বৃষ্টির জল ধরে চাষের কাজে লাগাতে খাল সংস্কার করার কথা ছিল। বন দফতর খাতায় কলমে দেখিয়েছে, খাল সংস্কার হয়ে গিয়েছে। একশো দিনের কাজে টাকাও ঢুকেছে অনেকের অ্যাকাউন্টে। কিন্তু এখন তারাই দাবি করছেন, তারা কাজ না করেই টাকা পেয়েছেন। তাই কাজ না হওয়া এবং ভুয়ো অ্যাকাউন্ট দেখিয়ে টাকা তোলার অভিযোগ ওঠার পরে শো-কজও করা হয়েছে এলাকার এক তৃণমূল নেতাকে। নামখানায় এ রকম প্রকল্পে সরকারি অর্থ অপচয় নিয়ে শুরু হয়েছে তদন্ত। যদিও বনকর্তাদের দাবি, যেখানে কাজ হওয়ার কথা ছিল, তা থেকে দূরে কাজ হয়েছে। সেই তথ্য আর আপলোড করা হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারি ওয়েবসাইটে।
নামখানায় ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে ফ্রেজারগঞ্জ পঞ্চায়েতে ভেড়ুয়ার খালে ১ কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ হওয়ার কথা ছিল। প্রায় ১২ লক্ষ টাকার ওই প্রকল্পে যে এলাকায় কাজ হওয়ার কথা, একশো দিনের মাস্টার রোলে একশো দিনের কাজের সাইটে আপলোড করা হয়েছে, সেই এলাকায় আদৌ কাজ হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছে শাসকদলেরই একটি অংশ। বিডিও অফিসে তারা অভিযোগও দায়ের করেছে।
ঘটনাটি কয়েক মাস পুরনো হলেও সামনে এসেছে সবে। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, খালের অবস্থা খুবই খারাপ। বিভিন্ন জায়গায় আগাছা, পলি জমে মজে গিয়েছে। কাজ শুরু হওয়ার আগে এবং পরে প্রকল্পের ছবি দিতে হয়। তা-ও দেওয়া হয়নি।
পুরো ঘটনায় বন দফতর এবং স্থানীয় বন সুরক্ষা কমিটির সদস্য তথা তৃণমূলের শিবপুর জোন সভাপতি দিব্যেন্দু মণ্ডলের বিরুদ্ধে টাকা তছরুপের অভিযোগ তুলেছেন দলের স্থানীয় নেতা মিলন মণ্ডল, সুশান্ত মণ্ডলরা। তাঁদের কথায়, ‘‘কাজ আদৌ হয়নি। ভুয়ো জবকার্ডধারীদের ডেকে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়ে সেগুলি আবার তাদের দিয়েই তুলিয়ে নিয়েছেন দলের নেতারা।’’ তাঁদের দাবি, একটি রাস্তা এবং শ্মশান তৈরির ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বন দফতরের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে তিনটি প্রকল্পে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা নয়ছয় হয়েছে।
কিছু দিন আগে সাগরের বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা বকখালির বন দফতরে গিয়ে অফিসারদের রীতিমতো বকাবকি করেন। বঙ্কিমবাবু বলেন, ‘‘আমি এই ঘটনার কথা শুনেছি। দলে দুর্নীতি থাকলে তা বরদাস্ত করা হবে না। আমাদের দলের দিব্যেন্দু মণ্ডলকে শো-কজ করা হয়েছে। বন দফতরের অফিসারদেরও বলেছি, পুরো ঘটনার তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে।’’
দলের নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিমবাবুর সিপিএমের পঞ্চায়েত প্রধান শ্যামলী দাসের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন এই প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করার। শ্যামলীদেবী অবশ্য বলেন, ‘‘শ্মশান আমরা করেছি। তারপর আবার সেটার কাজ দেখানো হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে বঙ্কিমবাবুর দলের লোক জড়িয়ে পড়েছে বলে আমাদেরও টানতে চাইছেন। আমরাও একটা আলাদা অভিযোগ দিচ্ছি বিডিও অফিসে।’’
অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা দিব্যেন্দু মণ্ডল বলেন, ‘‘কাজ হয়নি, এ কথা ভুল। যেখানে হওয়ার কথা ছিল, তা থেকে একটু দূরে হয়েছে। আর আমি কোনও দায়িত্বে ছিলাম না। দলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা ষড়যন্ত্র করে আমার সুনাম খারাপ করতে চাইছে।’’ দিব্যেন্দুবাবুর বক্তব্য সমর্থন করেই বর্তমান রেঞ্জার অসীম দণ্ডপাঠ বলেন, ‘‘কাজ হয়েছে, তবে বন সুরক্ষা কমিটির সিদ্ধান্ত মতো সেটা একটু দূরে হয়েছে। কিন্তু সেই তথ্য কেন্দ্রীয় সাইটে আপলোড করা হয়নি।’’ ওই কর্তার দাবি, যেহেতু কাজ আগের নির্ধারিত জায়গায় হয়নি, তাই তাঁরা আর কাজের খতিয়ানের বোর্ড লাগাননি। যদিও একশো দিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত অফিসারেরা দাবি করছেন, কাজের সঠিক খতিয়ানই আপলোড হওয়ার কথা একশো দিনের কাজের কেন্দ্রীয় সাইটে।
তৃণমূল নেতা এবং বন দফতরের এই দাবিতে জল ঢেলে দিয়েছেন খোদ জবকার্ডধারীরাই। তাঁদের অনেকের দাবি, কাজ হয়নি, কিন্তু তাঁরা টাকা পেয়ে গিয়েছেন। উত্তর শিবপুরের বাসিন্দা সুবল সেনাপতির পরিবারের জবকার্ডেও ওই প্রকল্পের জন্য টাকা ঢুকেছে প্রায় ১১ হাজারের মতো। সুবলবাবু বলেন, ‘‘আমি বা আমার স্ত্রী কেউ ওই প্রকল্পে কাজ করিনি। কিন্তু টাকা ঢোকার পরে দিব্যেন্দুবাবু স্ত্রীকে সই করিয়ে ৮ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। আমি জানার পরে স্ত্রীকে বকাবকিও করেছি।’’ এই দাবি করছেন এলাকার আরও অনেক জবকার্ডধারীরা। তাঁরাও স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে অভিযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।