Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভূমধ্যসাগরে লুকনো দ্বীপ

কোনও দেশের ইতিহাস নির্ধারিত হয়, তার ভৌগোলিক অবস্থানের উপর— নেপলিয়ন বোনাপার্ট-এর এই কথাটা কিন্তু মল্টা-র ক্ষেত্রে ভীষণ ভাবে সত্যি। প্রাকৃতিক সম্পদ সাধারণ পর্যায়ের হলেও মল্টা-র কেন্দ্রীয় অবস্থানের জন্য দেশটা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের আক্রমণের শিকার হয়েছে। ছোট্ট এই দেশটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ করে কবজা করতে চেয়েছিল। তার কারণও কিন্তু এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান। লিখছেন পার্থ মণ্ডল।

পার্থ মণ্ডল
লন্ডন শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০২
Share: Save:

কোনও দেশের ইতিহাস নির্ধারিত হয়, তার ভৌগোলিক অবস্থানের উপর— নেপলিয়ন বোনাপার্ট-এর এই কথাটা কিন্তু মল্টা-র ক্ষেত্রে ভীষণ ভাবে সত্যি। প্রাকৃতিক সম্পদ সাধারণ পর্যায়ের হলেও মল্টা-র কেন্দ্রীয় অবস্থানের জন্য দেশটা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের আক্রমণের শিকার হয়েছে। ছোট্ট এই দেশটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ করে কবজা করতে চেয়েছিল। তার কারণও কিন্তু এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান।

কর্তা-গিন্নি আর সাত বছরের কন্যা— সকল অর্থেই এক ভ্রমণপিপাসু পরিবার। ‘বাজেট ট্যুরিস্ট’ আমরা। তাই, কোথায় ঘুরতে যাব সে জায়গা নির্বাচিত হয় রাহা-খরচের উপর! কারণ, ইউরোপীও দেশগুলিতে মোটামুটি ভাবে খাওয়া-খরচ আর থাকার খরচ প্রায় একই। তাই যখন দেখলাম, মল্টা-র যাওয়ার বিমান ভাড়া অন্য জায়গার থেকে তুলনামূলক ভাবে কম, নির্দ্বিধায় তাই সেখানে টিকিট কেটে ফেলা গেল। গুগল করে জানা গেল, ওই সময় মল্টা-র আবহাওয়াও মোটামুটি নাতিশীতোষ্ণ।

ভূমধ্যসাগরে সিসিলি দ্বীপের দক্ষিণে মূলত তিনটে দ্বীপ নিয়ে মল্টা। যাদের মধ্যে মল্টা আর গোযো-তে মানুষের বসবাস। এই দুই দ্বীপের মাঝে রয়েছে জনবসতিহীন তৃতীয় দ্বীপ কমিনো। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে মল্টায় সারা বছর পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে। গোটা দেশটা আয়তনে কলকাতার থেকে মাত্র দেড়গুণ বড়— মোটে ৩১৬ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা? ৫ লাখের মতন। কলকাতার জনসংখ্যার ১০ ভাগের মাত্র এক ভাগ। এ দেশে ভারী শিল্পবান্ধব প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল। জল বা কয়লার কোনও পর্যাপ্ত উৎস এখানে নেই। তবে, শুধুমাত্র ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য দেশটা কয়েকশো বছর ধরেই বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বাণিজ্য ও প্রমোদ, এই দুই ধরনের তরীই মল্টায় নীরবচ্ছিন্ন ভাবে নোঙর ফেলেছে। এখানকার বিভিন্ন প্রাসাদ এবং অট্টালিকার স্থাপত্যশৈলীর মধ্যযুগীয় স্বতন্ত্রতা হলিউডের পিরিয়ড ফিল্ম নির্মাতাদের বিভিন্ন সময়ে লুব্ধ করেছে। এ দেশের প্রধান খনিজ উৎপাদন লাইমস্টোন। কৃষি, মৎস্যশিকার ও পশুপালন ভালই হয়— গ্রামগুলি মোটের উপর বেশ সমৃদ্ধ। আলু আর টোম্যাটো ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ভূমধ্যসাগরীয় ফলের চাষ হয়। স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন ফলজাত সুরা উৎপাদন শিল্প এখানে আছে। ইদানীং কালে পরিষেবামূলক শিল্পও এখানে গড়ে উঠেছে। রাজধানী শহর ভ্যালেটা। শহরটির আয়তন এসপ্ল্যানেড-পার্ক স্ট্রিট চত্বরের থেকে খুব একটা বেশি হবে না। কালে কালে যে সমস্ত বহিরাগত জাতিগোষ্ঠী মল্টা অধিকার করেছে, তাদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে আগত সেন্ট জন–এর নাইটবাহিনীর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল। এই নাইটরা পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইওরোপের মুসলমান আগ্রাসন থেকে খ্রিস্টানদের রক্ষা করত। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মল্টা ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল বলে এখানে ইংরেজ প্রভাব যথেষ্টই রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাষা মল্টিজ হলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু ইংরেজি ভাষা ভালই বোঝেন এবং বলেন। মল্টিজ ভাষায় ইতালীয় ও আরবি ভাষার প্রভাব সুস্পষ্ট। এ দেশের রন্ধন প্রণালীর মধ্যেও এই দুই জায়গার প্রভাব রয়েছে। মজার তথ্য— এ দেশে বর্তমানে যত মল্টিজ থাকেন, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ রুটিরুজির টানে ভিন্‌ দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

সকালে লন্ডন থেকে প্রায় ৩ ঘণ্টা বিমানযাত্রা, তার পর বিমানবন্দর থেকে বাসে ভ্যালেটা পৌঁছতে বেলা ১টা বেজে গেল। বাস টার্মিনাস দেখে মনটা একটু দমেই গেল! অন্য ইউরোপীও দেশগুলির রাজধানী শহরের মতন ঝাঁ-চকচকে নয়। আমাদের ওখানকার মফসসল শহরের বাসস্ট্যান্ডের মতোই এই টার্মিনাসটা ছাদহীন। তবে পার্থক্য একটা আছে, কোথাও স্তূপীকৃত জঞ্জাল চোখে পড়ল না! এটাই ভ্যালেটা শহরের আকর্ষণ— আগপাশতলা সাধারণ, অথচ ঐতিহ্যপূর্ণ ঐতিহাসিক এক শহর।

শহরের একদম মাঝখানে আমাদের হোটেল। চেক-ইন করে শহরটা পায়ে হেঁটে ঘুরে বুঝলাম, এখানে গাড়ি চলার পথের চেয়ে পায়ে হাঁটা পথ বেশি। তিন দিক সমুদ্রে ঘেরা শহরটাতে প্রায় ১০-১২টা করে সমান্তরাল মেন রোড আর ক্রশ রোড— একে অপরকে জড়িয়ে নিবিড় এক জালের চেহারা দিয়েছে। ১৫৬৬-তে নাইট গ্র্যান্ডমাস্টার জ্যঁ পারিসত্‌ দ্য লা ভ্যালেতে এই ভাবেই শহরটা গড়ে তুলেছিলেন। বহিঃশত্রুর আচমকা আক্রমণের প্রভাব চট করে যাতে না পড়ে। কম-বেশি ১২ ফুট চওড়া রাস্তাগুলির দু’ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সার দিয়ে উঠেছে লাইমস্টোনের তৈরি চার-পাঁচ তলা উঁচু বাড়ি। বাড়িগুলোর কাঠ ও কাচ দিয়ে ঘেরা রঙিন সাবেকি ব্যালকনি নগর-সৌন্দর্যে একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। রাস্তার পাশে ছোট ক্যাফেতে স্থানীয়রা চা-কফি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে, চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে খবরের কাগজে। রিপাবলিক স্ট্রিট ভ্যালেটা-র তথাকথিত হাই স্ট্রিট, যার দু’ধারে বহু শো-রুম এবং দোকানপাট আছে।


ভ্যালেটা ওয়াটার ফ্রন্ট

মেডিটারেনিয়ান কনফারেন্স সেন্টারে সারা দিন ধরে বিভিন্ন সময়ে এক ঘণ্টাব্যাপী একটা তথ্যচিত্র হয়— দ্য মল্টা এক্সপেরিয়েন্স। মল্টা ভ্রমণের শুরুতে দেশটার ইতিহাস, সমাজ আর সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে গেলে তথ্যচিত্রটা দেখা জরুরি। সেন্টারটি ১৯৭৯ সালে শহরের উত্তর–পূর্ব কোণে একেবারে সমুদ্রের ধারে ভ্যালেটা পেনিনসুলাতে ষোড়শ শতকের একটি অট্টালিকাতে গড়ে তোলা হয়। এখানেই বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার পরে গর্বাচভ ও সিনিয়র বুশ-এর মধ্যে শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল। এখান থেকে ভ্যালেটা হারবার ও খাড়ির অন্য পারে ফোর্ট রিকাসোলি, ফোর্ট সেন্ট এঞ্জেলো, ফোর্ট সেন্ট মাইকেল এবং সমুদ্র তীরবর্তী অন্যান্য অট্টালিকার দৃশ্য অনবদ্য! সমুদ্রের ধার বেয়ে শহরের দক্ষিণে হারবারে যাওয়ার রাস্তাটা মেয়ের বায়নাক্কায় ঘোড়ার গাড়িতে পাড়ি দিতে হল। সেখানে ভ্যালেটা ওয়াটার ফ্রন্ট–এ জেরার্ড কামিল্লেরি আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছেন তাঁর দাইসা নিয়ে, ভ্যালেটা হারবার ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে। দাইসা হল, হাল ও বৈঠা সমেত রংবেরঙের মল্টিজ সাবেকি নৌকো (বর্তমানে নৌকাগুলি মোটরচালিত), যাতে চার-পাঁচ জন বসতে পারে। মধ্য পঞ্চাশের আমুদে, হাসিখুশি এবং নিপাট ভদ্রলোক জেরার্ড— ৭০-এর দশকে মল্টা-র জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন সদস্য। ভ্যালেটা ওয়াটার ফ্রন্ট এর পুরনো পণ্যাগারগুলোকে সংস্কার করে সার দিয়ে বিভিন্ন বার ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। পণ্যাগারগুলির দরজা ও জানলা বিভিন্ন রঙের। জেরার্ডের কাছে জানলাম, ব্যবহারিক জীবনে সেখানে মজুত থাকা পণ্যমাফিক নির্দিষ্ট রং দিয়ে পণ্যাগারগুলি চিহ্নিত হত। যেমন, মাছের পন্যাগার চিহ্নিত হত নীল রঙে। গম রাখা থাকলে হলুদ, সুরা হলে লাল, সব্জি হলে সবুজ— এই রকম। নৌকা থেকে খাড়ির এক পারে ভ্যালেটা, আর অন্য পারে সেংলি-বির্গু-কালকারা— শহরত্রয়ের চমৎকার স্থাপত্যকীর্তি অনির্বচনীয়। এই অঞ্চলেই ‘ট্রয়’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল, যাতে জেরার্ড একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। সন্ধের প্রায়ান্ধকারে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া, জলে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, কমলা-হলুদ সূর্যাস্তের আভায় খাড়ির জলে লাইমস্টোনে নির্মিত দুর্গসদৃশ অট্টালিকার প্রতিফলন আর তার সঙ্গে জেরার্ড-এর মুখে শ্যুটিং-এর সরস গল্প— সন্ধেটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল। প্রায় এক ঘণ্টা পরে আমাদের ভ্যালেটা ওয়াটার ফ্রন্ট-এ ফেরত এনে জেরার্ড যখন আমার মেয়ের হাতে বৈঠা দিলেন, মেয়ের মুখে হাসি আর ধরে না! ‘নৌকা চালাতে পেরে’ সে খুব খুশি। বিমানযাত্রার ধকল সত্ত্বেও প্রথম দিনের সার্থক পরিসমাপ্তিতে আমরা সকলেই খুশি। স্থানীয় একটা মেডিটারেনিয়ান রেস্তোঁরাতে নৈশাহার সেরে হোটেল ফেরার পথে দেখলাম, শহরটা সন্ধে সাড়ে সাতটাতেই নিঝুম হয়ে গিয়েছে। অল্প কিছু ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ ছাড়া সব দোকান বন্ধ। নাইট লাইফ-এ অভ্যস্ত পর্যটকদের কাছে ব্যাপারটা বোরিং লাগতেই পারে। জেরার্ড-এর মুখেই গল্প শুনেছিলাম যে, মধ্যবিত্ত মল্টিজরা সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত। পারিবারিক জীবনে এখনও অনুশাসনের অস্তিত্ব আছে। এখনও এখানে যৌথ পরিবার খুঁজে পাওয়া যায়!

মল্টা আর গোযো, এই দুই দ্বীপেই সাধারণ এবং পর্যটক-বান্ধব দু’ধরনের পরিবহণ পরিষেবাই ন্যায্যমূল্যে উপলব্ধ। বাস ও বিভিন্ন ধরনের বোট এখানে যোগাযোগের মাধ্যম। ট্যুরিস্ট বাসগুলি দোতলা আর ছাদ খোলা, ইংরেজিতে যাকে ওপেন-টপ বলে। মল্টাতে দু’টি পৃথক জোন-এ প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর ট্যুরিস্ট বাস চলে। ভাড়া জন প্রতি সীমাহীন যাত্রার জন্য কুড়ি ইউরোর মতো। গোযো যেতে গেলে প্রথমে ভ্যালেটা থেকে মল্টা-র উত্তর-পশ্চিম কোণে তিরিশ কিলোমিটার দূরে সাধারণ বাস ধরে কিরকাওয়া শহরে যেতে হয়। সেখানকার ফেরি টার্মিনাল থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গোযো চ্যানেলের অন্য প্রান্তে গোযো দ্বীপের মার শহর পর্যন্ত যায় বোট। বোটগুলি বিশালায়তনের, যার পেটের ভেতর গাড়ি, ট্রাক— সব ঢুকে যেতে পারে। যাত্রীদের ডেক ও কেবিনে বসার এবং চটজলদি খাদ্য-পানীয়ের ভাল বন্দোবস্ত আছে। মার শহরের ফেরি টার্মিনাল থেকে গোযো ভ্রমণের জন্য ওপেন-টপ ট্যুরিস্ট বাস পাওয়া যায়।


মোস্টা-র গির্জা

মল্টা-র স্থাপত্যকীর্তির কথা অসমাপ্ত থেকে যাবে, যদি না মডিনা নগর ও সন্নিহিত রাবাট শহরতলির কথা না বলা হয়! ভ্যালেটা-র পশ্চিমে মল্টা-র প্রায় কেন্দ্রস্থলে একটু উঁচুতে মডিনা নামের এই সুপ্রাচীন প্রাকারবেষ্টিত নগরটি খুব সম্ভব ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিনিশিয়রা গড়ে তোলে। পাহাড়ের উপরে আর সমুদ্র থেকে দূরে বলে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের শাসকদের কাছে এটি কৌশলগত কারণে রাজধানী হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। সময়ে সময়ে বিভিন্ন শাসকেরা নিজস্ব শৈলীতে এখানে অট্টালিকা ও দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। এখানকার প্রাচীনতম অট্টালিকা নরম্যান হাউস, যা নরম্যানরা একাদশ শতাব্দীতে বানিয়েছিলেন। রাবাট আসলে মডিনা সংলগ্ন একটি মধ্যযুগীয় বাণিজ্য শহর, যা সেই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল। আরবি ভাষায় রাবাট কথার অর্থ শহরতলি।

মডিনাতে বাস থেকে নামার পরেই দেখলাম, ভারতের ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রগুলির মতো সার দিয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘোড়ারগাড়িতে চালকের তাজা ধারাবিবরণী-সহ মডিনা ও রাবাট দর্শনের দক্ষিণা চল্লিশ ইউরো প্রতি ঘণ্টা। আমাদের ভাড়া করা গাড়িটি যে একটা মধ্যযুগীয় নগরীতে ঢুকল, সেটা বুঝলাম যখন ঘোড়ার খুরে পাথুরে রাস্তায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের টাক টুক আওয়াজ সংকীর্ণ গলি আর উঁচু অট্টালিকার দেওয়ালে আরও গম্ভীর হয়ে কানে ধরা দিল। দেওয়াল থেকে কাচের ঝুলন্ত বাতিদান, খোদাই করা বিশাল কাঠের দরজা, ছোট ছোট রঙিন কাচের জানলা, প্রাকার, অট্টালিকা, গির্জা— সব কিছুই প্রাচীন গৌরবান্বিত ইতিহাসের পরিচয় দেয়। গাড়ির চালক আমাদের যে দ্রষ্টব্যগুলি দেখালেন, তার মধ্যে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, ডোমাস রোমানা মিউজিয়াম আর মডিনা গেট স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য।

মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের পাশাপাশি মল্টাতে প্রাগৈতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শনও রয়েছে। মল্টা দ্বীপের দক্ষিণে সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের উপরে দু’টি প্রাগৈতিহাসিক মেগালিথিক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে, হাজার কিম ও মিঁয়াদ্রা। ৩৫০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মল্টাতে উপলব্ধ সবথেকে প্রাচীন গ্লোবিজেরিনা ও কোরালিন লাইমস্টোন প্রস্তর দিয়ে নির্মিত মন্দির দু’টিতে প্রার্থনাগৃহ, গুদামঘর, বসবাসের উপযুক্ত ঘর, প্রতিরোধকারী প্রাকার ইত্যাদির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। পাওয়া গিয়েছে সমুদ্র তীরবর্তী উচ্চতর পর্বত থেকে জল সরবরাহের নিদর্শনও। এটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর তালিকার অন্তর্ভুক্ত। মন্দিরে প্রবেশের আগে একটি প্রদর্শনী ও সংগ্রহশালা থেকে মন্দির সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ইতিহাসে অনুৎসাহী পর্যটকেরা এই মন্দির দু’টি থেকে সমুদ্র ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।

এখানে কিছু প্রাকৃতিক শৈলীর নিদর্শনও বেশ আকর্ষনীয়। সবার আগে গোযো দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে ডিয়েরা-তে দেখা আজুরে উইনডো-র কথা বলতে হয়। এখানে সমুদ্রতট পাহাড়ি ও পাথুরে, আর সমুদ্র এখানে পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে দিয়ে স্থলভাগের মধ্যে ঢুকে এসেছে। প্রকৃতির খেয়ালে সমুদ্র এখানে পাহাড়কে ক্ষয় করে একটি বিশাল জানলা তৈরি করেছে, যার ভেতর দিয়ে নীল আকাশ আর সমুদ্র দৃশ্যমান। মল্টা দ্বীপের দক্ষিণ অংশে ব্লু গ্রত্তো বলে ধীবরদের ছোট গ্রামে সমুদ্রবক্ষে একটি গুহা আছে। এই গুহাটিতে নৌকা করে যাওয়া গেলেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে দিন সমুদ্র অস্থির থাকায় আমরা সেখানে যেতে পারিনি। তবে দু’একটি ধীবরদের গ্রাম দেখেছিলাম, যার মধ্যে মল্টা-র দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে অবস্থিত মারসালক-এর উল্লেখ করতেই হবে। খাড়ির নীল জলে নোঙর করে রাখা নানা রঙের অজস্র মাছ ধরার নৌকো (যা মল্টিজ ভাষায় লুজ্জু নামে পরিচিত) ফোটোগ্রাফারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। খাড়ির বাঁধানো পাড়ে দোকানিদের অস্থায়ী শিবিরে চোখে পড়বে হরেক পসরা— খাবার জিনিস থেকে ঘর সাজাবার শৌখিন দ্রব্য। শহরের বড় দোকানের থেকে এখানে অনেক জিনিস বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। মডিনা গ্লাস ফ্যাক্টারি থেকে শপিং করা যেতে পারে। এক ছাদের তলায় গ্লাস আর্ট ও পেন্টিং-এর এমন অনবদ্য সমাবেশ পৃথিবীর আর কোনও প্রান্তে আছে কিনা সন্দেহ! তাকালি কারুশিল্প থেকে গ্লাস-ব্লোয়িং— কী অসম্ভব নৈপুণ্য বলে বোঝানো যায় না।

মল্টা-র চার্চগুলিও অসামান্য। দেশের প্রায় মাঝখানে মোস্টা শহরে ১৮৬০ সালে ২৭ বছর ধরে নির্মিত ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম গম্বুজ গির্জাটি তার স্থাপত্যশৈলী ও অভ্যন্তরীণ শিল্পকীর্তির জন্যে বিখ্যাত। এই চার্চটি অলৌকিক ভাবে নাজি বাহিনীর বোমাবর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল— বোমা চার্চ-এর গম্বুজ ছুঁলেও অজ্ঞাত কারণে বিস্ফোরণ হয়নি। গোযো দ্বীপে তাপিনু ব্যাসিলিকার গড়ন বেশ রাজসিক। এই চার্চের খ্যাতি মা মেরি-র জাগ্রত অধিষ্ঠানের জন্য।

ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির অন্যতম আকর্ষণ এর সমুদ্রসৈকত। বেশ কিছু বেলাভূমি দেখলেও, সব থেকে ভাল লেগেছিল, গোযো দ্বীপের রামলা বে-র বেলাভূমি। সমুদ্রের নীল জলের পাশে কমলা-লাল সৈকত উল্লসিত করে তোলে। এই বেলাভূমির পাশেই ক্যালিপ্সো গুহা। গুহাটি খুব চিত্তাকর্ষক না হলেও এখান থেকে রামলা বে-কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে উপভোগ করা যায়।

ভ্যালেটাতে থাকলে গোযো যাতায়াতে অনেকটা সময় খরচা হবে বটে, কিন্তু, সেই অভিজ্ঞতা সর্বার্থে অমূল্য! আমরা যে দিন গোযো গিয়েছিলাম, সে দিন আকাশ সম্পূর্ণ মেঘহীন— তাই সূর্যাস্তের সময় গোযো চ্যানেলের সৌন্দর্য চেটেপুটে খেয়েও আশা মেটেনি! মল্টা থেকে ছোট হলেও এই দ্বীপের গ্রামগুলি সম্পন্ন ও সুন্দর। গোযো না গেলে আমরা জানতেই পারতাম না, ইউরোপে এ রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটা দ্বীপ ভূমধ্যসাগরের এক কোণে লুকিয়ে আছে! শিল্প, ইতিহাস, স্থাপত্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ রকম সহাবস্থান বড় একটা চোখে পড়ে না!

কথায় বলে, ছুটি আর মাইনে, সব সময় খুব কম মনে হয়। সেই নিয়মে আমাদের মল্টা সফরের দিনও শেষ হয়ে গেল।

পরের দিকে ব্যারাকপুর চলে আসলেও আদতে উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচড়াপাড়ায় বড় হওয়া। বোম্বে আইআইটি-র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং–এ স্নাতকোত্তর। তার পর টিসিএস-এ চাকরি। বর্তমানে কর্মসূত্রে লন্ডন-এর বাসিন্দা। ছুটিতে বিভিন্ন দেশ চুটিয়ে ঘোরা ছাড়াও ফটোগ্রাফি, শৌখিন রান্নাবান্না আর বিভিন্ন লোকসঙ্গীত শোনায় উৎসাহী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE