এমন অনুরোধ ফেলেন কী করে, শেষমেশ থেকেই গেলেন স্যার। নিজস্ব চিত্র।
বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, দেগঙ্গার পরে ফের একই ঘটনা বাদুড়িয়ার স্কুলে। ছাত্রছাত্রীদের আবদার মেনে বদলির সিদ্ধান্ত বদলালেন প্রধান শিক্ষক।
বাদুড়িয়া ব্লকের পিয়াড়া-তেঘরিয়া হাইস্কুলটি সাহেস্থানগর ২ পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। ১৯৬৪ সালে দরমার বেড়ার উপরে টালির চালের ঘরে ১১০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ক্লাস শুরু হয়েছিল। তারপর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। বর্তমানে তিনতলা স্কুলবাড়িতে হাজারখানেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে।
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপম দে। গোবরডাঙা থেকে যাতায়াত করেন তিনি। বাড়ির কাছে চাঁদপাড়ার একটি স্কুলে সুযোগ পাওয়ায় বুধবার তাঁর ওই স্কুলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। মঙ্গলবার স্কুলে এসেছিলেন পরিচালন কমিটির কাছ থেকে ‘রিলিজ অর্ডার’ নিতে।
এ দিকে, কথাটা পাঁচকান হতেই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে ছাত্রছাত্রীরা। প্রধান শিক্ষকের যাওয়া আটকাতে একদল ছেলেমেয়ে পোস্টার হাতে স্কুলগেটে তালা ঝুলিয়ে শুরু করে বিক্ষোভ। অন্যেরা প্রধান শিক্ষকের ঘরে গিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে ‘মাস্টার মশাই আমাদের ছেড়ে যাবেন না’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়।
কান্নাকাটি, চিৎকার, বিক্ষোভ, অনুরোধ— এক কথায় হুলস্থূল কাণ্ড। প্রায় দেড় ঘণ্টা চলে এই পরিস্থিতি। শেষমেশ ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় মাস্টারমশাইয়ের। তিনি বলেন, ‘‘তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাব না।’’ এতক্ষণে শান্ত হয় ছেলেমেয়ের দল।
প্রধান শিক্ষক চলে যাচ্ছেন শুনে স্কুলে চলে এসেছিলেন বহু অভিভাবকও। তাঁরাও স্যারকে যেতে দিতে নারাজ। কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় কয়েকজন অভিভাবিকা এবং ছাত্রছাত্রীকে। এ সব দেখে রীতিমত হতবাক অনুপমবাবু।
কিন্তু এত মানুষের ভালবাসা কী ভাবে অর্জন করলেন তিনি?
স্কুলের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘অনুপমবাবু এমনিতে কড়া ধাতের মানুষ হলে কী হবে, ছাত্রছাত্রী-সহকর্মী এবং গ্রামের মানুষের সঙ্গে সব সময়ে ভাল ব্যবহার করেন। ঠিক সময়ে স্কুলে আসেন। পড়াশোনার বিষয়ে কোনও আপোষ করেন না। এ সবের ফলে স্কুলে পঠন-পাঠনের অনেক উন্নতি হয়েছে।’’ স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক বিকাশ মজুমদারের কথায়, ‘‘স্কুল বাড়ি উন্নয়নের পাশাপাশি স্যারের চেষ্টায় গানের ক্লাস, লাইব্রেরি, কম্পিউটার, খেলাধূলার সরঞ্জাম এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে। পড়াশোনায় উন্নতি হওয়ায় গ্রামেরও সুনাম বেড়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এমন কাজের মানুষকে আমাদের পক্ষে কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।’’
রিয়াজুল মোল্লা, মৌমিতা মল্লিক, সাইফুদ্দিন মোল্লা, রিয়া সরকারের মতো ছাত্রছাত্রীদের কথায়, ‘‘হেডমাস্টার মশাই আমাদের ভূগোলের ক্লাস নেন। একবার বুঝতে না পারলে বার বার বুঝিয়ে দেন। পড়া না পারলে যেমন বকাঝকা করেন, তেমন পড়া করলে কাছে ডেকে নিয়ে আদরও করেন, ভালবাসেন। ভাল করে পড়াশোনা করার জন্য উৎসাহ দেন।’’
সব দেখেশুনে কী বলছেন অভিভূত অনুপমবাবু?
তাঁর কথায়, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের শাসন করি। ঠিক সময়ে স্কুলে না এলে বকাবকিও করি। তা সত্ত্বেও ওরা যে আমাকে এতটা ভালবাসে, তা আগে জানলে তো অন্যত্র যাওয়ার আবেদনই করতাম না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy