বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু গরম এখনও কমেনি দক্ষিণবঙ্গে। লোডশেডিংয়ের দাপটও চলছে। ফলে মার্চ মাসের শেষ থেকে শুরু করে এখনও প্লাস্টিকের হাতপাখার কদর কমেনি গাঁয়ে-গঞ্জে।
তালপাতার হাতপাখাই আগে ছিল বিজলি বাতির ফ্যানের বিকল্প। গত কয়েক বছর ধরে কম দামের প্লাস্টিকের হাতপাখার বিক্রি বেড়েছে। বাদুড়িয়ার পাখা শিল্পীদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। গুড়দহ এবং তারাগুনিয়া-সহ বাদুড়িয়ার বিভিন্ন জায়গায় হাতপাখা তৈরির কারখানা আছে। তাল গাছ কমে যাওয়ায় তালপাতার পাখা ইদানীং কমছে। সেই বাজার দখল করেছে প্লাস্টিকের হাতপাখা। ‘সানপ্যাক’ প্লাস্টিক বোর্ড কেটে তৈরি হয় পাখা। কলকাতার বড়বাজার থেকে ১৪০-১৫০ টাকা দরে ৬ ফুট বাই ৪ ফুটের প্লাস্টিক বোর্ড কেনেন ব্যবসায়ীরা। তা থেকে মূলত ১০ ইঞ্চি এবং ৬ ইঞ্চি মাপের দু’ধরনের পাখা তৈরির হয় কারখানায়। তাতে সিনেমার হিরো-হিরোইনদের ছবি যেমন থাকে, তেমনই থাকে দেবদেবীর মূর্তি। ফুল-লতাপাতা। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটারে ডিজাইন করে সিল্ক স্ক্রিন পদ্ধতিতে হাতপাখার উপরে নানা নকশা ছাপা হয়। পাখা তৈরির পরে তাতে লাগানো হয় বাঁশের চটার হাতল। বাড়ির মহিলা-শিশুরাও এই কাজে হাত লাগায়। গুড়দহ গ্রামের ব্যবসায়ীদের দাবি, অন্যান্য বার যেখানে ২৫-৩০ হাজার পাখা তৈরি হত, সেখানে এ বার সংখ্যাটা প্রায় লক্ষ ছাড়িয়েছে। চাঁদি ফাটা গরম দীর্ঘ দিন ধরে কমান নাম নেই। সে জন্যই বাড়ছে চাহিদা।
মুদির দোকানের পাশাপাশি পাখা তৈরির কারবার খুলে বসেছেন আতর আলি মণ্ডল। জানালেন, বাড়ির বেশির ভাগ সদস্যই পাখা তৈরির কাজে হাত লাগায়। পাখা তৈরির ব্যবসায়ীদের অনেকে জানালেন, ভোটের মরসুমে আবার রাজনৈতিক দলের প্রতীক, প্রার্থীর ছবি দেওয়া হাতপাখা তৈরি হয়। ব্যবসা আরও বাড়ে। এ বারই যেমন লোকসভা ভোটের সময় এ ধরনের পাখার বরাত মিলেছিল প্রচুর। বিয়ে বাড়িতেও ইদানীং অতিথিদের প্লাস্টিকের হাতপাখা দেওয়া হচ্ছে। যার এক পিঠে খাদ্যতালিকা এবং অন্য পিঠে পাত্রপাত্রীর পরিচয় লেখা হয়। গ্রামে-গঞ্জের অনুষ্ঠান বাড়িতে এ ধরনের প্রবণতাও বাড়ছে ইদানীং।
শীতকালটুকু বাদ দিলে সারা বছরই হাতপাখা কমবেশি বিক্রি হয়। গুড়দহের নাজমা খাতুন, মনোয়ারা বিবিরা বলেন, “সারা দিনে সংসারের নানা কাজের পরে পাখায় হাতল লাগানোর কাজ করি। এতে নিজেদের হাতখরচের টাকাটা উঠে আসে। যে কারণে গ্রামের মেয়ে-বউরাও ইদানীং এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন।” জানা গেল, একশো হাতল লাগালে ৮ টাকা মেলে। এক জন শ্রমিক দিনে সাধারণত শ’পাঁচেক হাতল লাগাতে পারে। পাখা শিল্পী খোকন মোল্লার কথায়, “পাখা বিক্রি করে লাভ থাকে সামান্য। তবে খুচরো ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা পান। ৫-৬ টাকায় তারা একেকটি পাখা বিক্রি করেন।” খোকন জানান, এ বছর ইতিমধ্যেই তাঁর কারখানা থেকে প্রায় ৮০ হাজারের উপর পাখা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
তারাগুনিয়ার জমাত আলি মণ্ডল, মিনু বিবিদের দাবি, এই অঞ্চলেই নাকি প্রথম চালু হয়েছে প্লাস্টিকের হাতপাখা। বছর চোদ্দো আগে যার সূত্রপাত। তাঁদের কাছ থেকেই কাজ শিখে অনেকে পরে পরে ব্যবসায় নেমেছেন। মিনু বলেন, “প্রথমে হাতে রঙ করে পাখা তৈরি করতাম। এখন সিল্ক স্ক্রিনে অনেক ধরনের ছাপা হয়।” জমিল মোল্লা, ওয়াহাব গাজিরা জানালেন, এই শিল্পে কোনও সরকারি সাহায্য নেই। ব্যাঙ্ক ঋণও মেলে না। সে সব ব্যবস্থা যদি থাকত, তা হলে ব্যবসা আরও বাড়ত।