Advertisement
১৭ মে ২০২৪
Sandeshkhali Incident

অন্তঃসত্ত্বা কিংবা প্রসূতিদের জমায়েতে থাকত ‘দাদা’র লোকজন! দাবি সন্দেশখালির আশাকর্মীর

শেখ শাহজাহান, উত্তম সর্দার, শিবু হাজরা জেলে গিয়েছে। কিন্তু সত্যি কি স্বস্তি ফিরবে সন্দেশখালিতে? প্রশ্নটা তুললেন ওই গ্রামের মাঠেঘাটে স্বাস্থ্যের কাজ করা আশাকর্মীরা।

Shahjahan Sheikh

শেখ শাহজাহান। —ফাইল চিত্র।

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৬:০৭
Share: Save:

আতঙ্ক কাটিয়ে, চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তি। লাঠিতে ভর দিয়ে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন বছর পঁচাশির বাদল সর্দার। ডায়াবিটিসের রোগী, খাবার হজমে সমস্যা। কিন্তু প্রায় দিন কুড়ি ডাক্তারের কাছে এসে সুগার মাপাতে পারেননি। কেন? বৃদ্ধ বললেন, “কেমন করে আসব? চারদিকে তো গন্ডগোল। এই বয়সে আর ঝামেলা সইতে পারি না।” রোদের তাপ আটকাতে স্বামীর মাথায় ছাতা ধরে বৃদ্ধা কণিকা সর্দার বললেন, “এ ক’দিন বড্ড কষ্ট হয়েছে। ডাক্তারের কাছে এসে ওষুধ নিতে পারিনি। তবে ওরা জেলে গেছে, এ বার হয়তো একটু স্বস্তি মিলবে।”

শেখ শাহজাহান, উত্তম সর্দার, শিবু হাজরা জেলে গিয়েছে। কিন্তু সত্যি কি স্বস্তি ফিরবে সন্দেশখালিতে? প্রশ্নটা তুললেন ওই গ্রামের মাঠেঘাটে স্বাস্থ্যের কাজ করা আশাকর্মীরা। যাঁরা বলছেন, “ওদের কারণেই যত সমস্যা। তার মাসুল গুনতে হল সাধারণ মানুষকে। এখন ভয়, এক শাহজাহান গেলেও দশ জন শাহজাহান কিন্তু আছে। সব রক্তবীজের বংশধর।” গর্ভবতী, প্রসূতি, নবজাতকদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে বাড়ি বাড়ি যেতে হয় আশাকর্মীদের। আবার, গ্রামের কোনও বাড়িতে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা যে কোনও ‘নন-কমিউনিকেবল ডিজ়িজ়’-এর রোগী থাকলে তাঁকে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসার কাজ করতে হয় ওই কর্মীদেরই। কিন্তু প্রায় ২৩ দিন ধরে আন্দোলনের জেরে বিক্ষিপ্ত ভাবে ধাক্কা খেয়েছে সেই সমস্ত কাজ। আশাকর্মী রীতা মণ্ডলের কথায়, “১৪৪ ধারা চলছে, অনেক মেয়ের নামেই পুলিশ অহেতুক এফআইআর করেছে। সেই ভয়ে আমাদের অনেকেই রাস্তায় বেরোতে পারিনি। তাতে কিছুটা সমস্যা হয়েছে তো বটেই।” তবে প্রসূতি, গর্ভবতীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতেন তাঁরা। তাঁদের বাড়িতে এসেও ওষুধ নিয়ে গিয়েছেন প্রসূতি, গর্ভবতীদের পরিজন।

আশাকর্মীরা জানালেন, গর্ভবতী, প্রসূতি বা বয়ঃসন্ধির মেয়েদের নিয়ে যে জমায়েত হত, তা করার আগে জানাতে হত ‘দাদা’দের। কারণ, তাদের পাঠানো এক জন লোক বসে থাকত ওই বৈঠকে। কোভিডের প্রতিষেধকের সময়ে প্রতিদিন সকালে উত্তম-শিবুর লোকজন তালিকা পৌঁছে দিত টিকা কেন্দ্রে। তাতে নাম থাকা ব্যক্তিদের আগে প্রতিষেধক দিতে হত। ত্রিমনি বাজারের কাছে এক টোটোচালক বলেন, “৫০০ টাকা দিলেই তালিকায় নাম উঠত। আমি নিজেও দিয়েছি।”

আন্দোলনের জেরে বিক্ষিপ্ত ভাবে বুনিয়াদি স্বাস্থ্য পরিষেবা ধাক্কা খেয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রায় প্রতিমাসেই অন্তত ১৫-২০ দিন কার্যত ভয় দেখিয়ে মিটিং-মিছিলে হাজিরা দেওয়ানোর যে রেওয়াজ শাহজাহান বাহিনী শুরু করেছিল, তাতে আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে আশাকর্মীদের একাংশ দাবি করেছেন। খুলনা ফেরিঘাটে নৌকায় ওঠার আগে এক আশাকর্মী বললেন, “ডাকলে হাজিরা দিতেই হবে। সে দিন নবজাতকের টিকা, গর্ভবতী মায়ের চেকআপ, যে কাজই থাকুক না কেন। ওরা বলত, আমাদের দিদি টাকা দিচ্ছে। ডাকলেই পার্টির কাজে আসতে হবে। দিনের পর দিন এমন চলেছে। তাতে পরিষেবার অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে।”

সন্দেশখালি-২ ব্লকের আটটি অঞ্চল মিলিয়ে এই মুহূর্তে গর্ভবতী মহিলার সংখ্যা প্রায় ২৫০। ফেব্রুয়ারিতে জন্ম হয়েছে প্রায় ৫০-৬০টি শিশুর। তবে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে খুলনা গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে প্রায় সব প্রসূতিই সোজা চলে গিয়েছেন বাবার বাড়িতে। বসিরহাট স্বাস্থ্য জেলার এক আধিকারিকের কথায়, “প্রায় এক মাস সমস্যা তো হয়েছেই। এ বার হয়তো সেটা মিটে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আশাকর্মীরা আবার কর্মবিরতি শুরু করেছেন।”

গ্রামের মহিলাদের আন্দোলনের জেরে না হয় সম্প্রতি পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু এত দিন কেন প্রতি পদে স্বাস্থ্য পরিষেবা ধাক্কা খেয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। মিশনমাঠের সামনে দাঁড়িয়ে এক কর্মী দেখালেন ভগ্নপ্রায় উত্তর দ্বারির জাঙ্গাল উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। যেখানে এক জন গর্ভবতীকে ‘চেকআপ’ করার ন্যূনতম পরিকাঠামোও নেই। ওই কর্মী বললেন, “এটি সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র করার জন্য নাকি জমি মিলছে না। এ দিকে দেখুন, ওই একচিলতে ঘর লাগোয়া এত বড় মাঠের জমি শাহজাহান দখল করে বসেছিল।” সন্দেশখালি-২ ব্লকে মোট ৪২টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রই জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের টাকায় সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার কথা। এক বছর আগে সে জন্য টাকাও বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু উত্তর হাটগাছা ছাড়া আর কোনটিরই কাজ হয়নি। কেন? ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক কৌশিক মণ্ডল শুধু বললেন, “২৭টি কেন্দ্রের কাজ পঞ্চায়েত সমিতির করার কথা। কিন্তু কী হয়েছে তা জানি না।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। সন্দেশখালির একটি চায়ের দোকানে জটলায় থাকা শীর্ণকায় করিম মোল্লা বললেন, “এক বছর সুগারে ভুগছি। সরকারি চিকিৎসা কিছুই জোটে না। বাইরে তিনশো টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাচ্ছি।” জটলা থেকে উড়ে এল মন্তব্য, “এখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিজেই তো অসুস্থ।” আর এক জন বৃদ্ধ বললেন, “বাঘেদের নখ-দাঁতের আঁচড়-কামড়ে যে ঘা সন্দেশখালির শরীরে হয়েছে, আগে সেটা সারুক।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE