাবে। যে লালমুখো নাকওয়ালা মুখোশ দেখেই সবাই হেসে গড়াগড়ি যায়, সেটা সারাক্ষণ পরে থাকা যে কী রকম দমবন্ধ করা অভিজ্ঞতা, সে ধারণা ক’জনের আছে?

রাজা-রাজড়াদের আমলে ব্যঙ্গ-রঙ্গে সভা মাতাতে সিংহাসনের পাশেই থাকতেন বিদূষক। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে ন্যাকা গলায় সুর কেটে যাওয়া লোকটাকে মনে পড়ে? অবশ্য তাঁকে ঠিক জোকারের পূর্বপুরুষ বলা যাবে না। বরং যে ভাঁড়েরা মাঠে-হাটে-মেলায় লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, নিজেদের হাসির পাত্র করে তুলে চাষাভুষো-ব্যাপারি-মাতাল-গণিকাদের বিস্তর মজা দিতেন, তাঁরা জোকারের পূর্বসূরি বলে খানিক গণ্য হতে পারেন। শারীরিক কসরত আর ঠাট্টার তিরে নিজেকে বিঁধে, বোকামির বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠাই তো জোকারের আসল রসায়ন!

গ্রিক আর রোমান থিয়েটারে এক ধরনের বোকা চরিত্রের উপস্থিতি ছিল ধরাবাঁধা। জটিল নাটুকে টানাপড়েনের মধ্যে তারা হাসির খোরাক জোগাত। পরের চক্রব্যূহে ঢোকার আগে খানিক হাঁপ ছাড়ত দর্শক। উনিশ শতকের একেবারে গোড়ায় ব্রিটেনে জোসেফ গ্রিমাল্ডি পেশাদার জোকারের ধারণা নিয়ে আসেন। মুখে চড়া সাদা রং চাপানো নকশাও তাঁরই আমদানি। পরে তা-ই চালান হয়ে যায় সার্কাসে। সে হিসেবে গ্রিমাল্ডি-ই আধুনিক জোকারের স্রষ্টা। দিশি জোকারদের অনেকেই অবশ্য এ সব গল্প জানেন না। তাঁদের দৌড় বড়জোর
রাজ কপূরের ‘মেরা নাম জোকার’। আনমনেই গুনগুনিয়ে ওঠেন, জিনা য়হাঁ, মরনা য়হাঁ...

সিঁথির মোড়ে তাঁবু ফেলেছে ‘ফেমাস সার্কাস’। চট দিয়ে ঘেরা এক ফালি জায়গায় পাশাপাশি খাটিয়া বিছিয়েছেন বসন্ত-তুলসী। বিছানার পাশে মা কালীর ছোট-বড় ছবি। বসন্ত মন দিয়ে চুলে কলপ করছেন। তুলসীর স্নান সারা হলে তিনিও নামবেন। তার পর পুজো, খাওয়া-দাওয়া, মেকআপ। আর মঞ্চে ওঠার আগে অবশ্যই ৮৫ বছরের মা’কে এক বার ফোন। ‘মা, মা কালী, হাসি আর হাসানো, এই নিয়েই বেশ আছি!’ বসন্ত চকিতে এক বার তাকান তাঁবুর বাইরে। ‘এই ভাই, আর জল ঢালিস না। ঠান্ডা লেগে যাবে।’ ‘তোমার সবেতেই চিন্তা। রোদ্দুরে জল গরমই আছে...’ তাঁবুর পাশে খোলা জায়গায় স্নান করছিলেন তুলসী। অজস্র দড়ি ওপর থেকে নেমে গোঁজের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। সেই দড়ির নীচে, প্লাস্টিকের বালতি থেকে একটু উঁচুতে ভেজা জামাকাপড় শুকোতে দিলেন। ওটাই তাঁর জন্য সবচেয়ে উঁচু দড়ি।

খানিক দূরে পা ছড়িয়ে বসে সার্কাস ম্যানেজার। একটু তফাতে পা ঠুকছে কয়েকটা ঘোড়া। উলটো দিকে তিনটে হাতি বিরক্ত মুখে শুঁড়ে খড় তুলে ছিটোচ্ছে। বন্ধ গেটের বাইরে থেকে তাই দেখেই বেজায় খুশি কচিকাঁচার দল। সার্কাসের প্রথম শো শুরু হতে এখনও দেরি আছে। ইতিমধ্যে খাওয়া সেরে দুই ভাই বসে পড়েছেন মেক-আপে। জিঙ্ক অক্সাইড আর নারকেল তেলে গোলা সিঁদুর।

মা কখনও সার্কাসে এসে আপনাদের কেরামতি দেখেছেন? হেসে ওঠেন দুই ভাই, ‘বছর কয়েক আগে জসিপুরে গিয়েছিল আমাদের টিম। সেখানে প্রথম শো-তে মাকেও নিয়ে এসেছিলাম।’ আর বাবা? মুখে রং বোলাতে বোলাতে থমকে যান বসন্ত। ‘সে সুযোগ আর পেলাম কই! ১৯৯১ সালে, আমরা তখন হাওড়ার জাঙ্গিপাড়ায়। প্রতিটা শো হাউসফুল। তুলসী বাড়ি গিয়েছে। একা আমাকেই সব সামলাতে হচ্ছে। হঠাৎ খবর পেলাম, বাবা নেই। স্ট্রোক।’ দু’-এক মুহূর্ত মাটির দিকে চেয়ে চুপ। ‘সে দিনও তিনটে শোতেই কাজ করেছি, জানেন! হেসেছি, শো হাসিয়েছি।’ ঠিক এই সময়ে, যেমন খেই ধরতে হয় রিঙে, কথাটা ধরে নেন তুলসী। ‘জানেন, কাল কী হয়েছিল? টুলের ওপর আমি দাঁড়িয়ে খেলা দেখাচ্ছি। হাতে জলের গ্লাস। আচমকা দুম করে পিছনে লাঠির ঘা দিল দাদা। লোকজন হেসেই খুন। আমার কিন্তু বড্ড লেগেছে!’ শুনে ভাইয়ের দিকে চেয়ে হেসে ফেলেন বসন্ত। এই হাসিটা সত্যি!

সকলেই যে এ রকম এক ঠাঁইয়ে ফেমাস হয়ে যান, তা অবশ্য নয়। কুড়ি বছর বয়সে সার্কাসে ঢুকেছিলেন ছোটন যাদব। দেখতে দেখতে পঁচিশটা বছর কেটে গিয়েছে। অজন্তা, মুনলাইট, নিউ নটরাজ, কোহিনুর হয়ে তিনি এখন ‘অলিম্পিক সার্কাস’-এ।

সোদপুর স্টেশন লাগোয়া মাঠে অলিম্পিক-এর তাঁবু পড়েছে। ক’মাস আগে ভাই মহেশ আর ভগ্নীপতি ভরতকেও নিয়ে এসেছেন বিহারের গুণসাগরের বাড়ি থেকে। এখন তাঁবুর নীচে তিন জোকারের সংসার। দুজনকে নিজের হাতে কাজ শেখাচ্ছেন ছোটন। ওই সময়টুকু তিনি গুরু, বাকি সময়ে বন্ধু। রাত ন’টায় শো শেষ হলে বসে রামের আসর। রাত যত বাড়ে, মেজাজ তত খোলতাই হয়। ছোটন একটার পর একটা গান গেয়ে যান— মুকেশ, মহম্মদ রফি, কিশোরকুমারের ‘স্যাড সং’। দিনভর লোক হাসিয়ে রাতে দুঃখের গান না শুনলে ওঁর ঘুম আসে না। কখনও স্বপ্নে দেখেন, ‘জেমিনি সার্কাস’-এর পরদা সরিয়ে বেরিয়ে আসছেন রাজ কপূর, বা মোবাইলে অনর্গল কথা বলে চলেছে এক তরুণী, মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। আপনার স্ত্রী? ‘আরে না না! কয়েক বছর আগে ফোনেই আলাপ হয়েছিল। রোজ কত কথা হত! প্রেমের দিব্যি দিয়ে ঘর বাঁধার কথা। বলেছিলাম, আমি কী। ও বলেছিল, কোনও অসুবিধা নেই। ভগবান তো সবাইকে সব কিছু দেন না! এক দিন ঠিক করলাম, দেখা করব। মেয়েটিও রাজি হল। কিন্তু দেখামাত্র আঁতকে উঠে মুখ ঢেকে বলল, ইতনা শর্ট হাইট! ব্যস। প্রেম ফিনিশ।’

এই হাইট নিয়েই ছোটন এখন সার্কাসের স্টার। আর প্রেম? আবার এসেছে। নদিয়ার এক বাঙালি তরুণী। সার্কাসে ছোটনের খেলা দেখে হাসতে-হাসতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন জ্যোৎস্না। না, হাইট বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ছোটনের হাসিতে উছলে পড়ে চাপা গর্ব, ‘ও কিন্তু আমার থেকে অনেক লম্বা! তবে ছেলেটা হয়েছে আমার মতো।’ বলেই হঠাৎ গম্ভীর, ‘ওকে কোনও দিন সার্কাসে আসতে দেব না। যত কষ্ট হোক, পড়াব।’

আসলে অভাবের সংসারে কিছু করতে হবে বলে সার্কাসে ঢুকেছিলেন ছোটন। চার ভাই দুই বোন, বাবা আর মেজদা ছাড়া সকলে বামন। বোনের বিয়ে দিয়েছেন বন্ধু ভরতের সঙ্গে। তিনি আগে দিল্লিতে মার্বেল কারখানায় কাজ করতেন। রোজগারও মন্দ হত না। কিন্তু মহেশও সার্কাসে ঢুকে পড়েছে শুনে আর দেরি করেননি। লোটাকম্বল গুছিয়ে সোজা সার্কাসে। এখন তিন জোকার যখন দর্শকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান, রিংটাই যেন হয়ে ওঠে গ্রামের ফেলে আসা খেত। প্রাণ খুলে মজা করেন ওঁরা। আর হাসিতে ফেটে পড়ে গ্যালারি।

হাসতে-হাসতে অনেকেরই চোখে জল আসে। কিন্তু কাঁদতে-কাঁদতে হাসতে পারা কি অত সহজ? বিয়েটা যে দিন ভেঙে গেল, সে দিনও মুখে রং ঘষে ‘এম্পায়ার সার্কাস’-এর রিঙে নামতে হয়েছিল শেখ মন্টুকে। সে কথা অবশ্য আজও এড়িয়েই যান। বলেন, ‘থাক ও সব। জীবন তো নদীর মতো, দিব্যি বয়ে চলে।’ অতীত ভুলে থাকা কি এতই সহজ! মন্টু তা-ও পারেন, কিন্তু ইরফান? সার্কাসের রিং, খেলা, হাসি, মুখোশ, সব আছে। নেই শুধু জিমন্যাস্টিক্সে দড় সেই ছিপছিপে মেয়েটা। জোকার ইরফানের প্রেমে পড়েছিল সে। দেখে ঈর্ষায় জ্বলত তাঁবুর অনেকে। ‘হাইটওয়ালা’রা যার মন ভেজাতে পারল না, সে কি না মুখ গুঁজবে জোকারের বুকে! সে দিনও ইরফানের পাশে ছিল জোকার-বাহিনী। সার্কাসে প্রেম-পিরিতি নিয়ে মালিকদের খুব কড়াকড়ি। যা করতে হয় লুকিয়ে-চুরিয়ে। জোকার বন্ধুরা না থাকলে কাগজে মুড়ে কাচের চুড়ি আর কার হাত দিয়েই বা পাঠানো যেত? ইরফান বলেন, ‘সে এক সময় গিয়েছে। সবাই দুটো শো করে ক্লান্ত, আমরা টানা তিনটে শো করছি। রিঙে থাকা মানেই তো কাছাকাছি, একসঙ্গে থাকা।’

বিয়ে হল। দুজনের পাতা সংসার পেরোল এক, দুই, পাঁচ বছর। তার পর এক দিন শূন্য থেকে নেমে আসা এক ট্রাপিজ যে ছোঁ মেরে কোথায় নিয়ে গেল তাঁর সুন্দরী বৌকে, কোনও হদিশ পাননি ইরফান। গোড়ায় ক’দিন খোঁজাখুঁজি করেছিলেন, এখন আর খোঁজেন না।

কাটোয়ার মন্টু সার্কাসে ঢুকেছেন সতেরো বছর বয়সে। বিহারের গোপালগঞ্জ থেকে আসলাম শেখ চলে এসেছিলেন, তখন বয়স মোটে দশ। দুজনেই চুটিয়ে কাজ করছেন। পাটুলির ময়দানে বিরাট তাঁবুর নীচে দাঁড়িয়ে একমুখ হাসি ছলকে আসলাম বলেন, ‘লোক হাসিয়েও যে ভিআইপি হওয়া যায় কে জানত! কত লোক আমার সঙ্গে সেল্‌ফি তুলতে চায় জানেন!’ মন্টু জানান, তাঁদেরই পরিচিত কয়েক জন ‘ছোটদের ছবি’ সিনেমায় অভিনয় করেছে। ‘এই তো সে দিন একটা টিভি শো-য় গেলাম, কুমার শানুর সঙ্গে দেখা হল! অনেক ক্ষণ গল্প করলেন!’

ভিআইপি যখন, রোজগারও নিশ্চয়ই ভিআইপি-র মতোই? না, সে অঙ্ক মেলার জো নেই। কারও মাসমাইনে আট হাজার, কারও মেরেকেটে বারো। তাও গত পনেরো-বিশ বছরে বাড়তে বাড়তে এই। বেতন বাড়াতে ছোটন একটার পর একটা দল ছেড়েছেন। তিনিই সবচেয়ে বেশি পান, দশ হাজার। তার থেকেই যা হোক কিছু বাঁচিয়ে ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখেন। অনেক কষ্টে গ্রামে কিছু জমি-জিরেতও করেছেন। বাকিরা তাও পারেননি। তবু তো মন্দের ভাল, সার্কাসে থাকা-খাওয়ার খরচা নেই। সে সব কর্তৃপক্ষই জোটায়। তবু কাঁচা টাকাও তো লাগে। আগে লোকে খুশি হয়ে সেফটিপিন দিয়ে জামায় পঞ্চাশ-একশোর নোট আটকে দিত। সে দিন আর নেই। বাঘ সিংহের খেলা বন্ধ হওয়া ইস্তক সার্কাসের জৌলুসই কমে গিয়েছে। নোট বাতিলের ৮ নভেম্বরের পর থেকে অবস্থা আরও করুণ। শীত-বিকেলের মাঠে চাট্টি মরা ঘাস আর নাছোড় বাচ্চা ছাড়া কেউ নেই। সার সার চেয়ার খাঁ-খাঁ। খালি তাঁবুতেই লম্ফঝম্প করে বেড়াচ্ছে ফোল্লা জামা, ঝোল্লা প্যান্ট, রংচঙে টুপির দল।

কাজ ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না কখনও? করে। কিন্তু কোথায় যাব? আর তো কিছু শিখিনি কোনও দিন। এখন আবার জন্তুর অভাবে গোরিলাও সাজতে হচ্ছে। আরও কত কী করতে হবে, কে জানে! বিষণ্ণ হাসেন তুলসী।

শীতের আলসেমি কাটিয়ে গমগম করে ওঠে মাইক: সার্কাস মে আপলোগকো হার্দিক শুভকামনায়ে! মেক-আপ শেষ, ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলে ধীর পায়ে রিঙের দিকে এগোন বসন্ত আর তুলসী। ঝমঝমিয়ে ওঠে বাজনা। হাততালি, শিস, মুখে ঠিকরে পড়া আলো। জিনা য়হাঁ, মরনা য়হাঁ, ইসকে সিবা জানা কাহাঁ...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jokers Circus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE