Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ছাদ চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ে, ডায়মন্ড হারবার ফৌজদারি আদালতে জমছে মামলার পাহাড়

বোধ হয় এ জীবনে আর মামলার নিস্পত্তি হবে না! দেখতেও দেখতে কুড়িটা বছর কেটে গেল। অথচ মামলা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। ফলে রীতিমতো হতাশ রায়দিঘির বকুলতলা গ্রামের সুভাষ হালদার। জমির দখল নিয়ে প্রতিবেশী দুই পরিবারের মহিলাদের মধ্যে মারপিটের জেরে এই মামলা নিষ্পত্তি হতে আরও কত দিন ডায়মন্ড হারবার আদালতে হাজিরা দিতে হবে, তা ভেবে হতাশ সুভাষবাবুর মতো বহু বিচারপ্রার্থী।

এই আদালত নিয়েই ক্ষোভ বিচারপ্রার্থীদের।—নিজস্ব চিত্র।

এই আদালত নিয়েই ক্ষোভ বিচারপ্রার্থীদের।—নিজস্ব চিত্র।

দিলীপ নস্কর
ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৭
Share: Save:

বোধ হয় এ জীবনে আর মামলার নিস্পত্তি হবে না! দেখতেও দেখতে কুড়িটা বছর কেটে গেল। অথচ মামলা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। ফলে রীতিমতো হতাশ রায়দিঘির বকুলতলা গ্রামের সুভাষ হালদার। জমির দখল নিয়ে প্রতিবেশী দুই পরিবারের মহিলাদের মধ্যে মারপিটের জেরে এই মামলা নিষ্পত্তি হতে আরও কত দিন ডায়মন্ড হারবার আদালতে হাজিরা দিতে হবে, তা ভেবে হতাশ সুভাষবাবুর মতো বহু বিচারপ্রার্থী। আদৌ জীবদ্দশায় মামলার নিষ্পত্তি দেখে যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়েই এখন সংশয়ে ভোগেন তাঁরা। ডায়মন্ড হারবার ফৌজদারি আদালতের উপযুক্ত পরিকাঠামো অভাবে বিচার প্রার্থীদের এই দশা।

ডায়মন্ড হারবার মহকুমা আদালতটি হুগলি নদীর ধারে মহকুমাশাসকের অফিসের পাশেই। প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি দিনের পুরনো আদালত ভবন। ভবন না বলে অবশ্য অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া একটা বাড়ি বলাই ভাল। সেখানেই চলছে এসিজেএম, এসিজেএম-১ এসিজেএম-২ এবং এসিজেএম-৩ এই চারটি আদালত চলছে। তারমধ্যে এসিজেএম ও এসিজেএম-১ আদালত কক্ষটি কাজ চালানোর মতো ঘর হলেও বাকি দু’টি খুপরি খুপরি ঘরেই কাজ চালাতে হচ্ছে। অ্যাসবেস্টসের চালের ওই ঘরটি বহু বছর ধরে সংস্কার না করায় কয়েক বছর আগে বৃষ্টির জল ভিতরে পড়ে জরুরি কাগজপত্র নষ্ট হচ্ছিল। তাই অ্যাসবেস্টসের উপরে পিচ-চট লাগানো হয়েছিল। ওই ‌চালের অবস্থাও এখন বেশ খারাপ। বৃষ্টির জল চুঁইয়ে আদালত কক্ষে পড়ে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কাগজপত্র। জল পড়ে মেঝে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে। ফলে বাসা বাঁধে উইপোকা। দরকারি নথিপত্রের উপরে দখলদারি বেড়েছে তাদেরও। আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীদের বিশ্রামের জনন্য বা দাঁড়ানোর মতোও কোন ছাউনি নেই। বাধ্য হয়ে ওই আদালতের স্বল্প পরিসরে বারান্দায় আশ্রয় নিতে হয় তাঁদের। আর বারান্দায় দাঁড়ানোর জায়গা না মিললে বাধ্য হয়ে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় খোলা আকাশের নীচে। প্রায় একই অবস্থা আইনজীবীদেরও। এই আদালতে শ’তিনেক আইনজীবী থাকলেও তাঁদের বসার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামোই নেই। তার উপর, মামলার সংখ্যার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা বেশ কম। কোনও বিচারপ্রার্থীর বছরে দু’তিন বার মামলার দিন পড়ে। তাই এক-একটি মামলা বহু বছর ধরে চলতে থাকে। ভরণপোষণ মামলায় তিন-চার মাস অন্তর দিন পড়ায় মহিলা বিচারপ্রার্থীদেরও হয়রান হতে হয়। এই সমস্যা রাজ্যের অন্য প্রান্তেও আছে। কিন্তু ডায়মন্ড হারবারের মতো পরিকাঠামোর এমন অবস্থা হয় তো সর্বত্র নয়।

জানা গেল, এখানে প্রয়োজন মতো পেশকার মেলে না। ফলে বিচারপ্রার্থীদের নথিপত্র বিচারকের কাছে পেশ করা হচ্ছে না। এ ছাড়াও, কোনও আসামী আদালতে হাজির না হলে কর্মীর অভাবে সমন পাঠানোর সমস্যা হয়। সারা আদালত জুড়ে পানীয় জলের হাহাকার। আইনজীবীদের সেরেস্তার পিছনে একটি পানীয় জলের নলকূপ আছে বটে। কিন্তু তার খবর জানেন না বেশির ভাগ মানুষ। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে তৃষ্ণায় বুক ফেটে গেলেও এক ফোঁটা জল পান না তাঁরা। বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শৌচাগারের হাল খারাপ। উপযুক্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। মশার উপদ্রব।

অথচ এই আদালতের উপরে ডায়মন্ড হারবার মহকুমায় ৯টি ব্লক মন্দিরবাজার, কুলপি, মগরাহাট-১ ও ২, ফলতা, মথুরাপুর-১ ও ২ এবং ডায়মন্ড হারবার-১ ও ২ এলাকার বাসিন্দাদের নির্ভর করতে হয়। আদালতের আইনজীবী শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিচারপ্রার্থীর সংখ্যার তুলনায় বিচারক কম থাকায় এক একটি মামলা অনন্তকাল ধরে চলছে।” তিনি আর জানালেন, তাঁর হাতে একটি মামলা ১৯৮০ সাল থেকে চলছে। খড়-বোঝাই লরি আটকে চাঁদা তোলা নিয়ে মারপিট হয়। সেই মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। কারণ, বিচারক কম। তাঁরা স্থানান্তরিত হয়ে যান। সময় মতো সাক্ষীকেও পাওয়া যায় না। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি।

ডায়মন্ড হারবার ক্রিমিন্যাল কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুদীপ চক্রবর্তীর বক্তব্য, এই আদালতের বেহাল পরিকাঠামোর জন্য প্রায় ৩০ হাজার মামলা জমে রয়েছে। পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য জেলা আদালতে ও উচ্চ আদালতে জানানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE