Advertisement
E-Paper

তিনশো বছরেরও প্রাচীন পুজো, হারায়নি জৌলুস

বয়স ৩১৫। বসিরহাটের শিকড়া কুলিন গ্রামের ‘রাখাল মহারাজে’র পুজো এখনও স্বমহিমায় বিদ্যমান। রামকৃষ্ণ দেবের মানসপুত্র রাখালচন্দ্র ঘোষ তথা ব্রহ্মানন্দ মহারাজ-এর বাড়ির এই পুজো ধুমধাম করে পালন করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। শিকড়ের টানে ঘরে ফেরেন ঘোষ পরিবারের সদস্যরোও। মহকুমার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এই ঘোষ বাড়ির দুর্গা পুজো।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২৯
ব্রহ্মানন্দ মহারাজের ভিটে।

ব্রহ্মানন্দ মহারাজের ভিটে।

বয়স ৩১৫। বসিরহাটের শিকড়া কুলিন গ্রামের ‘রাখাল মহারাজে’র পুজো এখনও স্বমহিমায় বিদ্যমান। রামকৃষ্ণ দেবের মানসপুত্র রাখালচন্দ্র ঘোষ তথা ব্রহ্মানন্দ মহারাজ-এর বাড়ির এই পুজো ধুমধাম করে পালন করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। শিকড়ের টানে ঘরে ফেরেন ঘোষ পরিবারের সদস্যরোও। মহকুমার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এই ঘোষ বাড়ির দুর্গা পুজো।

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রামের আনন্দমোহন ঘোষের পরিবারে জন্মান রাখালচন্দ্র। পরে রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণের পর নাম হয় ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। বেলুড় মঠে গঙ্গার ধারের দু’টি মন্দিরে পাশাপাশি বিবেকানন্দ এবং ব্রহ্মানন্দের মূর্তি রয়েছে। বেলুড় মঠের প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি। শিকড়া কুলিন গ্রামে ব্রহ্মানন্দের নামে একটি আশ্রমও রয়েছে।

ঘোষ পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা জানান, পঁুথি ঘেঁটে যত দূর জানা যায়, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সদানন্দ ঘোষ হুগলি জেলার বালির কাছের আরুনা থেকে শিকড়া কুলিন গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। সে সময়ে গ্রামের উত্তরে ইছামতী নদী দিয়ে যাওয়া আসা চলত। সদানন্দের পঞ্চম পুরুষ দেবীদাস ঘোষ কাশফুল আর শিউলি গাছে ঘেরা পুকুরের পাশে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দেবী চণ্ডীর আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন।

এই প্রাচীন পুজো নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তীও। এত বছরে একই কাঠামোর উপরে প্রতিমা তৈরি হয়ে আসছে। পুজো পদ্ধতিতেও কোনও রকম পরিবর্তন হয়নি। কথিত আছে কোনও রকম পরিবর্তন কিংবা আয়োজনের ত্রুটি হলে আর রক্ষা থাকবে না! পরিবারের সদস্য পবিত্র ঘোষ বলেন, “এখানে দেবী বড় জাগ্রত। বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি, অনেক বছর আগে পূর্বপুরুষদের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এক শরিক প্রতিমা এবং পুজোর পরিবর্তন করেন। সে বার নবমীর দিন নাকি তাঁর দুই ছেলের মৃত্যু হয়।” সেই থেকে আর কেউ ও কথা স্বপ্নেও ভাবেন না!

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ঘোষ বাড়িতে পুজোর শুরুতে দেবীর ঘট বসত মাটির একটি আট চালা ঘরে। সেখানেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে পুজোর আয়োজন করা হত। পরবর্তীকালে দেবীর পুজোর জন্য জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষ পাঁচ খিলানযুক্ত পুজোর দালান তৈরি করেন। সেই থেকে ওই দালানেই নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর আয়োজন করা হয়। ওই পরিবারের পুরোহিত জানান, পশু বলিতে এক বার বাধা পড়ে। সেই থেকে পশু বলি বন্ধ হয়ে যায়।

ঘোষ পরিবারে নিয়ম মতে দেবীর বোধনের দিনে ‘নিদ্রা কলস’ বসানো হয়। ঘট থাকে দশমী পর্যন্ত। পরিবারের বিশ্বাস, পুজোর দিনগুলিতে দালান পাহারা দেয় ‘নিদ্রা কলস’। প্রতি বছর পরিবারের এক এক জন পালা করে পুজোর দায়িত্ব নেন। বর্তমানে পরিবারে পাঁচ শরিক। সারা বছর বিশেষ কেউ না থাকলেও পুজোর দিনগুলিতে পরিবারের সদস্যেরা যে যেখানে থাকেন, চলে আসেন শিকড়া কুলিনগ্রামে।

ঘোষ বাড়ির দুর্গা পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, নবমীতে দেবী দুর্গা, নারায়ণ শিলা এবং করুণাময়ীর এক সঙ্গে আরতি। কেবল পুজোর নিয়মই নয়, ঘোষ পরিবারে বংশ পরম্পরায়ে প্রতিমা গড়েন ব্রাহ্মণেরা। প্রতিমা শিল্পীর কথায়, “সূচনা পর্বে যে কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছিল, আজও সেই একই কাঠামোর উপরেই এক চালের ডাকের সাজের প্রতিমা করা হয়।” তিথি-নক্ষত্র এবং পারিবারিক প্রথা মেনে দশমীতে দেবী প্রতিমার বিসর্জন হয়।

স্থানীয় একটি পুকুরের পাড়ে পুজোর দিনগুলিতে মেলা বসে। বসিরহাটের বিভিন্ন জমিদার অথবা বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর আনন্দ এক দিকে কমছে। অন্য দিকে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা, আলো এবং মণ্ডপের জৌলুস। জমিদার এবং বনেদি বাড়ির অনেকই আজ আর বসিরহাটে থাকেন না। শহর কলকাতা কিংবা ভিন রাজ্যে অথবা বিদেশে তাঁদের ঠিকানা। তবুও পুজোর সময়ে অনেকেই ফেরেন গ্রামে। সঙ্গে আসেন বন্ধু-বান্ধবেরা। তাঁরাও গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে ধুমধামের মধ্যে দিয়ে পুজোর আনন্দ অনুষ্ঠান উপভোগ করে ফিরে যান নিজের নিজের ঠিকানায়।

বনেদি বাড়ির পুজোর সাবেকিয়ানা আজও বসিরহাটের মানুষকে টানে। এখনও নানা রকম প্রথা মেনেই এই সমস্ত পুজোগুলি হয়। ধান্যকুড়িয়ার বল্লভদের বাড়িতে শূন্যে তিনবার গুলি ছুড়ে সন্ধি পুজো শুরু হয়। আবার ষষ্ঠীর দিন কালী মন্দিরে দেওয়া বলির পাঁঠার মাংস দেবী চণ্ডীকে নিবেদন করে বোধন হয় বাদুড়িয়া আড়বেলিয়ার বসু বাড়িতে। তিনশো বছর পুরনো এই পুজো। জানা যায়, একবার এই বাড়িতে সুভাষ চন্দ্র বসুও এসেছিলেন। দন্ডিরহাটের বসুবাড়ির পুজো ‘ডাক্তার বাড়ির পুজো’ নামে খ্যাত। একবার পুজো চলাকালীন পায়রা এসে বসেছিল দেবীর হাতে। হাতটি ভেঙে গিয়েছিল। তারপর থেকে আটটি হাত ছোট করে তৈরি করা হয়। নলকোড়া গ্রামের কর জমিদার বাড়ির পুজোও উল্লেখযোগ্য। ইছামতীর তীরে টাকির রায়চৌধুরী বাড়ি। এই বাড়িতে বেশ ভালভাবেই পালিত হয় দুর্গাপুজো। সীমান্তবর্তী পানতির গ্রামে প্রকৃতি প্রেমিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্বশুরবাড়িতে ১৭৬০ সালে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। আজও প্রাচীন প্রথা মেনে এই বাড়ির পুজো হয়। এই এলাকায় ইটিন্ডার নরহরি দে, হাড়োয়ার সাহা বাড়ি, ভেবিয়ার পাল বাড়ি, বসিরহাটের উপাধ্যায় বাড়ি, মজুমদার বাড়ি এবং হাসনাবাদের দে জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোও উল্লেখযোগ্য।

সবুজ সঙ্ঘ ও শহিদ দীনেশ সঙ্ঘের পুজোও দিনে দিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ বার দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের আদলে এই দুই ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে।

southbengal pujo basirhat sikra kulin gram rakhal maharaj's family durga puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy