Advertisement
E-Paper

নার্গিসের মৃত্যুতে টনক নড়বে কি গ্রামের মানুষের

হাসপাতালে সন্তান প্রসব হয় করানো হয় না এখানে?প্রশ্ন শুনে এ ওর দিকে চাইলেন আলিমা আখন্দ, রোকেয়া সর্দাররা। বললেন, ‘‘গাঁয়ে তো কারও বাচ্চাই হাসপাতালে হয় না। সবই তো দাইমারা করান। কই, কোনও সমস্যা তো হয় না!’’

সামসুল হুদা

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০১:৪৪
এ বার হাসপাতালে প্রসব করানোর কথা ভেবেছেন মিনারা সর্দার। —নিজস্ব চিত্র।

এ বার হাসপাতালে প্রসব করানোর কথা ভেবেছেন মিনারা সর্দার। —নিজস্ব চিত্র।

হাসপাতালে সন্তান প্রসব হয় করানো হয় না এখানে?

প্রশ্ন শুনে এ ওর দিকে চাইলেন আলিমা আখন্দ, রোকেয়া সর্দাররা। বললেন, ‘‘গাঁয়ে তো কারও বাচ্চাই হাসপাতালে হয় না। সবই তো দাইমারা করান। কই, কোনও সমস্যা তো হয় না!’’

কিন্তু তা বললে তো চলবে না, সমস্যা যে হয়েছে।

ক্যানিঙের হাটপুকুরিয়া পঞ্চায়েতের ভলেয়া গ্রামে বাড়িতে প্রসব করাতে গিয়ে মারা গিয়েছেন নার্গিস বিবি। একে তো দাইয়ের হাতে প্রসব করানো হয় তাঁর। কিন্তু তারপরে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না। নার্গিসকে নিয়ে যাওয়া হয় এক হাতুড়ের কাছে। তিনি ঘণ্টা তিনেক চেষ্টা চালিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। শেষমেশ, ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে মারা যান ওই বধূ।

শনিবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সদ্য মা হারা সন্তানের দেখভালে ব্যস্ত বাড়ির লোকজন। সেই ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘেরা জালের মধ্যে বসে কাঁদছেন এক মহিলা। ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলছেন নার্গিসের স্বামী আব্দুল হাই। আগেও নার্গিসের দুই কন্যাসন্তান বাড়িতেই প্রসব হয়েছে বলে জানালেন তাঁরা।

সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে প্রসবের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব এখনও দাঁড়িয়া, হাটপুকুরিয়া, নিকারি-ঘাটা সহ ক্যানিঙের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মানুষজন মনে করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের থেকে বাড়িতে দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসব করালে তাদের মঙ্গল হবে। সন্তানের প্রতি কারও কু-নজর লাগবে না। কিন্তু দাইয়ের কছে প্রসব করানো হলে মা ও সন্তানের মৃত্যুর আশঙ্কা পর্যন্ত থাকে, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল নন এই সব এলাকার বহু মানুষ।

আব্দুল বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পরে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁরা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কার্ডও করিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে বাড়িতে এসে ওষুধপত্র দিয়ে যেতেন। স্ত্রীর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতেন।’’ কিন্তু আব্দুলের যুক্তি, আগেও যেহেতু স্ত্রী বাড়িতেই দু’টি সন্তান প্রসব করেছিলেন, এ বারও আশপাশের লোকজন পরামর্শ দেন, বাড়িতেই প্রসব করানোর ব্যাপারে। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পরে স্বামীর আক্ষেপ, ‘‘এমনটা হবে, আমি ভাবতে পারেনি।’’

মহকুমা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নিয়মিত আশা কর্মী, এএনএমআর, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রসূতি মায়েদের খবর নেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে পরামর্শ দেন। জননী সুরক্ষা প্রকল্পে যে সব সাহায্য মেলে, তা জানান। যদি কেউ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কার্ড না করে থাকেন, তাঁদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে এসে কার্ড করান। সরকারি এই উদ্যোগের ফলে ক্যানিং ২ ব্লকের সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসবের সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ। ক্যানিং ১ ব্লকের সংখ্যাটা প্রায় ৭০ শতাংশ। বাসন্তী ব্লকের সংখ্যাও প্রায় ৭০ শতাংশ। গোসাবা ব্লকে তুলনায় কিছুটা কম, ৬৫ শতাংশ।

কিন্তু তারপরেও হাটপুকুরিয়ার গ্রামের মতো অবস্থা বহু এলাকায়। পঞ্চায়েত প্রধান প্রতিমা মণ্ডলের ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পরেশরাম দাস বলেন, ‘‘মা ও শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে আমরা নানা ভাবে চেষ্টা করছি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসূতি মায়েরা যাতে প্রসব করান, সে জন্য পঞ্চায়েত স্তর থেকে শুরু করে ব্লক স্তরে প্রচার করছি।’’ প্রতিটি পঞ্চায়েতে ‘নিশ্চয় যান’ও আছে। ওই অ্যাম্বুল্যান্সেই প্রসূতিকে নিখরচায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসীম দাস মালাকার শুনেছেন প্রসূতি মৃত্যুর খবর। তিনি বলেন, ‘‘রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছি। খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে আমরা নানা ভাবে প্রচার চালাচ্ছি।’’ তাঁর দাবি, সরকারি নানা উদ্যোগের মাধ্যমে ক্যানিং মহকুমায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসবের সংখ্যা বাড়ানো গিয়েছে। মৃত্যুর হারও কমেছে।

যদিও নার্গিসের মৃত্যুর ঘটনা সেই উদ্যোগের সাফল্য নিয়েই প্রশ্ন চিহ্ন রেখে গেল।

ওই অঞ্চলের মিস্ত্রিপাড়া, ঢালিপাড়া, সর্দারপাড়া, মোল্লাপাড়া-সহ আশপাশে হাজারখানেক পরিবারের বাস। কিন্তু হাসপাতালে প্রসব করানোর চল নেই বলে জানালেন মহিলারা। যদিও তাঁরা স্বীকার করলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা বার বার গ্রামে এসে হাসপাতালে সন্তান প্রসব করানোর পরামর্শ দেন। ওষুধপত্র দেন। স্বাস্থ্যপরীক্ষাও করেন।

কিন্তু তারপরেও যান না হাসপাতালে? নার্গিসের ঘটনা জানাজানির পরে এখন অবশ্য অনেকেই বলছেন, ‘‘আমাদের ভুল অনেকটাই ভেঙেছে।’’

গ্রামের এক প্রসূতি মিনারা সর্দার বলেন, ‘‘আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কার্ড করিয়েছি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করাই। কিন্তু গ্রামের আর পাঁচজনকে দেখে ভেবেছিলাম, আমার সন্তানও বাড়িতেই জন্ম নেবে। কিন্তু এমন একটা ঘটনা শোনার পরে ভয় করছে। আমি আর বাড়িতে প্রসব করাব না। হাসপাতালেই ভর্তি হব।’’

মিনারার মতো গাঁয়ের বধূদের এই পদক্ষেপই ধীরে ধীরে বদলে ফেলতে পারে পরিস্থিতি।

Patient Hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy