Advertisement
১৯ মে ২০২৪
আয়লার পর ছ’বছর পার

মাথা গোঁজার সরকারি সাহায্য এখনও মেলেনি অনেক দুর্গতের

ছ’বছর আগে এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় নামখানা গ্রাম পঞ্চায়েতের মুড়িগঙ্গা লাগোয়া উত্তর নারায়ণগঞ্জের প্রান্তিক মৎস্যজীবী প্রফুল্ল বেরা আর তার স্ত্রী কাজলের সব কেড়ে নিয়েছিল। গ্রামে ধেয়ে এসেছিল মারণ-ঢেউ। সেই স্মৃতি তাঁদের বুধবারেও টাটকা। এ দিনই (২৫ মে) যে থাবা বসিয়েছিল সেই দুর্যোগ।

ভাঙনের আশঙ্কায় উত্তর নারায়ণগঞ্জের নদীবাঁধ। নিজস্ব চিত্র।

ভাঙনের আশঙ্কায় উত্তর নারায়ণগঞ্জের নদীবাঁধ। নিজস্ব চিত্র।

শান্তশ্রী মজুমদার ও নির্মল বসু
নামখানা ও বসিরহাট শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

এখন আর কিছু হারানোর ভয় করেন না প্রফুল্ল বেরা।

ছ’বছর আগে এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় নামখানা গ্রাম পঞ্চায়েতের মুড়িগঙ্গা লাগোয়া উত্তর নারায়ণগঞ্জের প্রান্তিক মৎস্যজীবী প্রফুল্ল বেরা আর তার স্ত্রী কাজলের সব কেড়ে নিয়েছিল। গ্রামে ধেয়ে এসেছিল মারণ-ঢেউ। সেই স্মৃতি তাঁদের বুধবারেও টাটকা। এ দিনই (২৫ মে) যে থাবা বসিয়েছিল সেই দুর্যোগ।

শুধু নামখানাই নয়, দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন ও লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল বহু বাড়ি। ভেসে গিয়েছিল জমি-পুকুর, খাল-বিল। মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের। তার পরে সুন্দরবনের নদীবাঁধগুলো কংক্রিটের করার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু সেই কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়ে উঠল কই? সাত বছরে আয়লা-দুর্গতদেরও সকলের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি সাহায্যের বাড়ি। নিজেদের উদ্যোগেই কোনও রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়ে দিন গুজরান করছেন তাঁরা।

যেমন প্রফুল্লবাবু। স্ত্রীকে নিয়ে ডিঙিতে মাছ-কাঁকড়া ধরে তাঁর সংসার চলে। পুরনো বাঁধ লাগোয়া এলাকায় ৫ বিঘে জমি নিয়ে তার পরিবার ছিল মোটামুটি সচ্ছল। কিন্তু আয়লার থাবার তাঁদের সর্বস্ব গিয়েছে। এখনও ফি-বছর বর্ষার মরসুমে আতঙ্কে ভোগেন। বাঁধ ভেঙে জল ঢোকার আতঙ্ক। কারণ, বাঁধ বেহাল। প্রফুল্লর কথায়, ‘‘আমাদের একটা ত্রিপলও দেওয়া হয়নি। অন্য কয়েকটি পরিবার ত্রিপল পেয়েছে। তবে এখন আর হারানোর ভয় পাই না। পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছি। একফালি জমি কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়েছি।’’

প্রফুল্লর মতো দিনমজুর লালমোহন মাইতি, মৎস্যজীবী প্রভাত বর, দিনমজুর কানাই বেরাদের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না একটু ভাল জায়গায় জমি কিনে বাড়ি করে সরে যাওয়ার। গ্রামের অনেকেই যা করেছেন। মাটিতে লবণের দাপট কমে যাওয়ায় এতদিনে শুধু আমন ধানের চাষ শুরু হয়েছে। নামখানা পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ওই গ্রামের এ রকম ১৯টি পরিবারকে জমি কিনে পুনর্বাসন দেওয়া হবে। কিন্তু এই ক’বছরে বছরে তাঁরা কোনও প্রকল্পেই বাড়ি পাননি। তবে আয়লার জন্য দু’টাকা কেজি দরে চাল পাচ্ছেন। সরকারি সাহায্য বলতে এটুকুই। অথচ, নামখানার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলির মধ্যে এটা ছিল প্রথম সারিতে।

কিন্তু কেন সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পেলেন না ওই আয়লা দুর্গতেরা? নামখানার বিডিও অমৃতা বর্মন রায় বলেন, ‘‘ও ভাবে তো বলা সম্ভব নয়। অনেকগুলি বিষয় দেখে এগুলি ঠিক হয়। তাই খতিয়ে দেখে বলতে হবে।’’

তবে, সাগরের সিপিএম নেতা মিলন পড়ুয়ার অভিযোগ, দুর্গতদের মধ্যে যাঁরা শাসক দলের কাছাকাছি ছিলেন বা সরাসরি শাসক দলে নাম লিখিয়েছিলেন তাঁরাই সরকারি আনুকুল্য পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘‘সাগর ব্লকের ৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রায় ১ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তার মধ্যে বেশ কিছু মানুষ কিছুই পেলেন না। বেশ কিছু মানুষ অল্প পেলেন। যাঁদের পাওয়ার কথা ছিল না, তাঁরাই বাড়ি বানিয়ে ফেললেন।’’একই রকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাথরপ্রতিমার জি প্লট, ব্রজবল্লভপুর-সহ একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত। ক’জন পেয়েছেন ঘর? এলাকাবাসীর ক্ষোভ, প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনও সরকারি প্রকল্পে ঘর পাননি। আলাদা কোনও প্রকল্পও আসেনি।

জেলা প্রশাসনের দাবি, সেচ দফতরের তরফে বাঁধ তৈরির কাজ চলছে। বিভিন্ন জায়গায় মেরামতির কাজ হয়েছে। গীতাঞ্জলি, নিজভূমি নিজগৃহ, ইন্দিরা আবাস যোজনার মতো বেশ কিছু প্রকল্পে আয়লা বিধ্বস্ত মানুষের মাথার উপর ছাদেরও সংস্থান করা হয়েছে নানা সময় শুনানি করে। তবে, একই সঙ্গে ওই কর্তারা মেনে নিয়েছেন, বেশ কিছু জায়গায় তা হয়নি। কাগজপত্রের সমস্যা ছিল। নিজের জায়গা ছিল না। কারণ যাই থাকুক না কেন, এখনও তা হয়ে ওঠেনি।

সুন্দরবন লাগোয়া সামশেরনগরের রতন সর্দার, কালিপদ মণ্ডল, রত্না গিরিরা এখনও বাস করেন জঙ্গল লাগোয়া কুঁড়েখালি নদীর ধারের ঝুপড়িতে। তাঁদের কথায়, ‘‘বাঘের ভয় উপেক্ষা করে এখানে থাকতে বাধ্য হই। আয়লাতে সর্বস্ব হারানোর পরও কিছুই পেলাম না। তাই ঝুপড়িতে দিন কাটাই। সম্বল শুধু দু’টাকা কেজির চাল।’’ বুধবারের বিকেল থেকে ঝড়বৃষ্টি ফের আয়লার স্মৃতি আরও একবার উসকে দিয়েছে তাঁদের মনে।

এত দিনেও বসিরহাট মহকুমায় সুন্দরবন লাগোয়া এলাকায় মাত্র ১১ কিলোমিটারের বেশি আয়লা বাঁধের কাজ শুরু করাই সম্ভব হয়নি। সেচ দফতরের বসিরহাট মহকুমা নির্বাহী বাস্তুকার নিরঞ্জন কুমার সিংহ বলেন, ‘‘মহকুমা সেচ দফতরের অধীনে ৮৫০ কিলোমিটার নদীবাঁধ আছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১১ কিলোমিটার আয়লা বাঁধের কাজ শেষের পথে। আরও ১১ কিলোমিটার আয়লা বাঁধের কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।’’

সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সুন্দরবন এলাকায় আপাতত ২৭টি জায়গাতে মোট ২১ হাজার ৬১২ মিটার কংক্রিটের বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে সন্দেশখালির বেড়মজুর এবং হাসনাবাদের আবাদ শুলকুনি ও চকপাটলির ১৫৮ মিটারের কাজ কাজ শেষ হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

erosion government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE