Advertisement
০৬ মে ২০২৪

বিজ্ঞান বিষয়ে ভীতি কাটাতে বিশেষ কোর্স সাগরের স্কুলে

মাধ্যমিকে ভাল ফল করায় বাড়ির লোেকর চাপে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল মোনালিসা দাস। সিলেবাসের বোঝা টানতে না পারায় মাস ছয়েক পড়ে পড়া ছেড়ে দেয় সে। পরের বছর কলা বিভাগে ভর্তি হয়ে এখন সে কলেজ পড়ুয়া।

চলছে প্রি-ইলেভেন কোর্সের ক্লাস।— নিজস্ব চিত্র।

চলছে প্রি-ইলেভেন কোর্সের ক্লাস।— নিজস্ব চিত্র।

শিবনাথ মাইতি
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫৪
Share: Save:

মাধ্যমিকে ভাল ফল করায় বাড়ির লোেকর চাপে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল মোনালিসা দাস। সিলেবাসের বোঝা টানতে না পারায় মাস ছয়েক পড়ে পড়া ছেড়ে দেয় সে। পরের বছর কলা বিভাগে ভর্তি হয়ে এখন সে কলেজ পড়ুয়া।

একই ভাবে ফাঁপরে পড়ে সুব্রত খাঁড়া। মাধ্যমিকে খুব ভাল ফল করায় উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। অচিরেই বোঝে, বিজ্ঞান তার বিষয় নয়। পাশ করলেও ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। যা নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই তার।

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরনোর পর বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর মনেই প্রশ্ন, সায়েন্স না আর্টস? বহু ছাত্রছাত্রী বিজ্ঞানে দুর্বল হলেও পরিবারের চাপে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। আবার অনেকের বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছে থাকলেও, কতটা কঠিন, কিংবা বিপুল হবে বিজ্ঞানের পাঠক্রম তা আন্দাজ করতে না পেরে মানববিদ্যা নিয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্ব কাটাতে ‘প্রি-ইলেভেন কোর্স’ চালু করল সাগরের খানসাহেব আবাদ উচ্চবিদ্যালয়।মাধ্যমিক পরীক্ষা ও ফল বেরোনোর মাঝের সময় কাজে লাগিয়ে চলে তিন মাসের ওই কোর্স।

কী রয়েছে ওই কোর্সে?

স্কুল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসের বইয়ের নির্বাচিত অংশ ওই কোর্সে পড়ানো হয়। যদি দেখা যায় কোনও পড়ুয়া ভাল ভাবে তা নিতে পারছে, তখন তাকে বিজ্ঞান পড়ায় উত্‌সাহ দেওয়া হয়। কোনও বিষয়ে দুর্বল হলে তাকে বিশেষ সহায়তা করা হচ্ছে। যাতে সে গণিত, ভৌতবিজ্ঞান বা রসায়নে ভয় কাটিয়ে বিজ্ঞান পড়ার সাহস পায়। সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত ওই কোর্স পড়ানো হয়। স্কুলের শিক্ষকরাই ওই কোর্স পড়ান। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়দেব দাস জানান, প্রথম বছর যখন কোর্স চালু হয় তখন পড়ুয়া সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০। এখন সেই সংখ্যাটা এখন একশো ছুঁইছুঁই। সব স্কুলের ছেলেমেয়েরাই ওই কোর্স পড়তে আসছে। জয়দেববাবু বলেন, ‘‘কোর্স করতে গেলে পড়ুয়ার বইপত্র কিনতে হয় না। আমরাই স্টাডি মেটেরিয়াল দিই। এ জন্য মাথা পিছু ১০০ টাকা। কোর্স ফি ওইটুকুই।’’

তিনি জানান, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ গরিব। কোনও পড়ুয়া বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে চাইলে তার বানির লোকেরা অনেক সময়ে ধার দেনা করে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে বইপত্র কিনে দেন। কিন্তু তাদের অনেকেই মাঝপথে গিয়ে বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিতে চায়। কেউ চালিয়ে গেলে ভাল ফল করতে পারে না। কোর্সটি করলে পড়ুয়ারা আন্দাজ করতে পারে, তারা বিজ্ঞান পড়তে উত্‌সাহী কি না। শিক্ষকরাও তা বুঝে, সেই মতো অভিভাবককে ডেকে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “অনেকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে চাইলেও কোনও একটি বিষয়ে দুর্বল হওয়ার জন্য পড়তে সাহস পাচ্ছে না। সেই বিষয়ে দুর্বলতা কাটিয়ে তাদেরকেও আমরা সাহস জোগানোর কাজটাও করি।” তাঁর দাবি, ওই স্কুলের দেখাদেখি সাগরের আরও দু’একটি স্কুলে ওই একই কোর্স চালু হয়েছে। তাঁর আর্জি, “সব স্কুলেই এই ধরনের কোর্স চালু হোক। তাহলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ছাত্রছাত্রীরা উত্‌সাহ পাবে।”

কোর্স পড়তে আসা কৌস্তভকান্তি দাস বলে, “উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়তে চাই। কিন্তু সিলেবাস সম্বন্ধে কিছুই তো জানি না। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাড়িতে বসে না থেকে এখানে এসেছি। ভাল স্কুলে ভর্তি হতেও এই কোর্সটা খুব সাহায্য করবে বলে মনে হয়।” আরও এক পড়ুয়া সুমন গোল বলে, “শুনেছি উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস খুবই কঠিন। তাই সিলেবাস কেমন তা জানতে, ও পড়া এগিয়ে রাখতে ভর্তি হয়েছি।” ওই স্কুলেরই ছাত্রী সূর্যশিখা মণ্ডল বলে, “মাধ্যমিকের পর পড়াশোনার কোনও সম্পর্ক ছিল না বললে চলে। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে গেলে এই সময়টা কাজে আসতে পেরে ভেবে এখানে ভর্তি হয়েছি।”

কলা বিভাগে যারা পড়াশোনা করতে চায়, তাদের জন্যও ওই একই কোর্স চালু করা হয়েছে। তাতে অনেকে পড়ার কাজ এগিয়ে রাখতে ওই কোর্সে ভর্তি হয়েছে। কোর্সের ছাত্র অনুপম দাস জানায়, “আর্টসের বিষয়গুলি কোনটা কেমন, তা জানতে এই কোর্সে ভর্তি হয়েছি।” ২০১৩ সালে ওই কোর্সে ভর্তি হয়েছিল বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র অনুদীপ সরদার। তার অভিজ্ঞতায়, “সিলেবাস সম্বন্ধে তেমন কোনও ধারণা ছিল না। ওই কোর্স করায় প্রাথমিক ধারণা গড়ে উঠেছিল। যেটা পরে খুব কাজে এসেছিল।”

আর কী বলছেন অভিভাবকরা ?

পেশায় চিকিৎসক প্রভাস নন্দ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘মেয়েকে এই কোর্সে ভর্তি করেছি কারণ সিলেবাস যেমন কিছুটা এগিয়ে থাকবে তেমনি কোনও বিষয়ে দুর্বল হলে সেই বিষয়টা বাদে অন্য কোনও বিষয় নেওয়ারও সুযোগ থাকবে।’’ এক অভিভাবক পেশায় গৃহশিক্ষক অশেষকুমার জানান বলেন, ‘‘গত বছর আমার মেয়েকে ওই কোর্সে ভর্তি করেছিলাম। এতে তার যেমন সিলেবাস সম্বন্ধে যেমন স্বচ্ছ ধারণা হয়েছে, তেমনি বিষয় নির্বাচনে কোনও অসুবিধা হয়নি।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) মৃন্ময় ঘোষ বলেন, ‘‘ব্যাপারটি সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলের পড়ুয়ার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধিতে এ ধরনের উদ্যোগ খুবই দরকার।’’

(কিছু পড়ুয়ার নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE