Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

হারানো প্রাপ্তির পোর্টালও নিরুদ্দেশ

থানা-পুলিশ আছে। নিখোঁজের হদিস পেতে আছে প্রযুক্তি-পোর্টাল। তবু নিখোঁজকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরেও সে-খবর যথাসময়ে তার পরিবারের কাছে পৌঁছবে না কেন, সেই প্রশ্ন উঠে গেল বারাসতের একটি শিশুর অন্তর্ধানে। আত্মীয়স্বজন-পাড়াপড়শি হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন পাঁচ বছরের শিশুটিকে। নিখোঁজ-ডায়েরিও করা হয় ছবি দিয়ে। পুলিশ অফিসারেরা বারে বারেই বলছিলেন, তাঁরা নিয়ম মেনে শিশুটির সব তথ্য ‘মিসিং চিলড্রেন ট্র্যাকিং পোর্টাল’-এ তুলে দিয়েছেন। তাই দেশের কোনও থানা শিশুটির খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছে যাবে পরিবারের কাছে।

বাড়ি ফেরার পরে মায়ের সঙ্গে বিকাশ। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

বাড়ি ফেরার পরে মায়ের সঙ্গে বিকাশ। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২১
Share: Save:

থানা-পুলিশ আছে। নিখোঁজের হদিস পেতে আছে প্রযুক্তি-পোর্টাল। তবু নিখোঁজকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরেও সে-খবর যথাসময়ে তার পরিবারের কাছে পৌঁছবে না কেন, সেই প্রশ্ন উঠে গেল বারাসতের একটি শিশুর অন্তর্ধানে।

আত্মীয়স্বজন-পাড়াপড়শি হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন পাঁচ বছরের শিশুটিকে। নিখোঁজ-ডায়েরিও করা হয় ছবি দিয়ে। পুলিশ অফিসারেরা বারে বারেই বলছিলেন, তাঁরা নিয়ম মেনে শিশুটির সব তথ্য ‘মিসিং চিলড্রেন ট্র্যাকিং পোর্টাল’-এ তুলে দিয়েছেন। তাই দেশের কোনও থানা শিশুটির খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছে যাবে পরিবারের কাছে।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই কাজ করল না। হারিয়ে যাওয়া শিশুদের খোঁজ দেওয়া যার কাজ, সেই পোর্টালও কার্যত নিরুদ্দেশ!

বারাসতের হৃদয়পুর থেকে শনিবার নিখোঁজ হওয়া পাঁচ বছরের বিকাশ দাসকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের এয়ারপোর্ট থানায় পৌঁছে দিয়েছিলেন সুপ্রিয় রায় নামে বিরাটি-গৌরীপুরের এক বাসিন্দা। যশোহর রোডে রাতে একা একা শিশুটিকে খালি গায়ে ঘুরতে দেখে তিনি তাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু এই ব্যাপারে কোনও খবরই যায়নি বারাসত থানায়। বিকাশকে যে থানায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পরেও তা জানতে পারেননি বাড়ির লোকেরা। এয়ারপোর্ট থানা সে-রাতেই শিশুটিকে রেখে আসে একটি হোমে।

শিশুটি চার রাত হোমে থাকার পরে নেহাতই বরাতজোরে তার খবর পান বাড়ির লোক। বুধবার সন্ধ্যায় বিকাশকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় মায়ের কোলে। এই ঘটনায় ফের বেআব্রু হয়ে পড়েছে হারানো শিশু খোঁজার ক্ষেত্রে পুলিশের অপদার্থতা।

প্রশ্ন উঠছে, এত টাকা খরচ করে, এত ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘মিসিং চিলড্রেন ট্র্যাকিং পোর্টাল’ চালু করে তা হলে লাভটা কী হল? নিখোঁজ শিশুকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের থানায় পৌঁছে দেওয়া সত্ত্বেও তার খবর কেন পেল না পরিবার? প্রযুক্তির সহযোগিতা সত্ত্বেও এই অপদার্থতার দায় কার, উঠছে সেই প্রশ্নও।

পুলিশ-পোর্টাল যেখানে ব্যর্থ, সেখানে শেষ পর্যন্ত কী ভাবে পরিবারের কাছে ফিরে এল বিকাশ?

বিরাটিতে মোটরবাইকের গ্যারাজ ও বাড়ি রয়েছে সুপ্রিয়বাবুর। শনিবার রাতে গ্যারাজে কাজ করছিলেন তিনি। সুপ্রিয়বাবু বললেন, “তখন রাত ৮টা। আমার পাঁচ বছরের মেয়ে সুদীপা এসে বলল, ‘বাবা, দেখো, একটা ভাই।’ তাকিয়ে দেখি, যশোহর রোডে খালি গায়ে একটা বাচ্চা হেঁটে চলেছে একা একা। চার পাশে গাড়ি।” সুপ্রিয়বাবু সঙ্গে সঙ্গে বিকাশকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু ছোটবেলা থেকে দিল্লিতে বড় হওয়া বিকাশ বাবার নাম আর ‘রেললাইন’ ছাড়া কিছুই বলতে পারছিল না। মোটরবাইকে তাকে নিয়ে আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করেও তার বাড়ির খোঁজ পাননি সুপ্রিয়বাবু। অগত্যা রাতেই এয়ারপোর্ট থানায় শিশুটিকে পৌঁছে দেন তিনি। থানা পত্রপাঠ বিকাশকে রেখে আসে কলকাতার একটি হোমে। তার আর খোঁজ নেয়নি পুলিশ! বিকাশের বাড়ির লোকেরাও খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গিয়েছেন। অবশেষে বেশ কিছু পোস্টার ছাপিয়ে তাঁরা তা লাগিয়ে দেন ট্রেনে, বাসে ও রেল স্টেশনের মতো কিছু জায়গায়।

মঙ্গলবার, মহরমের ছুটিতে বাস ধরে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন গুড্ডু শেখ নামে সুপ্রিয়বাবুর গ্যারাজের এক কর্মী। বাসে ‘সন্ধান চাই’ পোস্টারটি দেখতে পান তিনি। তাতে দেওয়া পুরনো ছবিতে মাথায় চুল ছিল না বিকাশের। কিন্তু এখন তার ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়া চুল। ছবিটি দেখে সন্দেহ হয় গুড্ডুর। বাস থেকেই সুপ্রিয়বাবুকে ফোন করেন তিনি। পোস্টারে ছাপা ফোন নম্বরও দেন। সেই নম্বরে ফোন করেন সুপ্রিয়বাবু। ফোন যায় বিকাশের বাড়িতে। পুলিশ বা পোর্টাল নয়, দু’টি সাধারণ মানুষের তৎপরতায় এ ভাবেই ঘরে ফেরে বিকাশ।

ছেলে ফিরে পেলেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিকাশের পরিবার। বিকাশ হারিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বারাসত থানায় নিখোঁজ-ডায়েরি করেছিলেন তাঁরা। নিয়ম হল, ডায়েরি হলেই নিখোঁজের নাম, ছবি-সহ যাবতীয় তথ্য ‘মিসিং চিলড্রেন ট্র্যাকিং পোর্টাল’-এ তুলে দিতে হবে। দেশের সব থানার পৌঁছে যাবে সেই তথ্য। রাজ্যের সব থানা এবং সিআইডি-র কাছে ই-মেল বা মেসেজ পাঠিয়েও নিখোঁজের ঘটনাটি জানিয়ে দেওয়ার কথা। প্রয়োজনে সংবাদমাধ্যমে ছবি দিয়ে সন্ধান চাইতে হবে। বারাসত থানার দাবি, শেষেরটি বাদ দিয়ে সব নিয়মই পালন করেছে তারা। এয়ারপোর্ট থানা বলছে, তারাও শিশুটিকে হাতে পেয়েই তার তথ্য সর্বত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বারাসত থানার অনুযোগ, এয়ারপোর্ট থানা বিকাশকে পেয়ে তার তথ্য পোর্টালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে যে-দাবি করছে, তা ঠিক নয়। কারণ, সে-ক্ষেত্রে বিকাশকে পাওয়ার তথ্য তারা পোর্টাল খুলেই জানতে পারত।

কারা ঠিক বলছে আর ব্যর্থতার দায় কার, চাপান-উতোরে সেটা ঘিরে এখন ঘোরতর কুয়াশা। আরও আশ্চর্যের, ওই এলাকার অন্য দু’টি থানার দাবি, শিশুটির অন্তর্ধান বা উদ্ধারের কোনও তথ্যই তারা জানতে পারেনি। আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে ‘মিসিং চিলড্রেন ট্র্যাকিং পোর্টাল’ খুলেও দেখা গিয়েছে, ওই শিশুটি সম্পর্কে কোনও তথ্যই সেখানে নেই। তা হলে আসল ঘটনাটা কী?

“আমরা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছি,” বললেন উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। বিধাননগরের ডেপুটি কমিশনার সন্তোষ নিম্বলকরও জানান, তাঁরা খোঁজখবর নিচ্ছেন। আর জেলা পুলিশের এক কর্তা সাফ বলে দিলেন, “কেউই ঠিক বলছে না। আসলে ওই শিশুটির তথ্য পোর্টালেই তোলেনি কেউ। এখন বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় দায় ঠেলাঠেলি চলছে।”

বুধবার রাতে বাড়িতে ফেরার পরে বিকাশদের বাড়িতে উপচে পড়েছে ভিড়। শিশুটিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। কোলে কোলে ফিরছে সে। মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা তখন দিনরাত ছোটাছুটি করছি। অথচ পুলিশ বাচ্চাটার খোঁজ পর্যন্ত করল না! পাশের থানায় পৌঁছে দেওয়ার পরেও পুলিশ কেন জানতে পারবে না, বাচ্চাটা কার? পুলিশের ঘরে কি বাচ্চাকাচ্চা নেই?”

বিকাশকে কোলে আঁকড়ে মা অঞ্জলিদেবী বলেন, “পোস্টার দেখে ফোনটা না-করলে আমি যে কী করতাম, জানি না! নিতান্ত ভাগ্যের জোরে ছেলেকে ফিরে পেলাম।”

কিন্তু যাঁদের ভাগ্য এতটা প্রসন্ন নয়, তাঁদের কী হবে? পোর্টাল থাকতেও প্রশ্নটা রয়েই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE