Advertisement
০৬ মে ২০২৪

নৌকো-ট্রলার নথিভুক্ত করানো থমকে, সমস্যা নিরাপত্তায়

মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে হামলা করার জন্য পাকিস্তানের নাম-গোত্রহীন এক নৌকোয় সওয়ার হয়েছিল আজমল কাসভ আর তার সঙ্গীরা। ওই ঘটনার পর থেকে জলপথে আরও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া হয়। সারা দেশে প্রতিটি নৌকো-ট্রলারের অনলাইন নথিভুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করে কেন্দ্রীয় সরকার। এ রাজ্যেও নৌকোর অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য নামগোত্রহীন নৌকো-ট্রলার।

শান্তশ্রী মজুমদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৯
Share: Save:

মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে হামলা করার জন্য পাকিস্তানের নাম-গোত্রহীন এক নৌকোয় সওয়ার হয়েছিল আজমল কাসভ আর তার সঙ্গীরা। ওই ঘটনার পর থেকে জলপথে আরও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া হয়। সারা দেশে প্রতিটি নৌকো-ট্রলারের অনলাইন নথিভুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করে কেন্দ্রীয় সরকার। এ রাজ্যেও নৌকোর অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য নামগোত্রহীন নৌকো-ট্রলার। মৎস্যজীবীদের সংগঠনগুলির হিসেব, এ রকম পরিচয়হীন নৌকো এবং ট্রলারের সংখ্যাটা প্রায় ৪ হাজারের কাছাকাছি। এর জেরে নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট হলদিয়া কোস্টগার্ডের কর্তারাও।

কিন্তু সম্প্রতি নানা ঝামেলায় প্রায় থমকে গিয়েছে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া। তাতে সমস্যায় পড়েছেন মৎস্যজীবীরাও। কারণ, এ বছর থেকেই নিয়ম করা হয়েছে, নৌকোর রেজিস্ট্রেশন করানো না হলে মাছ ধরার বার্ষিক লাইসেন্সও পুনর্ণবীকরণ করা হবে না।

মৎস্যজীবী সংগঠনগুলির অভিযোগ, রেজিস্ট্রেশন করার জন্য টাকা জমা করার দীর্ঘদিন পরেও অনেক ট্রলার এবং নৌকোয় মাছ ধরার ছাড়পত্র পাওয়া যাচ্ছে না। রেজিস্ট্রেশন না হলে যেহেতু মাছ ধরার ছাড়পত্র (এ বছর থেকেই চালু হয়েছে অনলাইন লাইসেন্স প্রদান) মিলছে না, তাই ঝুঁকি নিয়েই সমুদ্রে পাড়ি দিতে হচ্ছে নৌকো, ট্রলারগুলিকে। সাউথ-সুন্দরবন মৎস্যজীবী ও মৎস্য কর্মচারী ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক নীলরতন হালদার বলেন, “ডায়মন্ড হারবার, মথুরাপুর-১ এবং ২ ব্লক, পাথরপ্রতিমা, সাগর, নামখানা, গোসাবার অনেক মৎস্যজীবী এ বছর মার্চ মাসে আবেদন করেছিলেন। এখনও তাঁরা ছাড়পত্র পাননি।” ব্লকের ফিসারি এক্সটেনশন অফিসারদের একাংশের গাফিলতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন মৎস্যজীবীরা। সেই সঙ্গে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আল‌াদা করে ঘুষ চাওয়া হচ্ছে বলেও তাঁদের কাছে অভিযোগ আসছে বলে জানিয়েছেন নীলরতনবাবু। বিষয়টি নিয়ে মৎস্য দফতরের সচিব এবং মৎস্য অধিকর্তার সঙ্গে বৈঠক করার পরেও অচলাবস্থা কাটছে না বলে দাবি সংগঠনগুলির।

দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রায় ৯ হাজার নৌকো-ট্রলার মাছ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে মোটরচালিত নৌকো, ট্রলারের সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার মতো। বাকি বেশিরভাগ নৌকো যন্ত্রচালিত নয়। মৎস্যজীবী সংগঠনগুলির দাবি, সার্বিক ভাবে মাত্র অর্ধেক বোটের রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়েছে। ২০১০ সালে খাতায়-কলমে চালু হলেও রাজ্যে রেজিস্ট্রেশনের এই প্রক্রিয়া সক্রিয় ভাবে শুরু হয় ২০১২-১৩ সাল থেকে। তবে এ বছরের সাত মাস কেটে গেলেও জেলায় রেজিস্ট্রেশনের কাজ শেষ করতে পারেনি মৎস্য দফতর। দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা (সামুদ্রিক) কিরণ দাস অবশ্য দাবি করেছেন, অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে কিছুটা বাকি রয়েছে। কারণ, এর আগে ইউনিয়নগুলির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করার সময়ে বেশ কিছু ভুয়ো নৌকো-ট্রলারেরও এন্ট্রি হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “সেই সব নৌকো এবং ট্রলারগুলি পরিদর্শন করার সময়ে দেখা যায়, বাস্তবে তাদের কোনও অস্তিত্বই নেই। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই রেজিস্ট্রেশন করানো হয়েছিল। সেই তালিকা এখন ঠিক করতে হবে।” ওই আধিকারিকের আরও বক্তব্য, “গত তিন বছর ধরে এই রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চলেছে। বার বার বলা সত্ত্বেও অনেক নৌকো মালিক আসেননি। এখন এসে সকলে ভিড় করছেন।” ফিসারি এক্সটেনশন অফিসারদের গাফিলতি বা রেজিস্ট্রেশনের জন্য টাকা চাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কিরণবাবু।

অতিরিক্ত মৎস্য অধিকর্তা দফতর সূত্রে দাবি করা হয়েছে, পুরনো নৌকো, ট্রলারের মধ্যে ৫,১০০ অনলাইন লাইসেন্স দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তবে নতুন নৌকো কত আর পুরনো কতগুলি রয়েছে, তা রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হলে বোঝার উপায় নেই। দফতরের এক অফিসারের কথায়, “নতুন নৌকো, ট্রলার মাছ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ট্রলার হস্তান্তরও হচ্ছে বা বসে যাচ্ছে। অন্য জায়গায় চলেও যাচ্ছে। আমাদের দফতরে আবেদন করার অল্প দিনের মধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে নন মেকানাইজড বোটের (যন্ত্রচালিত নয়, এমন) ক্ষেত্রে কিছু আবেদন পড়ে থাকতে পারে। চেষ্টা করা হচ্ছে দ্রুত কাজ শেষ করার।” দফতরের তরফে দাবি করা হয়েছে, আবেদনের প্রক্রিয়ায় গলদ থাকলে বেশি সময় লাগতে পারে।

নৌকো এবং ট্রলারের অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করার কাজ বেশ সময়সাপেক্ষ। ব্লকের ফিসারি এক্সটেনশন অফিসারদের মাধ্যমে বা সরাসরি অতিরিক্ত মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক)-এর দফতরে আবেদন করার পরে হাতে-কলমে পরিদর্শন করে দেখা হয়। সত্যিই আবেদনকারীর নৌকো বা ট্রলার রয়েছে কিনা, থাকলে তা আবেদনপত্রে উল্লেখ করা বর্ণনার সঙ্গে মিলছে কিনা এই সব কাজ করেন ব্লকের ফিসারি এক্সটেনশন অফিসারেরাই। এ ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা বলছেন আধিকারিকেরা। মৎস্য অধিকর্তার দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, দফতরের আওতাভুক্ত এলাকার মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হাওড়ার বেশ কয়েকটি এলাকায় একজন এক্সটেনশন অফিসার দু’টি করে ব্লকের দায়িত্ব সামলান। তাই পরিদর্শনের কাজ দিনে দিন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়াও, রেজিস্ট্রেশনের জন্য ডেটা এন্ট্রির কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ইন্টারনেটে ভাল গতির অভাব বা ডায়মন্ড হারবারে লোডশেডিংয়ের সমস্যাও ভোগাচ্ছে।

গত মাসের শেষ দিকে মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি ফিসারি এক্সটেনশন অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর থেকে অফিসার-মৎস্যজীবী মনোমালিন্যের জেরে রেজিস্ট্রেশনের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। এখনও জটিলতা সব জায়গায় কাটেনি। অনেক ব্লকেই পড়ে রয়েছে আবেদনপত্র। এ রকমই অভিযোগ করছেন মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতারা। ফলে মাছ ধরার মরসুমের দু’মাস পেরিয়ে গেলেও অসুবিধা নিয়েই মাছ ধরা জারি রাখতে হচ্ছে তাঁদের।

সবচেয়ে বড় কথা, মাছ ধরার লাইসেন্স এবং নৌকোর রেজিস্ট্রেশন না থাকায় উপকূল নিরাপত্তায় বড়সড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত কোস্ট গার্ড এবং উপকূল থানাগুলির সঙ্গে ঝামেলায় জড়াচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া নৌকো-ট্রলারের উপরে নজরদারি করার ক্ষেত্রে তাদেরও সমস্যা হচ্ছে। সুন্দরবন এলাকার অসংখ্য নদী-নালা। সেখান থেকে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে চলে যায় নৌকো-ট্রলারগুলি। বিস্তীর্ণ উপকূল এলাকায় সব সময়ে ঠিকঠাক নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে এ রকম নামগোত্রহীন নৌকো বা ট্রলার মাছ ধরার অছিলায় এ দিকে ঢুকে পড়লে ঘটনাস্থলেই সেগুলি চিহ্নিত করতে হয়। এ রাজ্যের নৌকো এবং ট্রলারের রেজিস্ট্রেশনই তার একমাত্র সহজ পথ। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া ঠিক মতো না চললে রাজ্যের উপকূলে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বাড়তেই থাকবে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা

• ২০১০ সালে খাতায়-কলমে চালু হলেও রাজ্যে নথিভুক্তকরণের এই প্রক্রিয়া সক্রিয় ভাবে শুরু হয় ২০১২-১৩ সাল থেকে।

• দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রায় ৯ হাজার নৌকো-ট্রলার মাছ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। অ-নথিভুক্ত নৌকো এবং ট্রলারের সংখ্যাটা প্রায় ৪ হাজারের কাছাকাছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE