অবরোধে আটকে গাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
ঘরে লাগানো বিজলি বাতি। কিন্তু আলো জ্বলে কই! সিলিং থেকে ঝুলছে পাখা। ঘোরে না। যদি বা আলো জ্বলে, এক হাত দূরের জিনিস দেখতে টর্চ জ্বাললে ভাল। আর পাখা তো এমন ক্লান্ত শরীরে ঘোরে, মনে হয়, হাত দিয়ে একটু ঘুরিয়ে দিতে পারলে তেজ আসে!
এ ভাবেই দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন রায়দিঘির খাড়ি পঞ্চায়েতের শ্রীনগর, চাপড়াপাড়া, শাসনপাড়া-সহ আশপাশের ৫-৭টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। পরিস্থিতি এমন আকার নিয়েছে, টানা দু’মাস ধরে লোডশেডিং। একটা ফেজ-এ তবু আলো জ্বলছিল। বুধবার থেকে সেটাও বসে গিয়েছে। ট্রান্সফর্মার পুড়ে আংরা। শাসনপাড়ায় মুখ কালো করে খুঁটি থেকে ঝুলে আছে সে।
তিতিবিরক্ত মানুষজন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিদ্যুতের দাবিতে অবরোধ শুরু করেন। একে একে কাঠের গুঁড়ি এনে ফেলা হয় রায়দিঘি-ডায়মন্ড হারবার রোডের কাশীনগর মোড়ের কাছে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত অবরোধের জেরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ওই রাস্তা। একটা সাইকেলও গলতে দেননি অবরোধকারীরা। পুলিশ আসে। অনেক আলাপ-আলোচনা-আশ্বাসের পরে অবরোধ উঠেছে ঠিকই, কিন্তু গ্রামের লোকের অনেকেরই বক্তব্য, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে ফের কড়া পদক্ষেপ করতে বাধ্য হবেন তাঁরা।
কী বলছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা?
স্থানীয় স্টেশন ম্যানেজার সন্দীপ আধিকারিকের দাবি, শাসনপাড়ায় ৬৩ কেবি-র যে ট্রান্সফর্মারটি আছে, সেটি খারাপ হওয়াতেই যত গোলযোগ। ওটি বদলে ১০০ কেবি-র ট্রান্সফর্মার বসবে শীঘ্রই। সে কথা নাকি আগেই জানানো হয়েছে গ্রামবাসীদের।
কিন্তু তা বলে এত দিন লেগে যাবে সেই কাজে? তত দিন গ্রামের লোকের দুর্ভোগের কথা কী ভাববে না দফতর? এত যে গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কথা হয়, সে সবই কী ঢক্কানিনাদ? শুধ খুঁটি পুঁতে আলো দিলেই দায় শেষ? আলো জ্বলছে কিনা, তার খোঁজ রাখবে কে? প্রশ্নগুলো উঠছেই।
লো ভোল্টেজের সমস্যা নিয়ে কী বলছেন বিদ্যুৎ দফতরের আধিকারিক? তাঁর দাবি, প্রচুর হুকিং হয় গ্রামে। ট্রান্সফর্মার সেই বাড়তি চাপ নিতে পারছে না বলেই সমস্যা।
কিন্তু কারণ যা-ই হোক, তা সমাধানের ব্যবস্থা করার কি দায় নেই কর্তৃপক্ষের? প্রশ্ন গ্রামের মানুষের অনেকেরই।
বিদ্যুতের অভাবে রুটি-রুজিতে টান পড়েছে এলাকায়। কী রকম?
কথা হচ্ছিল ওসমান আলি গাজির সঙ্গে। এলাকায় তাঁর বরফ কল আছে। বললেন, ‘‘গরমের এই ক’টা মাসই তো আমাদের ব্যবসার আসল সময়। কিন্তু দু’মাস ধরে মেশিন চালিয়ে কাজই করা যাচ্ছে না। লোকসানের বহর সামাল দিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছি। সমস্যায় পড়ছেন শ্রমিকেরাও।’’
এলাকায় বেশির ভাগ মানুষই সেলাইয়ের কাজে যুক্ত। সেখানেই ইদানীং মেশিনের ব্যবহার হয়। ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কালাম শেখ জানালেন, ‘‘মেশিনে কাজ তো প্রায় লাটে ওঠার জোগাড়।’’ কিন্তু হাতে কাজ করে সেই পরিমাণ রোজগার হয় না। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক-মালিক— সমস্যায় পড়তে হচ্ছে দু’পক্ষকেই। অনেকে সেলাইয়ের পেশা বদলে অন্য কাজ খুঁজে নিচ্ছেন বলেও জানালেন তিনি।
সমস্যা শুধু এখানেই থেমে নেই। পড়ুয়াদের কথাও বলতে হয় এই প্রসঙ্গে। তহিদ শেখ পড়ে একাদশ শ্রেণিতে। তার কথায়, ‘‘গরিব ঘর। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি এখনও। কুপি জ্বেলে কোনও মতে পড়ি। দিনভর অন্য কাজ করে সন্ধ্যায় পড়তে বসে তাতে ক্লান্তি আসে আরও বেশি। পড়তে বসার একটু পড়েই চোখ লেগে আসে।’’
মোবাইলে চার্জ দেওয়া তো আর এক ঝক্কির কাজ হয়েছে। এখন ঘরে ঘরে মোবাইল। কিন্তু থাকলেই তো হল না। তাকেও তো চার্জ দিয়ে চাঙ্গা করে রাখতে হবে। বাধ্য হয়ে ছেলে ছোকরারা আশপাশের গ্রামে গিয়ে মোবাইলে চার্জ দিয়ে আসছে। কিন্তু সকলের পক্ষে সেই সুযোগ-সময় হয় না। শারীরিক পরিস্থিতিও হয় তো ভাল নয়। তাঁদের মোবাইল মুখ বুজে পড়ে আছে ঘরের কোণে।
এলাকায় বেশ কয়েকজন হৃদরোগী আছেন বলে জানালেন গ্রামের মানুষজন। হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে যাঁরা বাড়ি ফিরেছেন। প্রবল গরমে তাঁদের মর মর অবস্থা, বলছেন পাড়া-পড়শিরা। শুধু কী রোগী, সুস্থ লোকও এই গরমে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। সাকির মোল্লা-সহ অনেকেই জানালেন, বার বার বিদ্যুৎ দফতরকে জানিয়েও সুরাহা না হওয়ায় বাধ্য হয়ে অবরোধে নেমে পড়েছেন সকলে।
এখন রমজান মাস চলছে। বহু সংখ্যালঘু মানুষের বাস এই সব এলাকায়। দিনভর না খেয়েদেয়ে রোজা রাখছেন তাঁরা। তারপরে সন্ধ্যায় কাজ সেরে ঘরে ফিরে বেদম গরমে তাঁদের আরও কাহিল দশা।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে কবে, সে দিকেই তাকিয়ে গোটা এলাকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy