Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Matheran

দূষণমুক্ত শৈল শহর

সবুজে ঘেরা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে রূপকথার মতোই সুন্দর মহারাষ্ট্রের মাথেরানপুণে থেকে মাথেরানের দূরত্ব সড়কপথে ১২০ কিলোমিটার। আমরা ১২ জন একটি টেম্পো ট্রাভেলার করে নেরাল এসে পৌঁছই।

গ্রিন ভেলভেট: উপরে উঠলেই ঘিরে ধরে সবুজ

গ্রিন ভেলভেট: উপরে উঠলেই ঘিরে ধরে সবুজ

তানিয়া রায়
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:৫১
Share: Save:

এ যেন ছোট্ট এক রূপকথার শহর। পর্যটকদের নিভৃত অবসরের পাহাড়ি ঠিকানার নাম হতেই পারে মাথেরান। ‘মাথেরান’ আসলে মরাঠি একটি শব্দ। এর অনেক মানে রয়েছে। যেমন— ফরেস্ট অব দ্য টপ, ইডেন অব কোঙ্কণপট্টি, উডল্যান্ড ওভারহেড, মাদার ফরেস্ট।

ইতিহাস আওড়ায় না মাথেরান। নেই হাতে গোনা কোনও দ্রষ্টব্য স্থান। শুধু মাত্র যারা প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চান, দূষণমুক্ত ছোট্ট শৈল শহরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে চান, এই জায়গা তাঁদের জন্যই।

পুণে থেকে মাথেরানের দূরত্ব সড়কপথে ১২০ কিলোমিটার। আমরা ১২ জন একটি টেম্পো ট্রাভেলার করে নেরাল এসে পৌঁছই। মুম্বই থেকেও আসা যায়। নেরাল থেকে বড় গাড়ি উপরে ওঠে না। অগত্যা ভাড়ার দুটো ছোট গাড়ি নিতে হয় আমাদের। আলাদা যেতে কারও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় উপায় না থাকায় অগত্যা মুখ ভার করে ভাড়ার গাড়িতেই চড়ে বসতে হল। নেরাল থেকে মাথেরান পর্যন্ত একটি ন্যারোগেজ টয়ট্রেন রয়েছে। বর্ষা ও বন্যার জেরে ট্রেন লাইন ভেঙে গিয়েছে। তাই ট্রেন বন্ধ। এখন ট্রেনটি চলছে আমান লজ স্টেশন থেকে। গাড়ি যত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগল, ততই যেন মন হারিয়ে যেতে লাগল সবুজে। দিগন্তের নীলরেখা এসে মিশেছে সবুজ বনান্তরে।

পাহাড়ি রাস্তার বাঁক পেরিয়ে দ্রুত গাড়ি উপরে উঠছিল। গন্তব্য ছিল ১৮ কিমি দূরে দস্তুরি পার্কিং এরিয়া। এই জায়গাটি হল মাথেরানের প্রবেশদ্বার। এর পরে আর গাড়ি যায় না। এখান থেকে একটু এগোলেই আমান লজ স্টেশন। আমাদের জন্য ট্রেন দাঁড়িয়েই ছিল। টিকিট আগে থেকে কাটা। আমার বোনপোর হাত ধরে দৌড় লাগালাম ট্রেনের দিকে। নেরাল থেকে ট্রেনে চাপতে না পারার দুঃখে যেন কিছুটা প্রলেপ পড়ল। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন রওনা হল মাথেরানের দিকে।

ট্রেনে উঠেই জানালার ধারের একটা সিট নিয়ে বসে পড়লাম। একটা আদিম রোম্যান্টিকতা রয়েছে এই জায়গাটার মধ্যে। তবে ট্রেনের যাত্রা বড়ই সংক্ষিপ্ত। মাত্র ১৫ মিনিটের ট্রেন যাত্রার মুগ্ধতা নিয়েই হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। ট্রেন ছাড়াও আমান লজ থেকে মাথেরান যাওয়ার বেশ কয়েকটি উপায় আছে। আপনি ঘোড়ায় চড়ে অথবা টানা-ঠেলা রিকশা করেও যেতে পারেন। এখানকার রিকশা ছোট। এক জন যাত্রীই নিতে পারে। রিকশাপিছু চালক থাকেন দু’জন করে। একজন টানেন আর অন্যজন পিছন থেকে ঠেলেন। অসুবিধে না থাকলে তিন কিমি পথ অনায়াসে হেঁটেই পার হওয়া যায়। প্রচুর হোটেল রয়েছে মাথেরানে। আছে ব্রিটিশ ও পারসিদের ফেলে যাওয়া কিছু বাংলো, যা এখন হোটেল হিসেবেই ব্যবহৃত। আমাদের হোেটল ছিল জঙ্গলের মাঝে। লাল মাটির অপ্রশস্ত রাস্তা, ঘোড়ার খুরের শব্দ— সব মিলে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

যখন হোটেলে ঢুকছি, সকলের পেটে তখন ইঁদুর দৌড়চ্ছে। একটু ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলের দিকে দৌড় দিলাম। খেয়ে উঠে জিরিয়ে নিয়ে প্যানোরমা পয়েন্টের দিকে চললাম। এখান থেকেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে ৩৬০ ডিগ্রিতে দেখতে পাওয়া যায়। উপরি পাওনা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অসাধারণ ভিউ। আলস্য জড়ানো পুরো বিকেলটাই আমরা প্যানোরমা পয়েন্টে কাটিয়ে, সূর্যাস্তের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। অদ্ভুত শান্তির ছোঁয়া তখন মনে। গোটা মাথেরান জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে মোট ৩৮টি ভিউ পয়েন্ট। যার মধ্যে প্রায় দশটি বেশ নাম করা। শহরের পূর্ব দিকে যেমন রয়েছে মাধবজি পয়েন্ট, খান্ডালা পয়েন্ট, তেমনই শহরের পশ্চিমে ঘন জঙ্গল পার হয়ে পাবেন লুইস পয়েন্ট, ইকো পয়েন্ট, হানিমুন পয়েন্ট, মালোদা পয়েন্ট, মাঙ্কি পয়েন্ট, হার্ট পয়েন্ট, সানসেট পয়েন্ট ইত্যাদি। হার্ট পয়েন্ট, লুইস পয়েন্ট বা রামবাগ পয়েন্ট থেকে পাহাড়ের নীচের সমতলভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পাহাড়ের পাশাপাশি শার্লট হ্রদ এই অঞ্চলকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। পরদিন সকালে আমরা শার্লট হ্রদের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বেশ কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট দেখারও ইচ্ছে ছিল। কারণ পরের দিন সকালেই আমাদের ফেরার কথা। তাই যতটা দেখে নেওয়া সম্ভব, প্রাণভরে দেখে নিতে চেয়েছিলাম। পায়ে হেঁটেই পাহাড়চুড়োয় অরণ্যে ঘেরা শার্লট হ্রদে যাওয়া হল। জঙ্গলের পাতার মর্মরধ্বনি যেন স্বাগত জানাল। শহরের দক্ষিণে জাম্বুল বৃক্ষের ওয়ান ট্রি হিল বলিউডের শুটিং স্পট হিসেবে পরিচিত। আর মেঘহীন রাতে পাহাড় প্রান্তের লুইস পয়েন্ট থেকে মুম্বই শহরের আলোকমালাও দেখা যায়। মেঘ আর কুয়াশা থাকায় যেটা আমরা দেখতে পাইনি।

মাথেরান ভ্রমণের আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে মার্চ। এই সময় হালকা শীতের আমেজ থাকে। বর্ষায় বেশির ভাগ সময়ে ধস নামে। ফলে ঝুঁকি থাকে। তবে ভরা বর্ষায় এই জঙ্গলে ট্রেক করে ওঠার মজাই আলাদা। সবুজ পাহাড়, উচ্ছল জলপ্রপাত পেরিয়ে মাথেরানে অনেকেই পৌঁছে যান মাত্র ছ’ঘণ্টায়। মাথেরানকে উপভোগ করতে হলে অন্তত তিন-চার দিন থাকতেই হবে। আমাদের দু’রাত্রিবাস যেন বড় কম সময় ছিল। তাই অনেক কিছু দেখতে না পাওয়ার আফসোস নিয়েই ফেরার পথ ধরতে হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Matheran maharashtra travel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE