Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ভূতের বাড়ি, ভূত নেই

এক তলায় পর পর কয়েক বার প্রচণ্ড শব্দ হল। তিন তলায় দক্ষিণ দিকের কোনার ঘরে শুয়ে থাকা গৌতমবাবুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সেই শব্দে। কোনও মতে হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বেলে দেখলেন, রাত দুটো কুড়ি! শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, কাঠের সদর দরজাটায় কারা যেন কিছু দিয়ে দমাদ্দম মারছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

এক তলায় পর পর কয়েক বার প্রচণ্ড শব্দ হল। তিন তলায় দক্ষিণ দিকের কোনার ঘরে শুয়ে থাকা গৌতমবাবুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সেই শব্দে। কোনও মতে হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বেলে দেখলেন, রাত দুটো কুড়ি! শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, কাঠের সদর দরজাটায় কারা যেন কিছু দিয়ে দমাদ্দম মারছে।

পুরনো রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ির সিঁড়ি-বাঁক-গলি-দরজা-উঠোন পেরিয়ে তিন তলা থেকে এক তলায় নামতেই পাঁচ-সাত মিনিট লেগে যায়। হাঁপাতে-হাঁপাতে গিয়ে দেখেন, পেল্লায় সদর দরজার একটা পাল্লা তত ক্ষণে আধখানা ভেঙে ঝুলছে। সেই ফাঁক দিয়ে চার জন লোক বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়েছে।

অন্ধকারের মধ্যেই গৌতমবাবুর মনে হল, এক জনের হাতে গাড়ির জ্যাকের মতো কিছু। আর এক জনের হাতে মোটা একটা লাঠি। আর এক জনের হাতে গোল কম্পাসের মতো কিছু একটা। রাতদুপুরে পরের বাড়ির দরজা ভেঙে ঢোকার পরেও তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। উলটে চার জনই সেই যন্ত্রটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিছু একটা দেখছে— ‘ওই যে, কাঁপছে, কাঁপছে। এখানেই আছে। একদম ঠিক ইনফর্মেশন।’

গৌতম নট্ট-উত্তম নট্ট প্রথমে ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই ডাকাত ঢুকেছে। কিন্তু ডাকাতদের কাজকারবার দেখে তাঁরাও তখন হতভম্ব। অদ্ভুত যন্ত্রটা হাতে নিয়ে লোকগুলো ছুটে-ছুটে অন্ধকার চাতালের এ দিক-ও দিক যাচ্ছে আর সেটা উঁচু করে ধরে উৎসাহে চেঁচাচ্ছে, ‘নড়ছে, কাঁপছে, কাঁপছে, দুলছে।’

প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে তাঁরা চিৎকার করে উঠতেই ওই চার জনের যেন হুঁশ ফিরল। কাঁচুমাচু হেসে, নরম গলায় বলল—‘সরি, দাদা। অনেক ক্ষণ ডাকাডাকি করেছিলাম, কড়াও নেড়েছি। কিন্তু আপনারা শুনতে পাননি। এ দিকে রাত শেষ হয়ে আসছে। একটু আলো ফুটলেই তো ওদের আর পাব না। রানাঘাট থেকে এত দূর আসাটাই বৃথা হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে দরজাটা একটু ভাঙতে হয়েছে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’

তার পর চোখ বড়-বড় করে, গলার স্বরে খাদে নামিয়ে মতামত দিল, ‘আপনারা তো রত্নখনির মধ্যে বসে আছেন মশাই! বাড়িতে ঢুকেই আন্দাজ করেছিলাম। তার পর এই যন্ত্রও দেখিয়ে দিল। অতৃপ্ত আত্মা একেবারে গিজগিজ করছে। আমাদের গবেষণার বিষয়টাই এটা। এই দেখুন, এটা হল আত্মা খোঁজার যন্ত্র। যেখানে যন্ত্র নিয়ে যাচ্ছি সেখানেই কাঁটা থরথরিয়ে নড়ছে। মানে, আত্মা কিলবিল করছে!’

উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে একেবারে গঙ্গার ধার ঘেঁষে অপরিসর, নোনা-ধরা হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট। সেই রাস্তার শেষ প্রান্তে ১৭ নম্বর বাড়ির বাসিন্দারা অদ্ভুত ফ্যাসাদে পড়েছেন। প্রায় পৌনে দু’শো বছরের পুরনো বাড়িতে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা বাস করতে শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকে। এমন উপদ্রব কখনও হয়নি। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে ভূতপ্রেমী, ভূতদর্শনকামী এবং ভূত-বিশারদদের ক্রমাগত অত্যাচারে এখনকার বাসিন্দারা বিপর্যন্ত।

এই ইন্টারনেট-যুগে কিনা কলকাতার বুকে ভূত দেখার জন্য শয়ে-শয়ে লোক সকাল-বিকেল-রাত হত্যে দিচ্ছে! যখন-তখন বাড়িতে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, মায় ঠাকুরঘর-রান্নাঘর-বাথরুমে ঢুকে পড়ছে। কেউ স্বচক্ষে ভূত দেখতে চায়, কেউ ভূতের ছবি তুলতে চায়, কেউ ‘ভূতের বাড়ি’তে রাত কাটানোর গা শিরশিরে অনুভূতি পেতে চায়।

কিন্তু কথা হল, সব্বাইকে কে জানিয়েছে যে এটা ভূতের বাড়ি?

উত্তর নেই। প্রাসাদের মতো বাড়িটা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকটা ভূতের বাড়ির চেহারা নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কলকাতার রাস্তাঘাটে এ রকম বাড়ি যে আর নেই তা নয়। তবু কেমন করে যেন লোকের মুখে ‘ভূতের বাড়ি’র প্রচার হয়ে গিয়েছে। এক-আধটা লেখাও বেরিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্যস! নাজেহাল বাসিন্দারা মরিয়া হয়ে বাড়ির বাইরে নজিরবিহীন মস্ত সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন—‘অযথা গুজবে কান দেবেন না, ভূত সংক্রান্ত তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ বিষয়ে জানতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করবেন না।’

বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা বলে, কোনও উৎসব-অনুষ্ঠান বা ছুটির দিন মানেই দলে দলে ছেলেমেয়ে, এমনকী অ্যাডভেঞ্চারকামী বিদেশিরাও ভিড় জমাবে। সারা দিন সদর দরজায় তালা দিয়ে পাহারা বসিয়ে রাখতে হবে। বাড়িতে তাঁদেরও ঢোকা-বার হওয়া দুষ্কর হবে। অথচ ওই বাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাংলার প্রখ্যাত যাত্রা সংস্থা নট্ট কোম্পানির ইতিহাস!

কলকাতায় এই বিখ্যাত সংস্থার অফিস স্থাপন এবং পরিবারের বাসিন্দাদের বাসের শুরু এই বাড়িতেই চল্লিশের দশকে। খাতায়-কলমে তাঁরা বাড়িটি কিনে নিয়ে রেজিস্ট্রি করেন ১৯৭৮ সালে। কমল মিত্র, বসন্ত চৌধূরী, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, বীণা দাশগুপ্ত, বেলা সরকার, শান্তিগোপাল, রবি ঘোষদের মতো মানুষের আসা-যাওয়া-আড্ডা-মহড়ার সাক্ষী এই বাড়ি। এই বাড়িতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন সংস্থার প্রধান মাখনলাল নট্ট। এখনও তাঁর ঘরে চেয়ারের উপর তাঁর ছবি আর তাঁর মৃত্যুর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো শোকবার্তা সাজানো রয়েছে।

অসাধারণ স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিরিখে ১৯৯৫ সালে এই বাড়িকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটি। সেই বাড়িরই এখন পরিচয়—‘ভূতের বাড়ি’! ১৯৯৫-এর পর থেকে আজ পর্যন্ত হেরিটেজ কমিটি বাড়ির একটি ইটও সারায়নি। কমিটির প্রধান সুব্রত শীলের সোজাসাপটা ব্যাখ্যা, ‘এই রকম হেরিটেজ ঘোষিত বাড়ি কলকাতায় অনেক আছে। সব যদি আমাদের সংস্কার করতে হয় তা হলে পুরসভা ফতুর হয়ে যাবে।’

বাড়ির তিন তলায় মাখনলালবাবুর ঘরেই কাঠের তক্তপোশে বসে মাখনলালবাবুর দুই ভাইপো গৌতম নট্ট ও উত্তম নট্ট বললেন, ‘বাড়ির ঐতিহ্য-স্থাপত্য-গরিমা আগেই রসাতলে গিয়েছিল, এখন আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ছারখার হতে বসেছে। অথচ নিজেরা ছোটবেলা থেকে ভূতের ছায়াটি দেখলাম না!’

বাড়ি বটে একখানা। থাম-খিলান-জাফরি-খড়খড়ি-শ্বেতপাথরের মেঝে-ঝাড়বাতি-টানা বারান্দা-নাটমন্দির, উঠোন, বিশাল-বিশাল কাঠের সিঁড়ি, ভুলভুলাইয়ার মতো খাঁজখোঁজ, অজস্র তালাবন্ধ ঘর, প্রতিটি থামের উপর-বারান্দার উপর পুতুলের মূর্তি, আর ছাদের মাথায় একাধিক দাঁড় করানো একাধিক সিমেন্টের পুতুল। তাই এলাকায় ওই বাড়ির পরিচয় ‘পুতুল বাড়ি’ নামে।

কিন্তু তার চেয়ে নিশ্চয় ‘ভূতের বাড়ি’ তকমা-টার অনেক বেশি টিআরপি! তাই লোকে ওই নিয়েই লাফাচ্ছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Parijat Bandyopadhyay haunted house Rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE