তৃণমূল নেতা বলেই ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের হাতে বারবার আক্রান্ত হয়েও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশএমনই অভিযোগ করছেন বিরোধীরা। আবার একাধিক বার পুলিশকে নিশানা করেও আরাবুল কার্যত বহাল তবিয়তে থাকায় প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেও।
শুক্রবার সকালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাশীপুর থানার সাতুলিয়া এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ সামাদ মোল্লা ও সামসুদ্দিন মোলা নামে আরাবুলের দুই ছায়াসঙ্গীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ওই দু’জনের আটক হওয়ার খবর পেয়ে থানার বাইরে হাজির হন ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুল ইসলাম। ওসি সূর্যশেখর মণ্ডল তখন থানায় ছিলেন না। সদর দরজা ঝাঁকিয়ে ওসির নাম ধরে চিৎকার করতে শোনা যায় আরাবুলকে। সঙ্গে তাঁর ছেলে হাকিমুলও ছিলেন।
সামাদ এবং সামসুদ্দিনকে শনিবার ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শুক্রবার অবশ্য ওই দু’জনের গ্রেফতার হওয়ার খবর পাওয়ার আগেই থানার দরজা ছেড়ে প্রায় শ’পাঁচেক অনুগামীকে নিয়ে সাতুলিয়া মেন রোডে অবরোধ করেন আরাবুল। দোকানে, গাড়িতে ভাঙচুর এবং পথচলতি কয়েকজনকে মারধর, বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে
তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে।
তবে এই ঘটনায় শনিবার রাত পর্যন্ত এফআইআর করেনি পুলিশ। হয়েছে সাধারণ ডায়েরি (জিডি)।
পুলিশ সূত্রের দাবি, ২০১২ সালেও কাশীপুর থানায় তাঁর এক সঙ্গীকে তুলে আনা হয়েছে বলে এক সাব-ইনস্পেক্টরের উপরে চড়াও হন আরাবুল। থানার ভিতরেই ওই পুলিশ অফিসারকে ধাক্কা মারেন তিনি। সে বারেও জিডি-ই হয়েছিল।
কেন? জেলার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেননি। এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সি কে মুরলীধরণ রাতে বলেন, “দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারের অফিস থেকে গতকালের ঘটনার ব্যাপারে এখনও রিপোর্ট পাইনি। খোঁজ নিয়ে দেখছি।” তবে জেলা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, “আগের বার সংশ্লিষ্ট অফিসার অভিযোগ করেননি। এ বার আরাবুল থানার ভিতরে ঢোকেননি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে থানায় হামলার মামলা করার অবকাশ নেই। অবরোধ, মারধর বা বোমাবাজি নিয়েও অভিযোগ জমা পড়েনি।”
কিন্তু পুলিশ তো নিজে মামলা করতে পারত? ওই কর্তার দাবি, মামলার জন্য যে প্রমাণ লাগবে, প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, তা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০০৬-এ কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার তৎকালীন ওসি প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়কে মারধরের অভিযোগ ওঠে আরাবুলের বিরুদ্ধে। তখন তাঁর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করে পুলিশ। সেই মামলা এখনও চলছে।
তবে আরাবুলকে নিয়ে পুলিশের ‘প্রতিক্রিয়া’য় ক্ষুব্ধ সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী। তাঁর মন্তব্য, “দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রশ্রয় রয়েছে। তাই আরাবুলের মতো নেতারা বারবার পুলিশকে নিশানা করার সাহস পাচ্ছেন।” বিজেপি-র অন্যতম রাজ্য সম্পাদক শমীক ভট্টাচার্যের টিপ্পনী, “রাজ্যে এখন শাসক দল-পুলিশ-প্রশাসন মিলেমিশে একাকার। ভাঙড়ের ঘটনাটা তাই পারিবারিক কোন্দল! সে জন্যই আইনি পদক্ষেপ করছে না পুলিশ।”
তবে তৃণমূল-অন্দরের খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে দলের একাধিক নেতা মেনেছেন, বছর দেড়েক আগে কলকাতার হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র নির্বাচনের দিন কলকাতা পুলিশের অফিসার তাপস চৌধুরী হত্যায় দলের নেতা মুন্না ইকবাল গ্রেফতার হওয়ায় রাজ্যবাসীর কাছে ‘ভুল বার্তা’ গিয়েছিল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল পুলিশকে বোমা মারার ‘পরামর্শ’ দেওয়ায় এবং সেই জেলারই দুবরাজপুরে সাব-ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তীকে বোমা মারায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে তৃণমূল নেতা শেখ আলিমের (এখনও অধরা) নাম জড়ানোয় দল অস্বস্তিতে পড়েছে। তাই আরাবুল বার বার পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছেন কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে দলের ভিতরে।
তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের একাংশও মানছেন, ভাঙড় কলেজ শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারা, সিপিএমের মিছিলে হামলা করার অভিযোগ তো ছিলই, লোকসভা ভোটের পর থেকে আরাবুল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আরাবুল-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, “যাঁর জন্য যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ভাঙড়ে দল ৬০ হাজার ভোটের লিড পেয়েছে, তাঁর দিকে কে কী নিয়ে আঙুল তুলছে, তাতে কিছু এসে-যায় না।”
আরাবুল দাবি করেন, শুক্রবার তিনি অশান্তিতে জড়াননি। বলেছেন, “আমার অনুগামীরা উত্তেজনার বশে যখন থানার বাইরে বিক্ষোভ করছে তখন শোভনদা (জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়) ফোন করেছিলেন। অন্য নেতারাও ফোন করেন। ওঁরা ব্যাপারটা দেখার আশ্বাস দেওয়ায় এলাকা ছেড়ে চলে যাই।”
আরাবুলের এই কাণ্ড কী ভাবে দেখছেন দলের নেতারা? শোভন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “কী ঘটেছে, খতিয়ে দেখব।” আরাবুল যাঁকে ‘গুরু’ বলে মানেন সেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমার সঙ্গে আরাবুলের কথা হয়নি। ও কেন এমন করল, দেখতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy